দেশে মার্কিন ডলারের সংকটের মধ্যেই আরও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির চুক্তি করছে সরকার। গত বছরের জুন ও নভেম্বরে তিনটি চুক্তি হয়েছে। আরেকটি চুক্তি শিগগিরই হতে পারে।
চারটি চুক্তির অধীনে ২০২৬ সালের জুন থেকে আমদানি করা এলএনজি সরবরাহের কথা দিনে ১৭০ কোটি ঘনফুট। এখন সক্ষমতা রয়েছে ১১০ কোটি ঘনফুট। তবে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ সরবরাহ করা হয়েছে দিনে ৯০ কোটি ঘনফুটের কম।
বাড়তি গ্যাস তরল অবস্থায় এনে তা রূপান্তরের জন্য নতুন টার্মিনাল নির্মাণ করতে হবে, যার কাজ শুরু হয়নি। বাড়তি গ্যাস সরবরাহের জন্য নতুন পাইপলাইন দরকার। সেই প্রকল্পে অর্থায়নও নিশ্চিত হয়নি।
ডলার–সংকটের কারণে বাড়তি গ্যাস আমদানি করতে না পারায় সরকার দেশে উত্তোলনে জোর দিয়েছে। এমন সময়ে কেন দীর্ঘমেয়াদি আমদানি চুক্তি এবং চুক্তি অনুযায়ী গ্যাস আনতে ডলার কোথা থেকে আসবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, চুক্তি অনুযায়ী আমদানিতে ব্যর্থ হলে বিদ্যুৎ খাতের কেন্দ্রভাড়া বা ক্যাপাসিটি চার্জের মতো মাশুল দিতে হতে পারে।
বাংলাদেশ তেল, গ্যাস ও খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, নতুন বছর শুরুর আগে কতটুকু গ্যাস আমদানি করা হবে, তা জানালে চুক্তির ন্যূনতম পরিমাণের চেয়ে ১০ শতাংশ গ্যাস কম আনার সুযোগ রয়েছে। এ ছাড়া সূচি অনুসারে কোনো চালান আমদানির সিদ্ধান্ত দুই মাস আগে বাতিল করলে তা অন্য জায়গায় বিক্রি করে দেয় সরবরাহকারীরা। এ ক্ষেত্রে চুক্তির দামের চেয়ে কম দামে বিক্রি হলে জরিমানা দিতে হয়। এই শর্তটিও সর্বোচ্চ ১০ শতাংশের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা যায়।
পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার প্রথম আলোকে বলেন, গ্যাসের চাহিদা মেটাতে সক্ষমতা বুঝেই আমদানির পরিকল্পনা করা হচ্ছে। সক্ষমতায় যতটুকু ঘাটতি মনে হচ্ছে, তা ২০২৬ সালের মধ্যে পূরণ করার জন্য ইতিমধ্যেই নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, চুক্তি অনুযায়ী এলএনজি না কিনে জরিমানা পরিশোধের পরিস্থিতি তৈরি হবে না।
অবশ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎ খাতেও একই ধরনের বক্তব্য দেওয়া হয়েছিল। এখন চাহিদার তুলনায় অনেক বেশি উৎপাদন সক্ষমতা তৈরি করে বছরে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকা কেন্দ্রভাড়া দিতে হচ্ছে, যা পুরো অর্থনীতিতেই সমস্যা তৈরি করছে।
নতুন চার চুক্তি
দেশে এখন দিনে গ্যাসের চাহিদা ৩৮০ কোটি ঘনফুট। সরবরাহ করা হয় ২৫০ থেকে ৩০০ কোটি ঘনফুটের মতো। গ্যাসের চাহিদা পূরণ করতে ২০১৮ সালে আমদানি শুরু হয়। বিদেশ থেকে গ্যাস দুইভাবে কেনা হয়। একটি হলো দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি, যার মাধ্যমে গ্যাস আসে কাতার ও ওমান থেকে। অন্যটি খোলাবাজার থেকে কেনা, যেখানে গ্যাসের দামে ব্যাপক ওঠা–নামা হয়। আমদানি করা গ্যাসের ৭০ শতাংশের মতো আসে দীর্ঘমেয়াদি চুক্তি থেকে।
নতুন করে কাতার ও ওমানের কাছ থেকে গ্যাস আনার ১৫ বছর মেয়াদি দুটি চুক্তি হয় গত বছরের জুনে। মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে গত নভেম্বরে ১৫ বছর মেয়াদি একটি চুক্তি করা হয়েছে। দেশীয় ব্যবসায়ী গোষ্ঠী সামিট গ্রুপের সঙ্গেও শিগগিরই একটি চুক্তি হবে। এটিও হবে ১৫ বছর মেয়াদে। চারটি চুক্তিতেই গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে ২০২৬ সালে।
শুরু হয়নি টার্মিনালের কাজ
কক্সবাজারের মহেশখালীর গভীর সমুদ্রে এখন দুটি ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল আছে। একটি এক্সিলারেট এনার্জির, অন্যটি সামিটের।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, বাড়তি গ্যাস সরবরাহের জন্য সামিট মহেশখালীতে ৫০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণ করবে। শিগগিরই এটির চুক্তি হবে। চালু করার কথা ২০২৬ সালের জুনের আগে। সামিট নিজেদের বর্তমান টার্মিনালের সক্ষমতাও ১০ কোটি ঘনফুট বাড়াবে। সব মিলিয়ে তিন টার্মিনাল থেকে দিনে ১৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের সক্ষমতা তৈরি হবে আড়াই বছর পর।
এর বাইরে পটুয়াখালীর পায়রায় ৫০ কোটি ঘনফুট ও মহেশখালীর মাতারবাড়ীতে স্থলভাগে ১০০ কোটি ঘনফুট সক্ষমতার দুটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে চায় সরকার। জ্বালানি বিভাগ সূত্র জানিয়েছে, পায়রায় টার্মিনাল নির্মাণে এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে কয়েক মাসের মধ্যে চুক্তি হতে পারে। মাতারবাড়ীরটির সম্ভাব্যতা যাচাই চলছে।
পেট্রোবাংলার প্রক্ষেপণ বলছে, ২০২৬ সালের জুনের পর দেশে দিনে গ্যাসের চাহিদা হবে ৪৫০ কোটি ঘনফুট। সরকার তখন থেকে নিরবচ্ছিন্ন গ্যাস সরবরাহ করতে চায়।
এদিকে প্রথমবারের মতো এলএনজি আমদানির জন্য ঋণ নেওয়া হচ্ছে। আগামী অর্থবছরে (২০২৪-২৫) জন্য ৫০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে ইসলামিক ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের (আইডিবি) সহযোগী সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইটিএফসি)। বিষয়টি নিয়ে সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, এই ঋণ কী শর্তে নেওয়া হয়েছে, তা এখনো প্রকাশ করা হয়নি। তবে শোনা যাচ্ছে সুদের হার হবে সিকিউরড ওভারনাইট ফিন্যান্সিং রেটের (সোফর) সঙ্গে ২ শতাংশ। মানে হলো, বর্তমান হারে তা ৭ দশমিক ৪ শতাংশ পড়তে পারে। এই ঋণ খুব অল্প সময়ে পরিশোধ করতে হবে। এর বিপরীতে বৈদেশিক মুদ্রার মজুতও রাখতে হবে।
পাইপলাইন সরু
মহেশখালী থেকে এলএনজি আনার জন্য দুটি সমান্তরাল পাইপলাইন আছে গ্যাস ট্রান্সমিশন অ্যান্ড ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানি লিমিটেডের (জিটিসিএল)। পাইপলাইন দুটি এসেছে চট্টগ্রামের আনোয়ারায়। এর মধ্যে ৩০ ইঞ্চির পাইপলাইন দিয়ে সর্বোচ্চ ৫০ কোটি ও ৪২ ইঞ্চির পাইপলাইন দিয়ে সর্বোচ্চ ১২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস সরবরাহ করা যাবে।
অবশ্য আনোয়ারা স্টেশন থেকে পরবর্তী পাইপলাইন সরু, অর্থাৎ ব্যাস কম। সেখান থেকে ৩৬ ইঞ্চি ও ২৪ ইঞ্চির দুটি পাইপলাইন মিলে জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ করা যাবে দিনে সর্বোচ্চ ১১০ কোটি ঘনফুট গ্যাস। মানে হলো, মহেশখালী থেকে ১৭০ কোটি ঘনফুট সরবরাহের সক্ষমতা থাকলেও জাতীয় গ্রিডে ১১০ কোটি ঘনফুটের বেশি পৌঁছানো সম্ভব নয়।
পেট্রোবাংলা বলছে, চট্টগ্রামে গ্যাসের চাহিদা বাড়বে। বাকি যে গ্যাস থাকবে, তা অন্য জেলায় নিতে পাইপলাইন তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
জিটিসিএল দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, মহেশখালী থেকে কুমিল্লার বাখরাবাদ পর্যন্ত তৃতীয় সমান্তরাল পাইপলাইন নির্মাণের পরিকল্পনা নিয়েছে তারা। সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের জন্য ঠিকাদার নিয়োগ করা হচ্ছে। এরপর জমি অধিগ্রহণ করা হবে, অর্থায়ন লাগবে। সব মিলিয়ে এ বছর প্রকল্প চূড়ান্ত হলেও কাজ শেষ করতে অন্তত পাঁচ বছর লাগতে পারে।
পেট্রোবাংলার দায়িত্বশীল সূত্র বলছে, টার্মিনাল স্থাপনের সঙ্গে সময় মিলিয়ে পায়রা-বরিশাল-খুলনা-গোপালগঞ্জ পাইপলাইনটি নির্মাণ করে দেবে এক্সিলারেট এনার্জি। এ ছাড়া মাতারবাড়ী স্থল টার্মিনালের সঙ্গে যুক্ত করে ২০৩১ সালের মধ্যে ৫২ ইঞ্চি ব্যাসের একটি পাইপলাইন ঢাকায় আনার পরিকল্পনা আছে জিটিসিএলের।
ভূতত্ত্ববিদ বদরূল ইমাম প্রথম আলোকে বলেন, আমদানিনির্ভরতা কমিয়ে দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান ও উৎপাদনে জোর দেওয়া উচিত। কারণ, ডলারের অনিশ্চয়তা আছেই।
বড় সমস্যা ডলার
বাড়তি এলএনজি আমদানি করে সরকার কারখানায় সরবরাহের পাশাপাশি বিদ্যুৎকেন্দ্রে দেওয়ার পরিকল্পনা করছে। পাঁচটি এলএনজিভিত্তিক বড় বিদ্যুৎকেন্দ্রের কাজ প্রায় শেষের দিকে। গত মাসেই একটির উৎপাদন শুরুর কথা ছিল। তবে গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত হয়নি।
বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে জানা গেছে, নতুন তিনটি এলএনজি চালিত বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে সম্মতি সনদ প্রদান করা হয়েছে। আরও ৯টি এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা আছে সরকারের।
প্রশ্ন হলো গ্যাস আমদানির জন্য এত ডলার কোথায় পাওয়া যাবে। বিগত দুই অর্থবছরে গ্যাস আমদানি ও টার্মিনালভাড়া বাবদ প্রতিবছর প্রায় ৪০০ কোটি ডলার করে লেগেছে। ডলার–সংকটে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের পাওনা যথাসময়ে দিতে পারছে না সরকার।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৭ ফেব্রুয়ারি কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভ ছিল ২ হাজার ৫০৮ কোটি ডলার। তবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাবপদ্ধতি বিপিএম ৬ অনুযায়ী রিজার্ভ আছে ১ হাজার ৯৯৫ কোটি ডলার। ২০২১ সালের আগস্ট মাসে যা ছিল ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলারের বেশি।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জ্বালানি আমদানির পাশাপাশি আগামী বছরগুলোতে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপও বাড়বে। কিন্তু রপ্তানি ও প্রবাসী আয় উল্লেখযোগ্য হারে বাড়বে কি না, সেই সংশয় রয়েছে।
সার্বিক বিষয়ে সিপিডির গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, দেশের গ্যাসের চাহিদা ও সরবরাহের ঘাটতি বিবেচনায় আমদানির যুক্তি সব সময়ই দেখানো যাবে। দেখতে হবে দেশীয় উৎস থেকে সরবরাহ বাড়াতে কী উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, এর ফলে কতটা গ্যাস পাওয়া যাবে এবং এরপর কতটা আমদানি করা হবে। তিনি বলেন, বর্তমান অর্থনৈতিক বাস্তবতায় গ্যাসের জন্য আমদানিনির্ভর হওয়া বিপজ্জনক হবে।
প্রথম আলো