Site icon The Bangladesh Chronicle

ডলারের সঙ্গে এখন টাকারও সংকট

এতে কিছু ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনায় বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। মাঝেমধ্যেই কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চাহিদামতো নগদ জমা (সিআরআর) রাখতে পারছে না কিছু ব্যাংক। ইসলামি ধারার পাঁচ ব্যাংকের পাশাপাশি গত নভেম্বর ও ডিসেম্বরে রাষ্ট্রমালিকানাধীন জনতা ব্যাংক, বেসরকারি খাতের ন্যাশনাল ব্যাংক চাহিদামতো সিআরআর রাখতে পারেনি।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ব্যাংক ম্যানেজমেন্টের অধ্যাপক শাহ মো. আহসান হাবিব এ নিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, ‘বাজারে তারল্যের এই পরিস্থিতি তৈরি হবে, এটা পূর্ব অনুমেয় ছিল। একক কোনো সিদ্ধান্তে এই পরিস্থিতি মোকাবিলা করা যাবে না। কারণ, এটা ডলারের সঙ্গে সম্পর্কিত। এখন ঋণ দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যাংকগুলোকে শুধু উৎপাদনশীল খাতকে বেছে নিতে হবে। আর তদারকি আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বাড়াতে হবে।’

টাকা কোথায় গেল?

মানুষ ব্যাংকে যে টাকা আমানত হিসেবে জমা রাখে, ব্যাংক তাই ঋণ হিসেবে বিতরণ করে থাকে। ব্যাংক খাতে গত সেপ্টেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি ছিল ৭ দশমিক ৭৪ শতাংশ। আর ঋণের প্রবৃদ্ধি ছিল ১১ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর গত নভেম্বরে আমানতের প্রবৃদ্ধি কমে হয় ৬ দশমিক ৬৮ শতাংশ ও ঋণের প্রবৃদ্ধি ১০ দশমিক ৯৩ শতাংশ। ফলে ব্যাংকে যে আমানত জমা হচ্ছে, তার চেয়ে ঋণ যাচ্ছে অনেক বেশি।

এদিকে সাম্প্রতিক সময়ে দাম বাড়ায় ডলার কেনা, রেমিট্যান্স কেনা, রপ্তানি বিল নগদায়নে গ্রাহকদের বাড়তি টাকা দিতে হচ্ছে ব্যাংকগুলোকে। আবার ব্যবসায় মন্দার কথা বলে ব্যবসায়ীরাও ঋণ পরিশোধ কমিয়ে এনেছেন। ফলে সার্বিকভাবে ব্যাংকগুলোতে তারল্যের ওপর চাপ তৈরি হয়েছে।

গত বছরে (২০২২) বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ থেকে ব্যাংকগুলোর কাছে সব মিলিয়ে ১ হাজার ২৬১ কোটি ডলার বিক্রি করে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতি ডলার ৯৮ টাকা ধরলে যার পরিমাণ দাঁড়ায় ১ লাখ ২৩ হাজার ৫৭৮ কোটি টাকা। গত বছরে ব্যাংকগুলো থেকে এই টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ভোল্টে। এতেও অর্থসংকট বেড়েছে।

এ পরিস্থিতির কারণ ও করণীয় সম্পর্কে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) সৈয়দ মাহবুবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মূল্যস্ফীতির চেয়ে আমানতের সুদ কম। আবার ডলার কিনতে অনেক টাকা ব্যাংকে চলে গেছে। এ পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশ ব্যাংক বিভিন্ন উদ্যোগ নিচ্ছে, পুনঃ অর্থায়ন তহবিল গঠন করছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় আরও পদক্ষেপ নিলে দ্রুতই পরিস্থিতির উন্নতি হবে।

টাকার সুদ বাড়ছে

ব্যাংকগুলোতে আমানতকারী, বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান টাকা জমা রাখে। এসব টাকার জন্য নিয়মিত সুদ দিতে হয়। এভাবে অর্থ সংগ্রহে ব্যাংকগুলো যতটা সম্ভব আমানতের সুদ বাড়িয়েছে। যে ব্যাংক যত দুর্বল ও অর্থের প্রয়োজন বেশি, তাদের সুদও তত বেশি। কিছু ব্যাংক আমানত আনতে বিশেষ কর্মসূচিও তৈরির আয়োজন করছে। সাড়ে ৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিয়ে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান থেকে আমানত আনছে তারা।

যদিও এখনো ঋণে সর্বোচ্চ সুদ ৯ শতাংশ। এত সুদে যেসব ব্যাংক আমানত আনছে, তারা কীভাবে ব্যবসা করছে, এ নিয়ে প্রশ্ন উঠছে। কারণ, আমানতের সুদের সঙ্গে রয়েছে পরিচালন খরচ। আবার মুনাফাও করতে হয়।

এদিকে গত মঙ্গলবার এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে কলমানিতে টাকা ধার করতে সর্বোচ্চ ৬ দশমিক ৭৮ শতাংশ পর্যন্ত সুদ দিচ্ছে। এক বছর আগে যা ছিল ৪ দশমিক ২৫ শতাংশ। আর ১৪ দিন মেয়াদের জন্য টাকা ধারে সুদ ১০ শতাংশ পর্যন্ত উঠেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, মাত্র কয়েক দিনের ব্যবধানেই কলমানিতে সুদহার ১ শতাংশের বেশি বেড়েছে। গত ৪ জানুয়ারি কলমানি বাজার থেকে এক দিনের জন্য টাকা ধারের ক্ষেত্রে গড় সুদহার ছিল ৫ দশমিক ৭৭ শতাংশ।

বাংলাদেশ ব্যাংক নিয়মিত ভিত্তিতে ব্যাংকগুলোকে রেপোর মাধ্যমে টাকা ধার দিচ্ছে। প্রয়োজনে বিশেষ তারল্য সহায়তাও দিচ্ছে। এতে সুদহার ধরছে ৫ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আবার সাম্প্রতিক সংকটের কারণে ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর জন্য চালু করেছে বিশেষ ধার সুবিধা। এর বাইরেও বিশেষ ব্যবস্থার মাধ্যমে তারল্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে পাঁচ ইসলামি ব্যাংককে। এতে সুদহার ধরা হয় ৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একটি ব্যাংকের এমডি বলেন, ইসলামি ব্যাংকগুলোয় অনিয়মের মধ্যেও যেভাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক শাস্তি না দিয়ে সুবিধা দিয়েছে, তাতে গ্রাহক আস্থায় আরও চিড় ধরেছে। এর ফলে বাজারে কমবেশি সব ব্যাংকই তারল্যসংকটে ভুগছে। টাকার জোগানদাতা ব্যাংকের সংখ্যা কমে গেছে। এ কারণে বাড়তি সুদে টাকা ধার করতে বাধ্য হচ্ছে সংকটে থাকা ব্যাংকগুলো।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মেজবাউল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘ট্রেজারি বিলে সুদ বাড়ছে, এ জন্য টাকা ধারের সব ধরনের পণ্যের সুদও বাড়ছে—এটাই স্বাভাবিক। গত এক বছরে ডলার বিক্রির কারণে ১ লাখ কোটি টাকার বেশি বাংলাদেশ ব্যাংকে চলে আসছে। এর ফলে তারল্যে সাময়িক অসামঞ্জস্য হতে পারে। ব্যাংকগুলো যে যেভাবে পারছে তারল্য ব্যবস্থাপনা করছে। এ জন্য ঋণের সুদহার তুলে নেওয়ার কোনো সিদ্ধান্ত এখনো হয়নি।’

তারল্য পরিস্থিতি

ব্যাংকে জমা টাকার নিরাপত্তার জন্য প্রচলিত ব্যাংকগুলোকে তার ১৭ শতাংশ অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে সিআরআর (নগদ জমার) ও এসএলআর (বিধিবদ্ধ জমা) হিসেবে জমা রাখতে হয়। ইসলামি ধারার ব্যাংকগুলোর জমা রাখতে হয় সাড়ে ৯ শতাংশ অর্থ। বাকি অর্থ ঋণ হিসেবে দেয় ব্যাংকগুলো। প্রচলিত ধারার ব্যাংক ১০০ টাকা আমানতের ৮৭ টাকা ও ইসলামি ধারার ব্যাংক ৯২ টাকা ঋণ দিতে পারে।

ব্যাংকগুলোর কাছে গত অক্টোবরে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ১ লাখ ৬৯ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। তবে এর মধ্যে প্রকৃত ব্যবহারযোগ্য অতিরিক্ত তারল্য ছিল মাত্র ১২ হাজার ৭৪৩ কোটি টাকা। ২০২১ সালের অক্টোবরে ব্যবহারযোগ্য তারল্য ছিল ৩৪ হাজার ৪০৬ কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে যা ছিল ৬৩ হাজার ৮৫৪ কোটি টাকা।

তবে গত অক্টোবরে দেশে ছাপানো টাকা বা রিজার্ভ মানির পরিমাণ ছিল ৩ লাখ ৩৫ হাজার ৪৭৬ কোটি টাকা। এর মধ্যে ব্যাংকে ও মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৫৮ হাজার ৭৩ কোটি টাকা। অক্টোবরে ব্যাংকের ভোল্টে নগদ টাকা ছিল ২১ হাজার ৯৫৯ কোটি টাকার, মানুষের হাতে ছিল ২ লাখ ৩৬ হাজার ১১৪ কোটি টাকা।

যে দেশের নগদ টাকা ও ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ যত কম, সেই দেশের অর্থনীতির গতি তত বাড়ে। তবে দেশে ব্যাংকের বাইরে টাকার পরিমাণ বাড়ছে। ব্যাংকের বাইরে টাকা থাকলে তা অর্থনীতিতে কার্যকর ভূমিকা রাখে না। টাকা ব্যাংকে থাকলে তা থেকে বিনিয়োগ হয়, কর্মসংস্থান বাড়ে।

ব্যাংকের তারল্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে জানতে চাইলে পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের নির্বাহী পরিচালক আহসান এইচ মনসুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘যারা ব্যাংক খাতে এই অবস্থার জন্য দায়ী, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। এর ফলে জনগণের আস্থা কমে যাচ্ছে। এ জন্য ডলারের পর টাকার সংকট তৈরি হয়েছে। ছয় মাস ধরে সমস্যা চলছে, অথচ এটাকে কোনো সমস্যাই মনে করছে না সরকার।

এখন সমাধান করতে হলে আগে দোষীদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। সুদহারের সীমা তুলে দিলে সাময়িক সমাধান হলেও আবার একই সমস্যা ফিরবে। কারণ, দেশ থেকে ডলার পাচার হয়েছে, আর টাকা ব্যাংকের বাইরে চলে গেছে।’

Exit mobile version