Site icon The Bangladesh Chronicle

ঢাকার মিয়ানমার কৌশলে ডিলেমা

মাসুম খলিলী

বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ জরুরি দিল্লি সফর থেকে দেশে ফেরার পর বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশ দুই দেশই মিয়ানমারের অভ্যন্তরীণ সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই সফরকালে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হাছান মাহমুদ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত দোভালের সাথে বৈঠক করেছেন। এর আগে নিরাপত্তা উপদেষ্টা দোভাল দু’দিনের অঘোষিত সফরে বাংলাদেশ ঘুরে গেছেন। বাংলাদেশ ও ভারতের পররাষ্ট্রনীতি প্রণেতাদের বক্তব্যে বোঝা যায় মিয়ানমারের সাম্প্রতিক যে উন্নয়ন সেটি দিল্লি ও ঢাকাকে সমানভাবে উদ্বিগ্ন করেছে যদিও দু’দেশের কৌশলগত স্বাথর্ ও বাস্তবতা সব ক্ষেত্রে এক নয়।

মিল-অমিল
বাংলাদেশের তিন দিকেই ভারত। আর অন্য যে দিকটিতে মিয়ানমার রয়েছে সেই অবস্থানটি দুই দেশের জন্য সংবেদনশীল। ভারতের মিয়ানমার সীমান্তের এপারে রয়েছে মিজোরাম, মনিপুর ও নাগাল্যান্ড। অন্য দিকে বাংলাদেশের কক্সবাজার ও বান্দরবান সীমান্তের ওপারে রয়েছে রাখাইন চিন, সাগাইন ও কাচিন স্টেট। কাচিন ও শান স্টেটের সাথে দীর্ঘ সীমান্ত রয়েছে চীনের। চীনের পরে লাওস ও থাইল্যান্ড হলো মিয়ানমারের অন্য প্রতিবেশী দু’দেশ।

বাংলাদেশ ও ভারতের অভিন্ন উদ্বেগের জায়গাটি হলো, এই অঞ্চলে একটি আলাদা রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার প্রচেষ্টা। এ অঞ্চলের তিন দেশের মিজো কোকি চিন জনগোষ্ঠী নিজেদের অভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর বলে দাবি করে। ‘জো জনগোষ্ঠী’ হিসাবে পরিচয় দিয়ে তারা প্রাথমিকভাবে রাষ্ট্র কাঠামোর মধ্যে অধিক সুশাসন আর চূড়ান্তভাবে বিচ্ছিন্ন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করে। এই জনগোষ্ঠীর একটি নৃতাত্ত্বিক এবং আরেকটি ধর্মীয় পরিচয় রয়েছে। নৃতাত্ত্বিকভাবে তারা মঙ্গোলয়েড ধারার জাতিগোষ্ঠী যাদের সাথে চীনের হান জাতিগোষ্ঠীর কিছুটা মিল রয়েছে। ধর্মীয়ভাবে এই অঞ্চলে খ্রিষ্টবাদ ও বৌদ্ধ ধর্মের অনুসারী বেশি। জায়নবাদীদের বিভিন্ন গবেষণায় এই জাতিগোষ্ঠীর একটি বড় অংশকে ইহুদিদের হারানো গোত্রের বংশধারা হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে।

বাংলাদেশের উদ্বেগ
বাংলাদেশের জন্য উদ্বেগের স্থানটি হলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কোকি-চিনরা একটি আলাদা দেশের মানচিত্র প্রকাশ করেছে, যেখানে পার্বত্য চট্টগ্রামকে এই রাষ্ট্র্রের সীমানা দেখানো হয়েছে। কোকি চিন জাতিগোষ্ঠী পার্বত্য চট্টগ্রামে একটি সংখ্যালঘু উপজাতি। তারা যে বিচ্ছিন্নতাবাদী মানচিত্র প্রকাশ করেছে তার গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠী নৃতাত্ত্বিকভাবে চাকমা ও মারমা। চাকমা ও মারমাদের জাতিগত সংগঠন পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতি ও ইউপিডিএফ-এর বিভিন্ন শাখা প্রকাশ্যে এই কোকি চিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার তথাকথিত বক্তব্যে একমত হয়েছে বলে প্রকাশ করেনি যদিও এই জনগোষ্ঠীগুলো একসময় জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠার জন্য শান্তি বাহিনীর পরিচয়ে সশস্ত্র যুদ্ধ করেছে। এখনো সন্তু লারমাসহ অনেক পাহাড়ি নেতার মুখে জুমল্যান্ড প্রতিষ্ঠা এবং এ জন্য আলাদা পতাকা ও সঙ্গীত গাইতে দেখা যায় প্রকাশ্য অনুষ্ঠানে। এ বিষয়টি সঙ্গতভাবেই বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিবেশের জন্য একটি উদ্বেগের বিষয়।

ভারতের উৎকণ্ঠা
অন্য দিকে একই ধরনের উদ্বেগ রয়েছে বাংলাদেশের বৃহৎ প্রতিবেশী ভারতের। দেশটির মিজোরামে যে সরকার রয়েছে তারা ফেডারেল ভারতের প্রতি যতটা অনুগত তার চেয়ে বেশি নিজস্ব জাতিগোষ্ঠীর স্বার্থের প্রতি অনুগত বলে মনে হয় যার ফলে মিজোরাম সরকার বাংলাদেশের ও মিয়ানমারের বিচ্ছিন্নতাবাদী কোকি চিন নেতাদের আশ্রয় দিয়ে থাকে। পার্শ্ববর্তী মনিপুর বিজেপির নেতৃত্বাধীন কোয়ালিশন সরকার চালালেও রাজ্যটি মূলত সমতলবাসী ও পাহাড়িদের মধ্যে বিভক্ত। সমতলের মৈথেই সম্প্রদায়ের বিরুদ্ধে সশস্ত্র লড়াইয়ে অবতীর্ণ পাহাড়িরা রাজনীতি নির্বিশেষে আলাদা রাজ্য দাবি করছে। পার্শ্ববর্তী নাগাল্যান্ডেও একই ধরনের সঙ্কট রয়েছে।

এই অঞ্চলে জো জনগোষ্ঠী হিসাবে যেসব পাহাড়ি নিজেদের চিহ্নিত করছে তাদের ধর্ম ও জীবনাচরণে ভারতীয় সংস্কৃতি ও জীবনযাপনের কোনো প্রভাব নেই। নৃতাত্ত্বিক কারণে এই জাতিগোষ্ঠীর সাথে রয়েছে চীনের গভীর যোগাযোগ। আর খ্রিষ্ট ধর্ম ও ইহুদি ধর্ম সংযোগের জন্য তাদের সাথে রয়েছে পশ্চিমা দেশ ও ইসরাইলের যোগসূত্র।

চীনের সাথে ভারতের বিরোধ বহু পুরোনো। দুই দেশের অভিন্ন সীমান্তের বড় অংশই এখনো বিতর্কিত বা অমীমাংসিত। সেখানে প্রায়ই যুদ্ধ সঙ্ঘাত লেগে থাকত। সে তুলনায় মিয়ানমারের সাথে অভিন্ন ব্রিটিশ উত্তরাধিকার দেশ হিসাবে ভারত ভালো সম্পর্ক বজায় রেখে এসেছিল-মিয়ানমারের সাথে। বিশেষত গত দুই দশকের বেশি সময়জুড়ে সরকার নির্বিঘ্নে মিয়ানমারের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক তৈরি করে এসেছে। এই সুসম্পর্কের স্মারক হলো দেশটিকে ভারতের সাবমেরিন থেকে শুরু করে মিসাইল ও অন্যান্য সমরাস্ত্র বিক্রি এবং কালাদান বহুমুখী সংযোগ প্রকল্প।

ভারতের মিয়ানমার সীমান্তবর্তী অঞ্চলে বিদ্রোহীদের অগ্রাভিযানে এই সম্পর্ক হুমকির মধ্যে পড়ে গেছে। কালাদান প্রকল্পের গুরুত্বপূর্ণ সমন্বয় সংযোগ পালেতোয়া আরাকান আর্মি দখল করে নিয়েছে। সিটওয়ে সমুদ্রবন্দর থেকে শুরু করে মিজোরাম সীমান্ত পর্যন্ত প্রকল্পটির বড় অংশে কাজ বন্ধ রয়েছে। মিয়ানমারের জান্তা সরকারের সাথে বোঝাপড়া বজায় রাখার স্বার্থে দিল্লি সূ চি সমর্থক এনইউজি সরকার ও তার মিলিশিয়া বাহিনীর সাথে কোনো সংযোগ রাখেনি। এনইউজি সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এই সংযোগ বজায় রেখেছে এক দিকে চীন এবং অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র ও অন্য পশ্চিমা মিত্ররা। ভারতের সীমান্তবর্তী মিয়ানমার অংশে এখন জান্তা সরকারের কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। সেখানে নিয়ন্ত্রণ রয়েছে চীনপন্থী ব্রাদারহুড অ্যালায়েন্সের।

কেন বাংলাদেশের সহযোগিতা?
ভারতের বিপদ হলো, এক দিকে তাদের কৌশলগত কালাদান প্রকল্প অকার্যকর হয়ে যাচ্ছে। অন্য দিকে বিদ্রোহী জাতিগোষ্ঠী যারা এই অঞ্চলের কর্তৃত্ব নিচ্ছে তাদের সাথে ভারতের নিজস্ব নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠীর মিলিত হওয়ার সমীকরণ তৈরি হচ্ছে। এই বিপদে ভারতের জন্য বাংলাদেশের সহযোগিতার কোনো বিকল্প নেই।

এই অঞ্চলে বাংলাদেশে নিরাপত্তা উদ্বেগের বড় অংশজুড়ে রয়েছে রোহিঙ্গা সমস্যা। ১০ লাখের বেশি রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ভেতরে বাস করছে। সাম্প্রতিক জান্তা-বিদ্রোহী লড়াইয়ে বিপন্ন লাখ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশের ভেতরে চলে আসতে চাইছে। একই সাথে অস্থির হয়ে উঠছে বাংলাদেশের পার্বত্যাঞ্চল।

ভারত রোহিঙ্গা ইস্যুতে বাংলাদেশকে কোনো সময় সমর্থন দেয়নি। তাদের ভূমিকা সব সময় নেইপিডোর পক্ষে গেছে। শান্তি বাহিনীর বিচ্ছিন্নতাবাদের জন্য লড়াইয়েও একসময় ভারতের সমর্থন ছিল। আওয়ামী লীগ বাংলাদেশে সরকার গঠন করলে শান্তি চুক্তি সম্পাদনে সহায়তা করে দিল্লি। এই সহায়তার পেছনে ভারতের বড় উদ্বেগ ছিল ৭ বোন রাজ্যগুলোর বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলন।

এখন নতুন করে মিয়ানমারে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে তাতে সেই উদ্বেগ ভারত-বাংলাদেশ দুই দেশকে আক্রান্ত করছে। এই অঞ্চলে যেসব নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠী আলাদা রাষ্ট্র্র প্রতিষ্ঠা করতে চায় তাদের উপর ইউরোপ-আমেরিকা ও চীনের প্রভাবই বেশি। পূর্ব তিমুরের মতো কোনো রাষ্ট্র এখানে তৈরি করতে চাইলে অথবা মিয়ানমারকে ভেঙে একাধিক রাষ্ট্র গঠন ও তার সাথে প্রতিবেশী অঞ্চলগুলোকে কোনো অবয়বে সমন্বিত করতে চাইলে তার সাথে এই দুই শক্তির সংশ্লিষ্টতা থাকতে হবে।

বলার অপেক্ষা রাখে না যে, বিশ্বাস অবিশ্বাসের দোলাচলের মধ্যেও যুক্তরাষ্ট্র হলো ভারতের কৌশলগত মিত্র। এতদিন পর্যন্ত চীন ছিল বাংলাদেশের অন্যতম কৌশলগত মিত্র। এই দুই মিত্রের কেউ যদি এই সংবেদনশীল অঞ্চলে কোনো একটি বাফার রাষ্ট্র গঠনে সক্রিয় হয় তাহলে কী করবে এই দুই দেশ? ভারত অনেক বড় ও শক্তিধর দেশ। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের বৈশ্বিক প্রভাবের সামনে তার সীমাবদ্ধতা অনেক সময় স্পষ্ট হয়ে ওঠে। অন্য দিকে, বাংলাদেশ চীনের মতো প্রতিবেশী রাষ্ট্রে বৈরিতার মুখ ঢাকার জন্য সহনীয় কিনা, সেই প্রশ্ন রয়েছে। দুই পরাশক্তির সাথে সম্পর্কের এই জটিল অবস্থার মধ্যে ঢাকা দিল্লি উভয়ে পরস্পরের মধ্যে সহযোগিতা ও অভিন্ন কৌশল নিয়ে এগিয়ে যেতে চাইছে।

তবুও দূরত্ব রয়ে গেছে
ভারত আর বাংলাদেশের সরকারের সাথে সরকারের যে সম্পর্ক সেটিকে জনগণের সাথে জনগণের সম্পর্কে রূপান্তরের প্রচেষ্টা নেয়নি দিল্লি। ফলে বাংলাদেশে নির্বাচনব্যবস্থা ও গণতন্ত্রকে ধ্বংস করার কাজে সহযোগী হিসেবে গরিষ্ঠ জনগোষ্ঠীর অপছন্দের প্রতিবেশী হয়ে রয়েছে ভারত। আর বাংলাদেশের জনগণকে সবসময় সন্দেহের চোখে দেখে বৃহৎ প্রতিবেশী দেশটি। এই বাস্তবতাকে সহযোগিতায় কার্যকরভাবে রূপান্তর করে গন্তব্যে পৌঁছাতে হলে কার্যকর আস্থা অর্জনের প্রয়োজন রয়েছে। সেই আস্থার ভিত্তি হতে হবে সমমর্যাদাবোধকে স্বীকার করে নেয়া।

মিয়ানমার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ও ভারত দুই দেশই ডিলেমার মুখে। মার্কিন কংগ্রেসে বার্মা অ্যাক্ট পাস হওয়ার পর অনেক বিশ্লেষক মনে করতে শুরু করেন যে, বিশ্বের পরবর্তী যুদ্ধক্ষেত্র সম্ভবত দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার এই সংযোগস্থলটি। সাম্প্রতিক উন্নয়ন সেই আশঙ্কাকে প্রবল করে তুলেছে। সত্যি সত্যি তেমন কিছু ঘটলে মিয়ানমারের ললাটে যেমন ধ্বংস অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে, তেমন পরিস্থিতি অগ্নিবাণ নিক্ষেপ করবে বাংলাদেশ ও ভারতের দিকেও।

নয়াদিগন্ত

Exit mobile version