আগামী রোববার থেকে আবারও একই কর্মসূচি ঘোষণার প্রস্তুতি নিচ্ছে তারা। এ অবরোধ রাজধানীসহ সারাদেশের বিভাগীয় শহর, জেলা-উপজেলায়ও কার্যকর বলে জানিয়েছেন দলগুলোর নেতারা। অবরোধের মাধ্যমে ঢাকাকে সারাদেশ থেকে বিচ্ছিন্ন করার পরিকল্পনা রয়েছে বিএনপিসহ সমমনা ৩৭ দলের। তবে সময় ও পরিস্থিতি বুঝে ‘ঢাকা ঘেরাও’ কর্মসূচি নিয়েও আলোচনা চলছে বিরোধী দলগুলোতে। অবশ্য বিএনপির সঙ্গে প্রকাশ্যে সমমনা দল না হয়েও তিন দিন দেশজুড়ে অবরোধের ডাক দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
এদিকে মহাসমাবেশ ও হরতাল ঘিরে সংঘাত, সংঘর্ষ, প্রাণহানি, অগ্নিসংযোগের পর টানা তিন দিনের অবরোধে জনমনে বাড়ছে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, মহাসমাবেশে পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা পরিকল্পিতভাবে হামলা ও গুলি চালিয়েছে। এ ঘটনায় সরকারের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। তারা জনগণকে ভয় পায়। তাই রাষ্ট্রীয় বাহিনীকে ব্যবহার করে জনগণের দাবির বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছে। তবে এসব করে এবার পার পাবে না। পতন তাদের হবেই। মানুষের ভোটাধিকার আর বেঁচে থাকার অধিকার নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে।
দলীয় সূত্র জানায়, পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ নেতা আহত হয়েছেন। গ্রেপ্তার এড়াতে সবাই পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। একটু স্বাভাবিক অবস্থার জন্য দু-একদিন অপেক্ষা করছেন তারা। যেসব নেতাকর্মী ঢাকায় আটকা পড়েছিলেন, তারা যেন নির্বিঘ্নে এলাকায় যেতে পারেন, সেখানে আন্দোলন গড়ে তুলতে পারেন এবং সাধারণ মানুষও তাদের গুরুত্বপূর্ণ কাজকর্ম সেরে নিতে পারেন– সে লক্ষ্যে গতকাল সোমবার কর্মসূচি না রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এ সময়ের পর ঢাকার আশপাশের জেলাসহ প্রতিটি জেলা, মহানগর এমনকি থানা-উপজেলা পর্যন্ত সর্বাত্মক আন্দোলন গড়ে তোলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এমনকি থানা থেকে ইউনিয়ন পর্যন্ত যেতে মূল সড়ককেও আন্দোলনের আওতায় নিয়ে আসতে বলা হয়েছে।
বিএনপি নেতাকর্মীরা জানান, ঢাকায় আন্দোলন গড়ে তুলতে এতদিনের পরিকল্পনা অনুযায়ী সংগঠিত দুই মহানগরের নেতাদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিভিন্ন অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীর সঙ্গে সমন্বয় করে পুরো ঢাকাকে অচল করতে সর্বাত্মক আন্দোলনে যেতে বিভিন্ন ইউনিটকে দায়িত্ব দিয়েছেন দলের হাইকমান্ড। একজন নেতার অবর্তমানে আরেকজনকে সামনে আনার সিদ্ধান্তও রয়েছে। নেতাকর্মী যাতে কোনোভাবেই মাঠ ছেড়ে না দেয়, সে জন্য সরাসরি কথা বলছেন দলের হাইকমান্ড।
সূত্র জানায়, এবারের আন্দোলনে দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীকে মাঠে থাকার কঠোর নির্দেশনা দিয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নেতা। তাদের মনিটর করার জন্য এরই মধ্যে বিভিন্ন তদারকি সেল কাজ করতে শুরু করেছে। গ্রেপ্তার এড়িয়ে সর্বোচ্চ শক্তি নিয়ে মাঠে থাকতে, কর্মসূচি সফল করতে যা যা করা দরকার, তা করতে বলা হয়েছে। তবে যেসব দায়িত্বশীল নেতা ভয় পাবেন, কর্মসূচিতে গরহাজির থাকবেন, পালিয়ে থাকবেন, যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করবেন, মাঠপর্যায়ে নেতৃত্ব দেবেন না– তাৎক্ষণিক তাদের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার কড়া বার্তাও দেওয়া হয়েছে।
বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গতকাল সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আদর্শ ও ন্যায়ের সংগ্রাম কখনও পরাজিত হয় না। চক্রান্তকারী নিষ্ঠুর সরকারের পতন অত্যাসন্ন।
সংঘর্ষের ঘটনায় হতবিহ্বল বিএনপি
দলটির নেতাকর্মী জানান, গত শনিবার মহাসমাবেশে সংঘর্ষের ঘটনা ছিল তাদের জন্য অপ্রত্যাশিত। তারা সেদিন নতুন কর্মসূচির জন্য অপেক্ষা করছিলেন। লাখো লোকের এই সমাবেশ থেকে ঘেরাও কিংবা অবস্থানের মতো কর্মসূচি নিয়ে দলের মধ্যে আলোচনা ছিল। আকস্মিক সংঘর্ষের ঘটনায় একদিকে তারা যেমন হতবিহ্বল, তেমনি ক্ষয়ক্ষতি এবং চাপও অনেক। কয়েক হাজার নেতাকর্মী আহত এবং হাজারের ওপর হয়েছেন গ্রেপ্তার। এখন অর্ধশত মামলায় নেতাকর্মী দিশেহারা। দলের সব নেতাকর্মী এখন পলাতক। এমন অবস্থায় তাৎক্ষণিক সিদ্ধান্তে হরতালের মতো কঠোর কর্মসূচি দিতে বাধ্য হয়েছেন তারা।
দলটির নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, সমাবেশ পণ্ড করা থেকে শুরু করে প্রতিটি ঘটনা সরকারের ছক অনুযায়ী হচ্ছে। এখানে বিএনপি চাইলেও আর শান্তিপূর্ণ পথে কোনো কর্মসূচিতে যেতে পারবে না। যদিও এতে সরকার বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। কারণ, বিএনপির আন্দোলন শুরু হওয়ার পর থেকে সহিংসতা এড়িয়ে সব কর্মসূচি শান্তিপূর্ণভাবে সফল করেছে। এবারও তারা মহাসমাবেশ কেন্দ্র করে সারাদেশের নেতাকর্মীকে ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছেন। তবে সরকারের পরিকল্পনামতো সংঘর্ষের ঘটনা সৃষ্টি করে বিএনপিকে সেই শান্তিপূর্ণ অবস্থান থেকে সরিয়ে রাজপথের কঠোর অবস্থানে নিয়ে আসতে বাধ্য করা হয়েছে।
নাম প্রকাশ না করে দলের কয়েকজন নেতা জানান, সেদিন মহাসমাবেশের স্থান থেকে কোনো সমস্যা তৈরি হয়নি। বিএনপি নেতাকর্মী সকাল থেকেই বাধাবিঘ্ন এড়িয়ে নয়াপল্টনে জড়ো হয়েছেন; সমাবেশ সফল করেছেন। মহাসমাবেশের জন্য প্রশাসনকে দেওয়া চিঠিতেও নাইটিংগেল মোড় পর্যন্ত স্থান চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সংঘর্ষের স্থান আরও অনেক দূরে। সেখানে বিএনপির কোনো মাইক ছিল না, কোনো তদারকি ছিল না। তাহলে সেই দায়ভার বিএনপির ওপরও আসার কথা নয়।
সংঘর্ষের তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছে বিএনপি
কী কারণে এবং কাদের প্ররোচনায় এই সংঘর্ষের সূত্রপাত, পেছনে কাদের পরিকল্পনা ছিল– সেসব খোঁজ নিতে শুরু করেছে বিএনপি। এ জন্য বিভিন্ন মাধ্যম থেকে তথ্য-প্রমাণ সংগ্রহে গুরুত্ব দিচ্ছে দলটি। এসব ঘটনায় কারা জড়িত, তা দেশ-বিদেশে উপস্থাপন করতে দলের পক্ষ থেকে এ উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মহাসমাবেশ ঘিরে সংঘর্ষ-ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রকৃত সত্য উদ্ঘাটনে কমিটি করেছে দলের হাইকমান্ড। তারা স্থিরচিত্র, ভিডিও, গণমাধ্যমের খবরসহ নানা তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করছেন।
সূত্র জানায়, পুলিশের সাবেক এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার নেতৃত্বে একটি কমিটি তথ্য সংগ্রহের কাজ করছে। এতে কেন্দ্রীয় নেতা, আইনজীবীও আছেন। তারা বিভিন্ন ভিডিও ফুটেজ, স্থিরচিত্রসহ তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ শুরু করেছেন। এ ছাড়া পুলিশ প্রশাসন থেকে শুরু করে অন্যান্য মাধ্যম থেকেও তথ্য-প্রমাণ জোগাড় করা হচ্ছে।
বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-দপ্তর সম্পাদক তাইফুল ইসলাম টিপু জানান, নেতাকর্মীর খোঁজ নেওয়া, তাদের সুবিধা-অসুবিধায় পাশে থাকা, মামলা-হামলার তদারকি করা দলের স্বাভাবিক কার্যক্রম। এবারও সব খোঁজ নেওয়া হচ্ছে।
সমকাল