Site icon The Bangladesh Chronicle

ডলারের বাজারে কোনো অস্থিরতা নেই

দেশে ডলারের বাজারে এ মুহূর্তে কোনো অস্থিরতা দেখা যাচ্ছে না। স্থিতিশীল হয়ে এসেছে মুদ্রাটির বিনিময় হার। ব্যাংক বা কার্ব মার্কেটে ডলারের সংকট নেই। ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠালে প্রবাসীরা প্রণোদনাসহ ডলারপ্রতি ১২৩ টাকা পাচ্ছেন, যেখানে খুচরা বাজারে মিলছে ১২১-১২২ টাকায়। হুন্ডির চাহিদা কমায় খুচরা বাজারে ডলারের বিনিময় হার নিম্নমুখী বলে সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন।

যদিও দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে দেশে অস্থির ছিল বৈদেশিক মুদ্রার বাজার। ২০২২ সালের শুরুতে প্রতি ডলারের বিনিময় হার ছিল ৮৪ টাকা। সংকট তীব্র হয়ে ওঠায় বিনিময় হার বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। গত আড়াই বছরে ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ঘটেছে ৪২ শতাংশেরও বেশি। ডলারের দর স্থিতিশীল করতে গত মে মাসে ‘ক্রলিং পেগ’ নীতি গ্রহণ করে বাংলাদেশ ব্যাংক। এর পরও সমাধান মেলেনি, ব্যাংকের ঘোষিত দরের সঙ্গে কার্ব মার্কেটে ডলারের দরের ব্যবধান ছিল ৩-১০ টাকা। কিন্তু শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর ডলারের বাজার ক্রমেই স্থিতিশীল হয়ে এসেছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রধান শ্রমবাজারগুলোয় হুন্ডির যে বাজার আছে, সেটির চাহিদা তৈরি হয় বাংলাদেশের অভ্যন্তর থেকে। বর্তমানে অভ্যন্তরীণ বাজারে হুন্ডির চাহিদায় বড় পতন হয়েছে। হুন্ডির বাজারের সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্বর্ণ চোরাচালানের যোগসূত্র আছে। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটেও চিড় ধরেছে। সীমান্তরক্ষী বাহিনীর শক্ত অবস্থানের কারণে সীমান্ত দিয়ে স্বর্ণ চোরাচালান কমেছে। এ কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের চাহিদায় পতন হয়েছে। আমদানির ঋণপত্র (এলসি) কমে যাওয়ার প্রভাবে ব্যাংকেও ডলারের চাহিদা কমে গেছে।

বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, গত মে মাসে দেশের আমদানি ছিল ৫১৮ কোটি ডলার। একই মাসে ৩৬৭ কোটি ডলারের পণ্য রফতানি হয়েছে। আর রেমিট্যান্স হিসেবে দেশে এসেছে ২২৫ কোটি ডলার। অর্থাৎ ওই মাসে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার ব্যয়ের চেয়ে আয় বেশি ছিল। এ ধারাবাহিকতা বর্তমানেও অব্যাহত রয়েছে। আগস্টে দেশে রেমিট্যান্স প্রবাহে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় ৩৯ শতাংশ। গত মাসে প্রবাসীরা ২২২ কোটি ১৩ লাখ ডলার রেমিট্যান্স দেশে পাঠিয়েছেন।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, রফতানি খাত স্থিতিশীল থাকার পাশাপাশি রেমিট্যান্সে প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলে দেশে ডলারের দর আপাতত বাড়ার সম্ভাবনা নেই। বরং ক্রলিং পেগের ব্যান্ড কমানো হলে ব্যাংকে ডলারের দরও কমে আসবে। এর প্রভাবে কার্ব মার্কেটে ডলারের দর আরো কমবে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের (এমটিবি) ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বণিক বার্তাকে বলেন, ‘ব্যাংক খাতে ডলারের চাহিদা কমে গেছে। এলসি খোলার তেমন কোনো তোড়জোড় নেই। ব্যবসায়ী ও উদ্যোক্তারা রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গতিপ্রকৃতি বোঝার চেষ্টা করছেন। নতুন বিনিয়োগ না থাকলে মূলধনি যন্ত্রপাতির চাহিদা থাকে না। আগামী এক-দুই মাস পর ডলারের প্রকৃত চাহিদা বোঝা যাবে। জোগান স্বাভাবিক থাকলে ডলারের দর আপাতত বাড়ার সম্ভাবনা নেই।’

সৈয়দ মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘হুন্ডির বাজারে ডলারের চাহিদা এখন খুবই কম। এ কারণে কার্ব মার্কেটে ডলারের দর পড়ে গেছে। বর্তমান পরিস্থিতিতে প্রবাসীরা ব্যাংকে রেমিট্যান্স পাঠালেই বেশি টাকা পাচ্ছেন। প্রণোদনাসহ যোগ করলে রেমিট্যান্সের ক্ষেত্রে প্রতি ডলার ১২৩ টাকা পর্যন্ত পাওয়া যাচ্ছে। যেখানে কার্ব মার্কেটে ডলার মিলছে ১২১ টাকায়।’

বাজার স্থিতিশীল রাখার কথা বলে গত তিন অর্থবছর ধরে রিজার্ভ থেকে ডলার বিক্রি করে আসছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ২০২১-২২ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় ৭৬২ কোটি বা ৭ দশমিক ৬২ বিলিয়ন ডলার। ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ বিক্রি আরো বাড়িয়ে ১৩ দশমিক ৫৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত করা হয়। আর ২০২৩-২৪ অর্থবছরে রিজার্ভ থেকে বিক্রি করা হয় আরো ১২ দশমিক ৭৯ বিলিয়ন ডলার। টানা তিন অর্থবছর ধরে ডলার বিক্রির কারণে রিজার্ভে বড় ধরনের ক্ষয় হয়েছে। ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার গ্রস রিজার্ভ ছিল ৪৮ বিলিয়ন ডলার। সে রিজার্ভ কমে এখন ২০ বিলিয়ন ডলারের ঘরে নেমে এসেছে।

ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থানের মুখে গত ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন শেখ হাসিনা। প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করে তিনি ভারত পালিয়ে যান। ওই দিন থেকেই পলাতক ছিলেন বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার। পরে অজ্ঞাত স্থান থেকে পদত্যাগপত্র পাঠান তিনি। অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর অর্থনীতিবিদ ড. আহসান এইচ মনসুরকে গভর্নর পদে নিয়োগ দেয়া হয়। গত ১৪ আগস্ট কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ১৩তম গভর্নর হিসেবে তিনি দায়িত্ব নেন। ওই দিনই ক্রলিং পেগ নীতির ব্যান্ড ১ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে আড়াই শতাংশ করা হয়। ফলে ডলারের মধ্যবর্তী দাম ১১৭ থেকে সর্বোচ্চ ১২০ টাকা পর্যন্ত নেয়ার সুযোগ পায় ব্যাংকগুলো।

রাজধানীর মতিঝিল ও কারওয়ান বাজার এলাকার বেশ কয়েকটি এক্সচেঞ্জ হাউজের কর্মকর্তারা জানান, এর আগে কার্ব মার্কেটে প্রতি ডলারের দর ১৩০ টাকা পর্যন্তও উঠেছিল। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ডলারের বাজার নিম্নমুখী। এখন ব্যাংকে ডলারের দাম কমানো হলে কার্ব মার্কেটের দর আরো কমে যাবে। কারণ ডলারের জোগান থাকলেও তেমন চাহিদা নেই। এক সপ্তাহ ধরে প্রতি ডলার ১২১ থেকে ১২২ টাকায় ওঠানামা করছে।

গভর্নর পদে দায়িত্ব গ্রহণের পর আহসান এইচ মনসুর ঘোষণা করেন, বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকে আর ডলার বিক্রি করা হবে না। ব্যাংকগুলোকে নিজেদের আমদানির দায় মেটানোর ডলার নিজেরাই সংগ্রহ করতে হবে। এ ঘোষণার পর থেকে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার বিক্রি বন্ধ রয়েছে। এতে রিজার্ভের পরিমাণ কিছুটা বেড়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ৩১ জুলাই আন্তর্জাতিক মানদণ্ড (বিপিএম৬) অনুযায়ী দেশের রিজার্ভ ছিল ২০ দশমিক ৪৮ বিলিয়ন ডলার। ২৮ আগস্ট রিজার্ভের পরিমাণ বেড়ে ২০ দশমিক ৫৯ বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হয়েছে। যদিও গত জুলাইয়ে রিজার্ভ থেকে ১৩০ কোটি বা ১ দশমিক ৩০ বিলিয়ন ডলার ক্ষয় হয়েছিল।

দেশের সবচেয়ে বেশি রফতানি আয় ও রেমিট্যান্স আসে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ পিএলসি মাধ্যমে। আবার বেসরকারি পর্যায়ের সবচেয়ে বেশি পণ্য আমদানিও করে ব্যাংকটি। বর্তমানে ডলারের চাহিদা ও জোগানের বিষয়ে জানতে চাইলে ইসলামী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মুহাম্মদ মুনিরুল মওলা বণিক বার্তাকে বলেন, ‘পর্ষদ পুনর্গঠনের পর ইসলামী ব্যাংকের কার্যক্রম স্বাভাবিক হয়ে আসছে। প্রবাসীরা আমাদের ব্যাংকের মাধ্যমে আগের চেয়ে বেশি রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। ব্যাংকের আমানতের প্রবৃদ্ধিও ভালো। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এলসি খোলার বিষয়ে কিছু বিধিনিষেধ দিয়েছিল। পর্ষদ পুনর্গঠনের পর আমরা বিধিনিষেধের বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চিঠি লিখেছি। আশা করছি, ইসলামী ব্যাংকের আমদানি কার্যক্রমও দ্রুতই স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরবে। এ মুহূর্তে ডলারের বাজার পুরোপুরি স্বাভাবিক।’

Bonik Barta

Exit mobile version