- মাসুম খলিলী
- ১১ এপ্রিল ২০২৩, ২০:১৫, আপডেট: ১২ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:০৯
ডলারের আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করতে বিশ্বব্যাপী নানা আয়োজন চলছে। অনেক দেশই আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা ব্যবহারের চুক্তি করছে। রিজার্ভ সংরক্ষণে বিকল্প মুদ্রার দিকে ঝুঁকছে অনেক দেশ। এতে কি শেষ পর্যন্ত ডলারের আধিপত্য কমবে? এ নিয়ে বিশেষজ্ঞদের নানা মত রয়েছে। আর আমেরিকান ডলার ও পশ্চিমা নিয়ন্ত্রণে চালিত অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ করে বাংলাদেশের মতো দেশের অর্থনীতি টিকতে পারবে নাকি অধিকতর চ্যালেঞ্জে পড়বে সেটিও বড় প্রশ্ন।
সামগ্রিক বৈশ্বিক প্রবণতার পাশাপাশি বাংলাদেশ যে ডলার পরিহার করে বাণিজ্য করার চিন্তা করছে তাতে সরকারের নিজস্ব ভাবনার অগ্রাধিকার রয়েছে। সরকার কার্যকর নির্বাচনের ব্যাপারে পশ্চিমা চাপ এড়িয়ে নিজের মতো করে নির্বাচন করতে চায়। এটি করতে গিয়ে যদি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার মতো পরিস্থিতিতে পড়তে হয় তাহলে করণীয় কী? এ প্রশ্ন সামনে রেখেই সম্প্রতি জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্য করার উদ্যোগ আয়োজন বেড়েছে। এ ক্ষেত্রে বিকল্প মুদ্রায় বাণিজ্যের প্রস্তাব ও চাপ আসছে প্রধানত ভারত, চীন ও রাশিয়া থেকে।
ডলার পরিহারে বৈশ্বিক আয়োজন
ডলারের ওপর নির্ভরতা কমানো এবং দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করা বেশ কয়েকটি দেশের লক্ষ্য। গত কয়েক বছর ধরে এসব দেশ মার্কিন ডলারকে পাশ কাটিয়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে তাদের নিজস্ব স্থানীয় মুদ্রা ব্যবহারের চেষ্টা করছে। ব্রাজিল ও জাপান, সম্প্রতি তাদের দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা বাণিজ্য সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই আয়োজনে যোগ দিয়েছে। ব্রাজিল এবং চীন নিজেদের মুদ্রায় বাণিজ্য করার চুক্তি করেছে। সৌদি আরবও চীনের সাথে সৌদি রিয়াল এবং চীনা ইউয়ানে বাণিজ্য করার কথা ভাবছে। ডলারের বৈশ্বিক মুদ্রা হয়ে ওঠার পেছনে বিশেষভাবে কার্যকর ছিল মধ্যপ্রাচ্যের তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোর কেবল ডলারেই তেল বিক্রির নীতি। অনেক বিশ্লেষকের মতে, দ্বিপক্ষীয় মুদ্রায় জ্বালানি বিক্রির উদ্যোগ কার্যকর হলে তা ডলারের অধিপত্যে প্রভাব ফেলবে।
মার্কিন ডলার এক দশক আগে থেকেই প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হতে শুরু করে। ২০১১ সালে জাপান এবং চীন মার্কিন ডলারের পরিবর্তে তাদের নিজ নিজ মুদ্রায় বাণিজ্য করতে সম্মত হয়। একইভাবে, ব্রাজিল ২০১৩ সালে চীনের সাথে বাণিজ্যে ডলার বর্জনের প্রথম চুক্তি স্বাক্ষর করে। পরে ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন এবং দক্ষিণ আফ্রিকার জোট-ব্রিকস সম্মেলনের প্রধান বিষয় হয়ে ওঠে সদস্য রাষ্ট্রগুলোর মধ্যে জাতীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের একটি প্রক্রিয়া তৈরি করা। এতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষে ১৯৪৪ সাল থেকে ব্রেটন উডস চুক্তির মাধ্যমে ব্রিটিশ স্টার্লিংকে প্রতিস্থাপন করে মার্কিন ডলার যে বিশ্বের রিজার্ভ মুদ্রায় পরিণত হয় সেটি থেকে কিছুটা হলেও বের হয়ে আসার অবকাশ তৈরি হবে বলে মনে করা হয়।
ডলারকে অস্ত্র হিসাবে ব্যবহারের আমেরিকান প্রবণতার কারণে প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলো বিকল্প ব্যবস্থা দিতে ঝুঁকছে। ডলারের রিজার্ভ কারেন্সি স্ট্যাটাসের কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের যেকোনো দেশের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারে এবং তাদের ওপর ব্যাপক অর্থনৈতিক ব্যয় চাপিয়ে দিতে পারে। যারা এই নিষেধাজ্ঞার মুখে পড়ছে তারা বিকল্প উপায় বের করতে উদ্যোগী হচ্ছে। এতে করে মার্কিন ডলার গত দুই দশকে বাজার অংশীদারিত্বের ১৩ শতাংশের বেশি পয়েন্ট হারিয়েছে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুসারে, দুই দশক আগের ৭১ শতাংশ থেকে ২০২২ সালে ৫৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে ডলারের বাজার শেয়ার।
পারমাণবিক প্রকল্পের জন্য পশ্চিমা নেতৃত্বাধীন আন্তর্জাতিক অর্থ স্থানান্তর ব্যবস্থা সুইফট থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার পর ইরান বহু বছর ধরে বিকল্প অর্থপ্রদানের মাধ্যমে বাণিজ্য করছে। ইউক্রেন দ্ব›দ্ব রাশিয়া ও চীনের জন্য স্থানীয় মুদ্রায় দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বৃদ্ধির সুযোগ তৈরি করে। তারা মার্কিন নেতৃত্বাধীন আর্থিক ব্যবস্থা থেকে অন্যান্য দেশকে দূরে সরিয়ে নেয়ার চেষ্টাও করছে। এখন পর্যন্ত অন্তত ২০টি দেশ নিজস্ব মুদ্রায় পরস্পরের সাথে বাণিজ্য করার পথ বেছে নিয়েছে।
ব্লুমবার্গের গত ফেব্রুয়ারির তথ্য অনুসারে, চীনের ইউয়ান রাশিয়ায় মাসিক লেনদেনের পরিমাণে প্রথমবারের মতো ডলারকে ছাড়িয়ে গেছে। মার্কিন সরকার কর্তৃক পুঞ্জীভূত ঋণও বাজারগুলোকে বড় আর্থিক বিঘ্নের ঝুঁকিতে ফেলেছে। এর ফলে, অনেক দেশ অর্থনীতিকে আরো ক্ষতি থেকে রক্ষা করতে ‘ডি-ডলারাইজেশন’ এর পথ নিয়েছে। ফেব্রুয়ারি ২০২৩ পর্যন্ত ফেডারেল সরকার একই অর্থবছরে রাজস্ব আয়ের চেয়ে ৭২৩ বিলিয়ন ডলার বেশি অর্থ ব্যয় করেছে, যা দেশটিকে আরো গভীরে জাতীয় ঘাটতির দিকে ঠেলে দিয়েছে। এখন মার্কিন জাতীয় ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৩১.৪৬ ট্রিলিয়ন ডলার যা দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ এবং গত দুই দশকের তুলনায় পাঁচগুণ।
সম্ভাব্য বিকল্প মুদ্রা
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের তথ্য অনুসারে, বিশ্বের অনেক দেশ নিজস্ব মুদ্রা শক্তিশালী করার বিকল্প উপায় খুঁজছে, যার ফলে ডলার তার আধিপত্য হারাচ্ছে। চীনের ইউয়ানকে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সম্ভাব্য মুদ্রা হিসাবে দেখা হয়। চীন বিভিন্ন ক্ষেত্রে মার্কিন আধিপত্যকে চ্যালেঞ্জ করছে। কিন্তু, চীনের অর্থনৈতিক ব্যবস্থা অবাধ নয়, ফলে বিদেশী বিনিয়োগকারীদের সে দেশের বাজারে প্রবেশ করা কঠিন।
ইউরোপীয় ইউনিয়নের মুদ্রা ইউরোকেও মুক্তবাজারের বিকল্প হিসেবে দেখানো হচ্ছে। ভিজ্যুয়াল ক্যাপিটালিস্টের মতে, ব্লকটি বিশ্বের তৃতীয় বৃহত্তম অর্থনীতি এবং এর অংশীদারিত্বে রয়েছে বিশ্ব বাণিজ্যের এক-ষষ্ঠাংশ। ইউরো বিশ্বের দ্বিতীয় সর্বাধিক ব্যবসায়িক মুদ্রা হবার পরও ইউরোজোনে ঋণ সঙ্কটের কারণে এটির রিজার্ভ মুদ্রা হওয়ার ক্ষমতা নিয়ে অনেকের সন্দেহ রয়েছে।
জাপানি ইয়েন আরেকটি বিকল্প। তবে ইউএস ডলার এবং ইউরোর পর ফরেক্স মার্কেটে তৃতীয় বৃহত্তম ট্রেড করা মুদ্রা হিসাবে, জাপানের ভারী পাবলিক ঋণের কারণে মার্কিন ডলার এবং ইউরোর সাথে প্রতিযোগিতা করার সময় জাপানি ইয়েন হোঁচট খেতে পারে। এসব কারণে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এখনো বিশ্বাস করে যে ডলার অদম্য এবং এটি আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের প্রধান মুদ্রা হয়ে থাকবে। ডলারের ‘মৃত্যুর’ গুজবকেও অতিরঞ্জিত বলে মনে করা হয়। যেখানে বেশির ভাগ মুদ্রা শুধু অভ্যন্তরীণভাবে বা আন্তঃসীমান্ত লেনদেনে ব্যবহৃত হয়, সেখানে ডলারের ব্যাপকভাবে অর্থায়ন, মূল্য নির্ধারণ, ট্রেড ইনভয়েসিং ও নিষ্পত্তির জন্য এবং ক্রস-বর্ডার লোনিং ও ধার দেয়ার জন্য ব্যবহার অব্যাহত রয়েছে।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১২ ট্রিলিয়ন ডলার বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে ডলারের অংশ ১৯৯৯ সাল থেকে প্রকৃতপক্ষে হ্রাস পেয়েছে। এর পরও এটি ইউরো, ইয়েন, পাউন্ড এবং ইউয়ানের মিলিত পরিমাণের প্রায় দ্বিগুণ। বৈশ্বিক মুদ্রা হবার জন্য এর নিকটতম প্রতিদ্ব›দ্বী, ইউরো, ডলারের ৫৮ শতাংশের তুলনায় কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের মাত্র ২০ শতাংশ, তার পরে রয়েছে জাপানি ইয়েন ৫ শতাংশ। বহুল আলোচিত চীনা ইউয়ান বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ৩ শতাংশের নিচে।
এমনকি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে তীব্র ভূ-রাজনৈতিক প্রতিযোগিতার পরিবেশে চীনের জন্য ডলার-নির্ধারিত সম্পদ সংগ্রহ করা চালিয়ে যাওয়ার বিকল্প নেই। এর কারণ ডলার নিজস্ব ক্ষমতার বলেই শক্তিশালী। ডলারের সহজাত কিছু বৈশিষ্ট্য রয়েছে : এটি অনেকটাই স্থিতিশীল, তরল, নিরাপদ এবং পরিবর্তনযোগ্য। আর মার্কিন আর্থিক বাজারগুলো এখন পর্যন্ত বিশ্বের বৃহত্তম, গভীরতম এবং সবচেয়ে তরল, যা প্রচুর আকর্ষণীয়। অন্য কোনো বাজার বিনিয়োগকারীদের জন্য এর কাছাকাছিও নেই।
শেষ পর্যন্ত, বিনিয়োগকারীরা ডলারের সম্পদ ধরে রাখতে চায় কারণ আমেরিকার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং প্রাতিষ্ঠানিক মৌলিক বিষয়গুলো বিশ্বাসযোগ্যতা এবং আত্মবিশ্বাসকে অনুপ্রাণিত করে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের রয়েছে বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিশালী সামরিক বাহিনী, সেরা গবেষণা বিশ্ববিদ্যালয়, সবচেয়ে গতিশীল এবং উদ্ভাবনী বেসরকারি খাত। এর রয়েছে, বাণিজ্য এবং মূলধন প্রবাহের জন্য একটি সাধারণ উন্মুক্ততা, অপেক্ষাকৃত স্থিতিশীল শাসক প্রতিষ্ঠান, একটি স্বাধীন কেন্দ্রীয় ব্যাংক, সুষ্ঠু সামষ্টিক অর্থনৈতিক নীতি, শক্তিশালী সম্পত্তির অধিকার এবং একটি আইনের শক্তিশালী শাসন। সারা বিশ্বের মানুষ মার্কিন সরকারকে তাদের সম্পদের মূল্য রক্ষা করতে এবং তাদের উপর তাদের অধিকারকে সম্মান করার জন্য এখনো বিশ্বাস করে, যা ডলারকে নিরাপদ মুদ্রা এবং মার্কিন সরকারের বন্ডকে বিশ্বের নিরাপদ সম্পদে পরিণত করে।
ডলার যতই তার উজ্জ্বলতা হারাচ্ছে বলে মনে হোক না কেন, বৈশ্বিক মুদ্রার একটি কার্যকর চ্যালেঞ্জার ছাড়া আমেরিকান ডলার শিগগিরই তার বিশেষ ভূমিকা হারাবে বলে মনে হয় না।
বাংলাদেশ কি ডলার পরিহার বলয়ে যাচ্ছে
বাংলাদেশের বর্তমান সরকারের সাথে আগামী নির্বাচন, মানবাধিকার চর্চা এবং ইন্দো-প্যাসিফিক কৌশল নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্কের টানাপড়েন চলছে। এক বছরের বেশি সময় আগে এলিট ফোর্স র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। আরো নিষেধাজ্ঞা আসার গুঞ্জন রয়েছে। এই অবস্থায় সরকার যুক্তরাষ্ট্রের বিকল্প কোনো ব্যবস্থার দিকে ঝুঁকছে বলে মনে হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রীর অর্থনীতিবিষয়ক উপদেষ্টা মসিউর রহমান গত মাসের মাঝামাঝি বলেছেন, ভারত ও বাংলাদেশ তাদের মধ্যকার দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য স্থানীয় মুদ্রায় করতে পারে। এতে দুই দেশই বাণিজ্যে সুবিধা পাবে। ঢাকা চেম্বার ও ঢাকায় ভারতীয় দূতাবাস আয়োজিত এক সেমিনারে ড. মসিউর রহমান এ কথা বলেন। তবে তার আগে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় বাংলাদেশকে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ডলারের পরিবর্তে রুপি ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছিল ভারত। গত বছরের মাঝামাঝি সময়ে এ প্রস্তাব দেয় ভারত। এরপর বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক প্রস্তাব চাওয়া হয়। এ নিয়ে উভয় পক্ষের মধ্যে কথাবার্তা এখনো চলছে।
এ নিয়ে বিশেষ আলোচনা শুরু হয় ভারতের শীর্ষ ঋণদাতা স্টেট ব্যাংক অব ইন্ডিয়া রফতানিকারকদেরকে বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে ডলার এবং অন্যান্য প্রধান মুদ্রায় লেনদেন এড়িয়ে চলার প্রস্তাব দেয়ার পর। রফতানিকারকদের রুপি ও টাকায় লেনদেনের আহ্বান জানায় ব্যাংকটি। সংশ্লিষ্ট নথি ও সূত্রের বরাত দিয়ে এ তথ্য জানিয়েছিল বার্তা সংস্থা রয়টার্স। এ খবর এমন সময় প্রকাশ হয় যখন ভারত সরকারও বিভিন্ন দেশের সঙ্গে রুপিতে লেনদেনের বিষয়টি সক্রিয় বিবেচনায় নিতে শুরু করে। নয়াদিল্লিতে এক অনুষ্ঠানে দেশটির অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারমন জানান, বিশ্বের অনেক দেশ ভারতের সঙ্গে রুপিতে বাণিজ্য করতে আগ্রহী। এটি সম্ভবও। এ বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার সংশ্লিষ্ট প্ল্যাটফর্মগুলোকে সক্রিয় করছে বলেও জানান তিনি।
বাংলাদেশ ব্যাংক অবশ্য রফতানি ও আমদানির বিল নিষ্পত্তির জন্য মুদ্রা তালিকাভুক্ত করেনি বলে ব্যবসাগুলো ভারতের সাথে বাণিজ্যের জন্য ভারতীয় রুপি ব্যবহার করতে পারবে না। স্থানীয় ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলোকে রুপি ও টাকা ব্যবহার করে লেটার অব ক্রেডিট (এলসি) নিষ্পত্তি করার অনুমতি দেয়ার জন্য বাংলাদেশ ও ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক উভয়েরই একই ধরনের নির্দেশ জারি করতে হবে। বর্তমানে, স্থানীয় ব্যবসায়গুলো রফতানি এবং আমদানি নিষ্পত্তি করতে আটটি বিদেশী মুদ্রা ব্যবহার করে : মার্কিন ডলার, কানাডিয়ান ডলার, অস্ট্রেলিয়ান ডলার, সিঙ্গাপুর ডলার, ইউরো, ব্রিটিশ পাউন্ড, সুইস ফ্রাঙ্ক এবং চীনা ইউয়ান।
ভারতের সাথে দ্বিপক্ষীয় মুদ্রায় বাণিজ্যের জন্য দুই দেশের বাণিজ্যের অবস্থা বিবেচনা করা দরকার। ২০২১-২২ অর্থবছরে বাংলাদেশের জন্য আমদানির দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস ছিল ভারত। এ সময় ১৬.১৯ বিলিয়ন ডলারের শিল্প কাঁচামাল, মূলধনী যন্ত্রপাতি, তুলা, সুতা, কাপড় এবং রাসায়নিক আমদানি করা হয় ভারত থেকে। বাংলাদেশ একই বছর প্রতিবেশী দেশে ২ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি করে। দুই দেশের বাণিজ্যে বাংলাদেশের রফতানির পরিমাণ যেহেতু কম, তাই রুপি ও টাকার লেনদেনে ভারত লাভবান হলেও বাংলাদেশ চাপে থাকবে বলে মত বিশেষজ্ঞদের। বিপুল পরিমাণ বাণিজ্য ঘাটতির কারণে বাংলাদেশ যদি ভারতের সাথে রুপি-টাকায় লেনদেনে যায়, তাহলে সেটা একপক্ষীয় মুদ্রা বা রুপিভিত্তিক বিনিময় কাঠামোয় উপনীত হতে পারে এবং বাংলাদেশের ওপর অধিক হারে ভারতীয় মুদ্রা ব্যবহারের চাপ তৈরি হবে বলে আশঙ্কা করছেন ব্যবসায়ীরা।
ডলারের মতো রুপি-টাকার আন্তর্জাতিক মানও ওঠানামা করে। এটিও স্থিতিশীল নয়। এ কারণে ব্যাংকের জন্য এই লেনদেন ঝুঁকিপূর্ণ হবে এবং ব্যাংক এই ঝুঁকির কারণে বাড়তি চার্জ রাখতে পারে। তাই এই দুই দেশের বড় আকারে স্থানীয় মুদ্রায় বাণিজ্যে যাওয়ার সুযোগ কম থাকবে। যদি রুপি-টাকায় লেনদেন একবার শুরু হয় তাহলে এটি শুধু স্থানীয় পণ্যের বাণিজ্যের ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ থাকবে না বরং বিভিন্ন সেবামূলক বাণিজ্য যেমন ভ্রমণ, চিকিৎসা, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রেও ছড়িয়ে পড়বে, যা বাংলাদেশকে ঝুঁকিতে ফেলবে।
আইএমএফের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রেও এর প্রভাব পড়তে পারে। আইএমএফের সদস্য দেশগুলো সহজ ও নিরাপদ লেনদেনের জন্য কেবল পাঁচটি মুদ্রাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। সেগুলো হলো ডলার, ইউরো, ইউয়ান, জাপানের ইয়েন ও পাউন্ড। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জন্য রুপি-টাকায় লেনদেনে যাওয়া ঝুঁকি সৃষ্টি করতে পারে।
জানা গেছে, বিশেষজ্ঞ মত সামনে রেখে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ যে পরিমাণ পণ্য ভারতে রফতানি করে সে পরিমাণ দ্বিপক্ষীয় মুদ্রা ব্যবহারের প্রস্তাব দিয়েছে। বাকিটা প্রচলিত ব্যবস্থা অনুসারে ডলারে বাণিজ্য করতে চায় ঢাকা। কিন্তু দিল্লি চাপ দিচ্ছে পুরো দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য রুপিতে করার জন্য। এতে করে টাকা দিয়ে ডলার কিনে সেই ডলার দিয়ে আবার রুপি কিনে ভারতকে তা পরিশোধ করতে হবে। এতে আমদানি ব্যয় অনেক বেড়ে যেতে পারে। ভারতের প্রস্তাবে রাজি হলে আমদানির ব্যয় বাড়ার পাশাপাশি আমেরিকান চাপও বাড়তে পারে। এই চাপের ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি সংসদে মন্তব্য করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র চাইলে যেকোনো দেশের সরকার উল্টাতে পাল্টাতে পারে।
সম্প্রতি চীনের মুদ্রা ইউয়ানে অ্যাকাউন্ট খোলার অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ ছাড়া রাশিয়ার সঙ্গে টাকা-রুবলে লেনদেনেরও আলোচনা চলছে। এখন রুপির বিষয়ে ভারতের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বা দেশটির সরকারের পক্ষ থেকে কী সিদ্ধান্ত আসে এবং এতে ঢাকার সাড়া চূড়ান্তভাবে কী দাঁড়ায় সেটিই দেখার বিষয়। তবে বিষয়টি এখন শুধু অর্থনীতিতে সীমাবদ্ধ থাকছে না। সরকারের থাকা না থাকার সমীকরণও এতে সামনে চলে আসছে।
mrkmmb@gmail.com