Site icon The Bangladesh Chronicle

ডাকসু থেকে জাকসু : একটি পর্যালোচনা

এলাহী নেওয়াজ খান
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ০৯: ০৪

 

ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ ছাত্র সংগঠন হিসেবে পরিচিত ছাত্রদলের শোচনীয় পরাজয় নিঃসন্দেহে বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নেতাদের ভাবিয়ে তুলেছে। বিশেষ করে, জুলাই বিপ্লবের পর বিএনপির যেসব নেতা অতিকথনের মাধ্যমে নিজেদের গৌরব প্রকাশ করছিলেন, তাদের জন্য এটি হতাশার বিষয়। যদিও রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। আর সৃজনশীল রাজনীতি সবসময় ভুল শুধরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। কিন্তু যদি কেউ পরাজয়ে দিশাহারা হয়ে আরো বেপরোয়া ও একগুঁয়ে হয়ে ওঠে, তাহলে ধ্বংস অনিবার্য।

আমি দেখলাম, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রদলের কোনো একজন নেতা বলেছেন, ‘কোথাও ছাত্রশিবিরকে শান্তিতে থাকতে দেওয়া হবে না।’ এই মন্তব্য শোনার পর আমার মনে পড়ে গেল ১৯৯১ সালে পঞ্চম জাতীয় সংসদে প্রদত্ত তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার ভাষণ। তিনি তখন একই ধরনের বক্তব্য দিয়েছিলেন। তার মর্মার্থ ছিল বিএনপি সরকারকে শান্তিতে কাজ করতে না দেওয়া। পরে আওয়ামী লীগের ভূমিকা সেটাই ছিল।

যাই হোক, রাজনীতি একটি যুদ্ধ। আর রাজনৈতিক যুদ্ধে শেষ বলে কিছু নেই। এ ক্ষেত্রে জয়-পরাজয় গলাগলি করে থাকে। আজ পরাজয়, কাল জয় আসবে। অন্যভাবে বলা যায়, জয়-পরাজয়ের সৌন্দর্যে ভূষিত হয়ে আছে গণতন্ত্র। বর্তমানে পৃথিবীতে যতগুলো সরকার পদ্ধতি আছে, তার মধ্যে গণতান্ত্রিক পদ্ধতিই সেরা। আর সত্যিকারের গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বিরোধী দল ছায়া সরকার হিসেবে বিবেচিত হয়।

গণতন্ত্রের সূতিকার হিসেবে পরিচিত ব্রিটেনে লেবার ও কনজারভেটিভ পার্টি শতাধিক বছর ধরে পর্যায়ক্রমে শাসন করে আসছে। কখনো লেবার পার্টি, কখনো কঞ্জারভেটিভ। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে একইভাবে বহু বছর ধরে কখনো ডেমোক্রেটিক পার্টি, কখনো রিপাবলিকানরা পর্যায়ক্রমে দেশ পরিচালনা করছে। তারা কখনো সিনেটে, কখনো কংগ্রেস অধিবেশনে পরস্পরকে সমালোচনার বানে বিদ্ধ করে, কিন্তু দেশের স্বার্থে ইস্পাত কঠিন ঐক্য বজায় রাখে। বিখ্যাত একটি ইংরেজি ছবি দেখেছিলাম, ছবিটির নাম হচ্ছে, ‘টুডে ইটস মি, টুমোরো ইউ’। আর্য এ কারণেই বলা হয়, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই।

মূলত বেঞ্জামিন ডিসরেইলি একজন ইহুদি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ রাজনীতিবিদ, যিনি দুবার ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন, তিনিই প্রথম বলেছিলেন, রাজনীতিতে শেষ বলে কিছু নেই। বেঞ্জামিনের এই উক্তি থেকে এটি বোঝা যায়, আপনি একটি ইস্যুতে হেরে গেছেন, আরেকটি ইস্যুতে জিতে যাবেন। কিংবা এবার আপনি নির্বাচনে হেরে গেছেন, পরেরবার জিতে যাবেন বা জয়লাভের সুযোগ থেকে যায়। কিন্তু কেউ যদি মনে করেন হেরে যাওয়া মানে জীবন আর কখনো জিততে পারবে না, তাহলে তার পক্ষে কখনোই ঘুরে দাঁড়ানো সম্ভব নয়।

দৃষ্টান্ত হিসেবে স্কটল্যান্ডের রাজা রবার্ট ব্রুসের কাহিনিটা বেশ চমৎকার। তিনি যুদ্ধে বারবার পরাজিত হচ্ছিলেন। এভাবে ছয়বার পরাজিত হওয়ার পর তিনি হতাশায় ভেঙে পড়েন। অবশেষে জঙ্গলের মধ্যে একটি পাহাড়ের গুহায় আশ্রয় গ্রহণ করেন। সেখানে তিনি লক্ষ করেন, একটি মাকড়সা জাল বুনতে বারবার ব্যর্থ হচ্ছে। এভাবে ছয়বার ব্যর্থ হওয়ার পর সে সপ্তমবার সফল হয়। এটি দেখে তিনি অনুপ্রাণিত হন এবং গুহা থেকে বের হয়ে এসে সৈন্য-সামন্ত জোগাড় করে সপ্তমবার যুদ্ধ অবতীর্ণ হয়ে বিজয় লাভ করেন।

সুতরাং ডাকসু ও জাকসুতে ছাত্রদলের পরাজয় মানে সব শেষ হয়ে যাওয়া নয়। ছাত্রদল নেতাদের আত্মসমালোচনা করতে হবে। ছোটবেলায় বাম রাজনীতি করেছি, তখন এই আত্মসমালোচনার বিষয়টি গভীরভাবে উপলব্ধি করেছি। অর্থাৎ যেকোনো ব্যর্থতার পর আত্মসমালোচনা করা একটু গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে ভুলগুলো শুধরে নেওয়া যায়।

এখন ছাত্রদলের নেতাদের বুঝতে হবে, তাদের ভুলগুলো কোথায় কোথায় ছিল। আজ এ সত্যটি স্বীকার করতে হবে, আওয়ামী লীগের শাসনের পুরোনো বছরে বাংলাদেশের কোনো বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে ছাত্রদলকে অবস্থান করতে দেওয়া হয়নি। একটি ছাত্র সংগঠনের জন্য এটি বিরাট বিপর্যয়। আর এই ১৫ বছরে হাজার হাজার নতুন ছাত্র বিশ্ববিদ্যালয় ঢুকেছেন, যাদের সঙ্গে সঙ্গে ছাত্রদলের কোনো সংযোগ ঘটেনি। ফলে ছাত্রদলের পর ছাত্রের নতুন নতুন রিক্রুটমেন্টের ঘটনা ঘটেনি বছরের পর বছর ধরে।

এ রকম এক পটভূমিতে জুলায় বিপ্লবোত্তর মুক্ত পরিবেশে কী ধরনের ভূমিকা পালন করতে হবে, সে সম্পর্কে ছাত্রদলের কোনো পূর্বপরিকল্পনা ছিল না। কিংবা ঘটনার আকস্মিকতায় পূর্বপরিকল্পনার সুযোগ তারা পায়নি। কিন্তু তা না পেলেও পরে কী করতে হবে বা কী করা উচিত, তা নিয়ে ছাত্রদল নেতারা খুব একটা আলোচনা করেছেন বলে মনে হয় না। বরং এটি মনে হয়েছে, তারা নতুন প্রজন্মের এই ছাত্রদের মন-মানসিকতা উপলব্ধি করার চেষ্টা না করে, ১৫ বছর আগের স্টাইলে তৎপরতা চালিয়ে ভুল করেছিলেন। তারা এটি বুঝতেই পারেননি কিংবা বোঝার চেষ্টাও করেননি যে, ইতোমধ্যে ছাত্রশিবির নানা কভারে সাধারণ ছাত্রদের ভেতরে বিরাট জায়গা করে নিয়েছে এবং ছাত্ররাজনীতির একটা নতুন ধারা সৃষ্টি করেছে, যার সঙ্গে মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তির সংমিশ্রণ ঘটেছে।

মনে হয়েছে, ছাত্রদল নেতাকর্মীরা পরিবর্তিত পরিস্থিতিকে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে পর্যালোচনা না করে পূর্বতন ধারায় কাজ শুরু করেছিলেন। তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হচ্ছে হলগুলোয় বিশুদ্ধ পানি পানের ইস্যুটি। ছাত্রশিবির প্রতিটি হলে বিশুদ্ধ খাবার পানির জন্য ফিল্টার বসিয়েছিল। এটা ছাত্রদলের পছন্দ হয়নি। তাই তারা এগুলো ভেঙে ফেলে। কিন্তু সাধারণ ছাত্রদের তা পছন্দ হয়নি। এ ঘটানোও নির্বাচনে বিরাট প্রভাব ফেলেছে।

এসব ছাড়া জুলাই বিপ্লবের পর প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে প্রফেসর ডক্টর ইউনূসের জনপ্রিয়তা যখন আকাশচুম্বী, তখন তার বিরুদ্ধে কোনো কোনো বিএনপি নেতার নেতিবাচক মন্তব্য বিপ্লবের অংশ নেওয়া তরুণ ছাত্ররা মেনে নিতে পারেনি, যা কার্যত ছাত্রদলের ওপর গিয়ে পড়েছে। শুধু তাই নয়, যখন রাষ্ট্রের সংস্কার প্রশ্নে ছাত্র-জনতা ঐকমত্য পোষণ করছে, তখন বিএনপির কিছু নেতার বিরোধিতা করা কিংবা কারো কারো মুখ থেকে ক্ষমতায় গেলে সংস্কার বাদ দিয়ে দেব—এ ধরনের মন্তব্য ছাত্রদলের অনেক ক্ষতি করেছে।

অন্যদিকে আমার মনে হয়েছে, জুলাই বিপ্লবোত্তর পরিবেশে ছাত্রদলের প্রথম উচিত ছিল পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের মন-মানসিকতা বুঝে পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কারণ দীর্ঘ অনুপস্থিতির কারণে সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের সঙ্গে ছাত্রদলের নেতাকর্মীদের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছিল, তা নিমিষে কাছাকাছি হওয়ার মতো ছিল না। এটি উপলব্ধি করা দরকার ছিল যে বর্তমানে যে জেনারেশন জীবন বাজি রেখে আন্দোলন করেছে, তাদের অধিকাংশ জন্ম ১৯৯৮ থেকে ২০০৬-এর মধ্যে, যাদের বলা হয় জেন-জি জেনারেশন কিংবা ডিজিটাল জেনারেশন। এদের কাছে অতীত ইতিহাস এবং চলমান বিশ্ব ঘটনাবলি নখদর্পণে। যেটা শেখ হাসিনা ও তার সুবিধাভোগী দলবল বুঝতে চেষ্টা করেনি। তাই যা হওয়ার তাই হয়েছে। সুতরাং জুলাই বিপ্লবোত্তর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে ছাত্রদল নেতাদের উচিত ছিল বিক্ষুব্ধ এই তরুণসমাজের সঙ্গে মিশে গিয়ে দীর্ঘ অনুপস্থিতির ফলে সৃষ্ট শূন্যতা পূরণে উদ্যোগী হওয়া। আমার মনে হয়েছে সেটা তারা ঠিকমতো করতে পারেনি। তাই এখন ছাত্রদল তথা বিএনপির শীর্ষস্থানীয় নীতিনির্ধারকদের পুরো বিষয়টি পর্যালোচনা করে পরবর্তী রাজনৈতিক কৌশল নির্ধারণ করা উচিত।

এদিকে অনেক রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মনে করছেন, ছাত্রশিবিরের অভাবিত বিজয়ের পাশাপাশি ছাত্রদলের বিপর্যয়কর পরাজয় বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন একটি মেরূকরণের আভাস ফুটে উঠেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় পুরোনো ধাঁচের ছাত্ররাজনীতির পরিবর্তে ইতিবাচক এমন এক রাজনীতির সূচনা হতে যাচ্ছে, যেখানে ক্যাডারভিত্তিক পেশিশক্তির স্থলে মেধা ও বুদ্ধিবৃত্তিক এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য লাভ করছে। সেই সঙ্গে ফ্যাসিবাদী শাসনের ধ্বংসস্তূপের ওপর গণতন্ত্রের বিজয় কেতন ওড়ানোর যাত্রা শুরু হয়েছে। যদিও এপথ এখনো বন্ধুর। বরং প্রচলিত পুরোনো পন্থা বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে বারবার।

পরিশেষে পৃথিবী বিখ্যাত সুফি সাধক মাওলানা রুমির একটা উক্তি দিয়ে লেখাটি শেষ করছি। তিনি বলেছেন, ‘তোমার কথা হোক অর্থবহ, চিৎকারে নয়, ফুল তো বৃষ্টিতে ফোটে, বজ্রের গর্জনে নয়’।

লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক

Source: https://www.dailyamardesh.com/op-ed/amdkgeyrnvk9k

Exit mobile version