অর্থ সংকটে ভর্তুকি দিতে না পারা ও ডলার সংকটে জ্বালানি তেল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় এ কেন্দ্রগুলো বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল গত বছর জুলাইয়ে। তবে মাসখানেক পরই ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র পুনরায় চালু করা হয়। দিনের বেশিরভাগ সময় বন্ধ থাকলেও পিক আওয়ারে বিশেষত সন্ধ্যার সময় ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র চালানো হতো। এতে কেন্দ্রগুলো থেকে গড়ে ৪৪ টাকায় বিদ্যুৎ কিনতে হয়েছে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে (পিডিবি)।
তথ্যমতে, ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন হয়েছে মাত্র ১২৩ কোটি ৬৯ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে ব্যয় হয়েছে পাঁচ হাজার ৪৩৫ কোটি ১৭ লাখ টাকা। অর্থাৎ গড় ব্যয় পড়েছে ৪৩ টাকা ৯৪ পয়সা। যদিও এ বিদ্যুৎ বিক্রি করতে হয়েছে গড়ে পাঁচ টাকা ৯৪ পয়সা। এতে প্রতি ইউনিটে লোকসান গুনতে হয়েছে গড়ে ৩৮ টাকা। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলে ক্যাপাসিটি চার্জ বাবদ গড়ে লোকসান হতো ২০ টাকা ৬৯ পয়সা।
ডিজেলচালিত বেসরকারি এ কেন্দ্রগুলোর জন্য ক্যাপাসিটি চার্জ পরিশোধ করতে হয়েছে দুই হাজার ৯৪ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। আর জ্বালানি ব্যয় ছিল তিন হাজার ২৯৪ কোটি ২৮ লাখ টাকা। উচ্চ দামে বিদ্যুৎ কিনে ছয় কেন্দ্রে পিডিবির লোকসান গুনতে হয়েছে চার হাজার ৭২৩ কোটি পাঁচ লাখ টাকা। তবে উৎপাদন বন্ধ থাকলে কেন্দ্র ছয়টিতে শুধু ক্যাপাসিটি চার্জের ব্যয় বাবদ দুই হাজার ৯৪ কোটি টাকা লোকসান দিতে হতো।
পিডিবির তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০২২-২৩ অর্থবছর ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রের মধ্যে গড় ব্যয় সবচেয়ে বেশি ছিল সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে স্থাপিত প্যারামাউন্ট বি. ট্রাক এনার্জি বিদ্যুৎকেন্দ্রটির। এর উৎপাদন ক্ষমতা ২০০ মেগাওয়াট, যার মাত্র আট শতাংশ ব্যবহার হয়েছে। এ কেন্দ্রটি থেকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় মাত্র ১৪ কোটি ৬৭ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা। এতে মোট ব্যয় হয়েছে ৮২৮ কোটি ১৭ লাখ টাকা। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড় ব্যয় পড়ে ৫৬ টাকা ৩৩ পয়সা। ফলে কেন্দ্রটিতে লোকসান গুনতে হয়েছে ৭৪১ কোটি ৭৩ লাখ টাকা।
গড় ব্যয় দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ছিল যশোরের নওয়াপাড়ায় অবস্থিত বাংলা ট্র্যাক (ইউনিট-২) বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে। ১০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার কেন্দ্রটিতে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয় প্রায় আট কোটি ৬০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার প্রায় ১৩ শতাংশ। গত অর্থবছর এ কেন্দ্রের মোট ব্যয় ছিল ৪১৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। এতে প্রতি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদনে গড়ে ব্যয় পড়েছে ৪৮ টাকা ৭৪ পয়সা। এতে কেন্দ্রটিতে মোট লোকসান গুনতে হয়েছে ৩৬৯ কোটি ৪৯ লাখ টাকা।
ডিজেলচালিত ছয় কেন্দ্রের মধ্যে গড় ব্যয়ের দিক থেকে গত অর্থবছর তৃতীয় অবস্থানে ছিল কুমিল্লার দাউদকান্দিতে স্থাপিত বাংলা ট্র্যাকের (ইউনিট-১) ২০০ মেগাওয়াট কেন্দ্রটি। এ কেন্দ্রে বছরে কমপক্ষে ১৪৪ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। যদিও ২০২২-২৩ অর্থবছর এ কেন্দ্রটিতে মাত্র ২১ কোটি ৯৩ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা সক্ষমতার ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে ৯২৮ কোটি ৫২ লাখ টাকা। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৪২ টাকা ৩৩ পয়সা। ফলে লোকসান গুনতে হয়েছে ৮০২ কোটি ২৩ লাখ টাকা।
গড় ব্যয়ের দিক থেকে পরের অবস্থানে ছিল ঢাকার অদূরে কেরানীগঞ্জের পানগাঁওয়ে নির্মিত এপিআর এনার্জি কেন্দ্রটি। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ৩০০ মেগাওয়াট সক্ষমতার এ কেন্দ্রটিতে বছরে কমপক্ষে ২১৬ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। অথচ গত অর্থবছর কেন্দ্রটিতে মাত্র ৪৭ কোটি ১৪ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়, যা সক্ষমতার ১৮ শতাংশ। কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয়েছে এক হাজার ৯৮০ কোটি ২০ লাখ টাকা। এতে কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ব্যয় পড়ে ইউনিটপ্রতি ৪২ টাকা এক পয়সা। আর মোট লোকসান গুনতে হয়েছে এক হাজার ৭০৮ কোটি ৭৭ লাখ টাকা।
এদিকে গড় ব্যয়ের দিক থেকে পাঁচে থাকা কেরানীগঞ্জের ব্রাহ্মণগাঁওয়ে অবস্থিত এগ্রিকো পাওয়ার সল্যুশন কেন্দ্রটি গত অর্থবছর চলেছে সক্ষমতার ১৭ শতাংশ। ১০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎকেন্দ্রটিতে এ সময় ১৪ কোটি ৬০ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা বিদ্যুৎ উৎপাদন করা হয়েছে। তবে কেন্দ্রটির সক্ষমতা ৭২ কোটি কিলোওয়াট ঘণ্টা। গত অর্থবছর এ কেন্দ্রটিতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে মোট ব্যয় হয় ৫৯৭ কোটি ৭৭ লাখ টাকা। এতে ইউনিটপ্রতি ব্যয় পড়ে ৪০ টাকা ৯৩ পয়সা। ওই কেন্দ্র থেকে বিদ্যুৎ কিনে পিডিবির লোকসান হয়েছে ৫১৩ কোটি ৬৮ লাখ টাকা।
কেরানীগঞ্জের ওরাহাটিতে নির্মিত এগ্রিকো এনার্জি সল্যুশন লিমিটেড কেন্দ্রটি গড় ব্যয়ের দিক থেকে ষষ্ঠ স্থানে রয়েছে। ১০০ মেগাওয়াটের কেন্দ্রটি থেকে গত অর্থবছর বিদ্যুৎ কেনা হয় ১৬ কোটি ৭৫ লাখ কিলোওয়াট ঘণ্টা, যা সক্ষমতার ১৯ শতাংশ। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন মোট ব্যয় ৬৮৩ কোটি ৬২ লাখ টাকা। কেন্দ্রটির গড় ব্যয় ছিল ৪০ টাকা ৮০ পয়সা। আর মোট লোকসান হয় ৫৮৭ কোটি ১৫ লাখ টাকা।
জানতে চাইলে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, ডলার সংকটে ডিজেল আমদানি ব্যাহত হওয়ায় এবং সরকারের ভর্তুকি কমিয়ে আনতে ডিজেলচালিত ছয় বিদ্যুৎকেন্দ্র বন্ধের ঘোষণা দেয়া হয়েছিল। তবে গ্যাস ও ফার্নেস অয়েল সংকটের কারণে এসব জ্বালানির বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রায়ই বন্ধ থাকত। এতে লোডশেডিংয়ের চাপ কমাতে পিক আওয়ারে বাধ্য হয়েই সরকারের অনুমতিক্রমে ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোয় উৎপাদন পুনরায় শুরু করা হয়।
তিনি আরও বলেন, ডিজেলচালিত কেন্দ্রগুলো বন্ধ থাকলে পিডিবির লোকসান কম হতো। তবে ঘাটতি মেটাতে কেন্দ্রগুলো বাধ্য হয়েই চালাতে হয়। যদিও পাঁচটি কেন্দ্রের চুক্তির মেয়াদ এরই মধ্যে শেষ হয়ে গেছে। এগুলো আর নবায়ন করা হয়নি। বাকি কেন্দ্রটিও চলতি অর্থবছর অবসরে চলে যাবে। এতে ডিজেলের চাপ থেকে পিডিবি মুক্তি পাবে।
শেয়ার বিজ