খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, নানা উপায়ে আমদানি কমানো এবং রপ্তানি ও রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির পরও বৈদেশিক মুদ্রাবাজারে সংকটের বড় কারণ ঋণ পরিশোধের চাপ। নানা কারণে এখন বেসরকারি খাতে বিদেশি ঋণ আসছে কম। বিশেষ করে মূল্যস্ফীতি কমাতে যুক্তরাষ্ট্রসহ উন্নত বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ সুদহার অনেক বাড়িয়েছে। ফলে এসব দেশে ডলার চলে গেছে। আবার অনেক উদ্যোক্তা এখন ঋণ নিতে চাইছেন না। কেননা বছর দুয়েক আগে ২ থেকে ৩ শতাংশ সুদে বিদেশি ঋণ পাওয়া যেত। গত দুই বছরে সুদহার অনেক বেড়ে এখন ৯ শতাংশের ওপরে উঠেছে। এ সময় ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন হয়েছে ৩০ শতাংশের মতো। আগামীতে ডলারের দর বা সুদহার কোথায় গিয়ে ঠেকবে, তা কেউ জানে না। যে কারণে অনেকে ঋণ নিতে চাইছেন না। এতে স্বল্পমেয়াদি ঋণ পরিশোধ দ্রুত হওয়া ও নতুন ঋণ না পাওয়ায় সার্বিকভাবে বিদেশি ঋণ এত বেশি কমেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সালে বাংলাদেশ স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পেয়েছে ২৫ দশমিক ৮০ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে মূল পরিশোধ হয় ৩০ দশমিক ৫০ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ গত বছর নিট স্বল্পমেয়াদি ঋণ শোধ করা হয়েছে চার দশমিক ৭ বিলিয়ন ডলার। আর ২০২২ সালে ঋণ পেয়েছিল ৩৭ দশমিক ২৫ বিলিয়ন ডলার। একই সময়ে পরিশোধ করা হয়েছিল ৩৬ দশমিক ৪৮ ডলার। অর্থাৎ ওই বছর বিদেশি ঋণ ৭৭০ মিলিয়ন ডলার স্থিতির সঙ্গে যোগ হয়। ২০২৩ সালে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপে ডলার সংকট আরও গভীর হয় বলে জানায় সংশ্লিষ্টরা।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলেন, গত বছর দেশের রিজার্ভের বড় পতন হয়েছে। এর অন্যতম কারণ, স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ আগের তুলনায় পরিশোধের চাপ বেশি ছিল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ী, দুই মাস পর আবারও রিজার্ভ কমে ২০ বিলিয়ন ডলারের নিচে নেমেছে। গত বুধবার শেষে রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ১৯ দশমিক ৯৪ বিলিয়ন ডলারে। আগের দিন ছিল ২০ বিলিয়নের ওপরে।
গত বছর রেকর্ড পরিমাণ বেসরকারি খাতে স্বল্পমেয়াদি বিদেশি ঋণ কমার ফলে এ খাতের ঋণের স্থিতিও কমেছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২৩ সাল শেষে স্থিতি কমে দাঁড়িয়েছে ১১ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। ২০২২ সালে স্থিতি ছিল ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে স্থিতি কমেছে ৪ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার।
তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৮ সালে স্থিতি ছিল ৭ দশমিক ২৮ বিলিয়ন ডলার। পরের বছর তা বেড়ে হয় ৮ দশমিক ২১ বিলিয়ন ডলার। ২০২০ সালে তা আরও বেড়ে হয় ৯ দশমিক ১৩ বিলিয়ন। পরের বছর এক লাফে ৬ দশমিক ৩৩ বিলিয়ন বেড়ে স্থিতি দাঁড়ায় ১৫ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে। ২০২২ সালে প্রায় এক বিলিয়ন ডলারের মতো বেড়ে স্থিতি হয় ১৬ দশমিক ৪১ বিলিয়ন। অর্থাৎ ছয় বছরের মধ্যে গত বছর শুধু বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের স্থিতি কমেছে। বাকি পাঁচ বছরেই বেড়েছিল।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান শেয়ার বিজকে বলেন, বিদেশি ঋণের সুদহার অনেক বেড়ে গেছে। আগে যেখানে লাইবর ১
শতাংশ ছিল, সেটা এখন বেড়ে পাঁচ থেকে ছয় শতাংশ হয়ে গেছে। এতে উচ্চ রেটে উদ্যোক্তারা ঋণ আনতে চাচ্ছে না। তাই বিদেশি নতুন ঋণ আসছে না।
তিনি আরও বলেন, ডলারের এখনও অস্থিরতা কাটেনি। গত এক বছরে ডলারের বিপরীতে ৩০ শতাংশ টাকার দরপতন হয়েছে। এ অস্থিরতার কারণে ঋণ পরিশোধে বেশি মনোযোগী। ঋণ নেয়ায় আগ্রহ নেই। ফলে পরিশোধ হয়েছে বেশি। নতুন ঋণ এসেছে কম।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ম অনুযায়ী, বৈদেশিক ঋণের জন্য সর্বোচ্চ সিকিউরড ওভারনাইট ফাইন্যান্সিং রেটসহ (এসওএফআর) সাড়ে ৩ শতাংশ সুদ দিতে হবে। তবে এখন তা বাড়িয়ে ৪ শতাংশে করা হয়েছে। বর্তমানে এসওএফআর ৫ শতাংশের ওপরে দাঁড়িয়েছে, যা এক সময়ে ছিল ১ শতাংশেরও কম।
এদিকে গত বছর ঋণ পরিশোধ বেশি হওয়ার পাশাপাশি সুদ পরিশোধও বেড়েছে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, গত বছর সুদ পরিশোধ হয় ৬৫৪ মিলিয়ন ডলার। আগের বছর সুদ পরিশোধের পরিমাণ ছিল ২৪৬ মিলিয়ন ডলার। অর্থাৎ এক বছরে সুদ পরিশোধ বেড়েছে ৪০৮ মিলিয়ন ডলার।
খাতসংশ্লিষ্টরা জানান, বেসরকারি খাতে ঋণের সুদ পরিশোধ আগের তুলনায় বাড়তে পারে মূলত আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সুদহার বৃদ্ধির কারণে। এছাড়া আগের অনেক সুদ সময়মতো পরিশোধ করতে পারেননি ব্যবসায়ীরা। ওই সুদ পরিশোধের জন্য সময় নেয়া হয়েছিল। সেই সময় শেষ হওয়ার কারণে সুদ পরিশোধ করে দিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। সে কারণেও আগের তুলনায় সুদ পরিশোধ বাড়তে পারে।
share biz