ডব্লিউটিওতে শুল্কমুক্ত–সুবিধা পাওয়ার জন্য তোড়জোড়

  • এলডিসির পক্ষ থেকে নতুন প্রস্তাব দিয়েছে চাদ।
  • আগামী জুনে ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে আলোচনার জন্য তালিকাভুক্তির চেষ্টা।
  • বাণিজ্য–সুবিধা হারালে বাংলাদেশের পোশাক ও ওষুধশিল্প নিয়ে দুশ্চিন্তা বাড়বে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলো (এলডিসি) ডব্লিউটিওতে দেওয়া নতুন প্রস্তাবে ১২ বছর নয়, ৬ থেকে ৯ বছর শুল্কমুক্ত বাণিজ্য–সুবিধা চেয়েছে।

জানা গেছে, আগামী ১৩ জুন জেনেভায় ডব্লিউটিওর মন্ত্রী পর্যায়ের ১২তম সম্মেলন অনুষ্ঠিত হবে। অবশ্য সম্মেলনের উদ্বোধন করা হবে ১২ জুন। এবার সম্মেলনের সহ–আয়োজক হিসেবে থাকছে কাজাখস্তান। এর আগে ৯-১০ মে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের অ্যাজেন্ডা ঠিক করা হবে। সেই অ্যাজেন্ডায় এলডিসিগুলোকে ৬ থেকে ৯ বছর বাণিজ্য–সুবিধা দেওয়ার বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত করার চেষ্টা চলছে। অ্যাজেন্ডায় উঠলে মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে আলোচনা হবে। সেখানে বড় দেশগুলোর প্রতিশ্রুতি মিলতে পারে।

স্বল্পোন্নত দেশগুলোকে (এলডিসি) ডব্লিউটিওর দেওয়া বাণিজ্য–সুবিধা বাংলাদেশের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, এর আওতায় ৯৭ শতাংশ শুল্কমুক্ত–সুবিধা পাওয়া যায় এবং মেধাস্বত্ব বিধিবিধানের আওতায় ওষুধশিল্পের জন্য শর্ত শিথিল রয়েছে। এর মধ্যে ৯৭ শতাংশ শুল্ক–সুবিধা উঠে গেলে বাংলাদেশ পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যসহ বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিতে শুল্কমুক্ত–সুবিধা আর পাবে না। অবশ্য ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), যুক্তরাজ্য ও তুরস্ক এলডিসি থেকে বের হলেও তিন বছরের এই সুবিধা অব্যাহত রাখবে। অন্যদিকে ওষুধশিল্পও চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। বাংলাদেশের ওষুধ প্রস্তুতকারক কোম্পানিগুলোকে এখন আবিষ্কারক প্রতিষ্ঠানকে কোনো অর্থ দিতে হয় না। কারণ, অর্থ দেওয়া হলে বাংলাদেশের মতো স্বল্পোন্নত দেশে ওষুধের দাম বেড়ে যেতে পারে। কিন্তু ২০২৬ সালে বাংলাদেশ যদি এলডিসি থেকে বের হয়ে যায়, তাহলে এই সুবিধা আর থাকবে না।

এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও বাণিজ্য–সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে আমরা দর-কষাকষি করার চেষ্টা করছি। সেটাকে এখন মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে অ্যাজেন্ডা হিসেবে তুলতে চাইছি। আশা করছি, ওই সম্মেলন থেকে এলডিসির জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারব।

দেবব্রত চক্রবর্তী, ডব্লিউটিওতে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর

এ সম্পর্কে জানতে চাইলে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) গবেষণা পরিচালক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম প্রথম আলোকে বলেন, প্রস্তাবের পক্ষে সোচ্চার থাকা বাংলাদেশের জন্য খুবই জরুরি। বাজার–সুবিধা সব এলডিসির জন্য সহায়ক। কিন্তু বাজার–সুবিধার সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী হলো বাংলাদেশ। শুল্কমুক্ত বাজার–সুবিধা না থাকলে সবচেয়ে বেশি অভিঘাতও আসবে বাংলাদেশের ওপর। তবে মনে রাখতে হবে, এলডিসি থেকে উত্তরণের পর যেসব সুবিধা অব্যাহত রাখার প্রস্তাব করা হয়েছে, তার সবই কিন্তু আপত্কালীন। এসব সুবিধা যে দীর্ঘমেয়াদে থাকবে না তা সরকারকে বুঝতে হবে।

প্রস্তাবে সুবিধার মেয়াদ ১২ থেকে ৯ বছরে নামল

সব স্বল্পোন্নত দেশ তাদের এলডিসি থেকে উত্তরণের পর ১২ বছর ডব্লিউটিওর আওতায় শুল্কমুক্ত বাণিজ্য–সুবিধা দেওয়ার প্রস্তাব করেছিল ২০২০ সালের শেষের দিকে। কিন্তু পুরো বিষয়টি চূড়ান্ত করা বেশ সময়সাপেক্ষ। তাই গত বছরের ১৭ অক্টোবর এলডিসি গ্রুপের পক্ষ থেকে আরেকটি অন্তর্বর্তীকালীন প্রস্তাব দেওয়া হয়। ৪৬টি দেশের এলডিসি গ্রুপের সমন্বয়কারী দেশ হিসেবে আফ্রিকার চাদ ওই প্রস্তাব দেয়। উল্লেখ্য, এলডিসি গ্রুপে বাংলাদেশ সবচেয়ে শক্তিশালী দেশ হিসেবে পরিচিত।

প্রস্তাবটি দুই ভাগে বিভক্ত। প্রথম ভাগ হলো, কোনো দেশ এলডিসি থেকে বের হলে, এলডিসির হিসাবে প্রাপ্ত সব ধরনের বাণিজ্য সুবিধা আরও ৬ থেকে ৯ বছর যেন বহাল রাখা হয়। এর মানে, ডব্লিউটিওর আওতায় যে ৯৭ শতাংশ পণ্যে শুল্কমুক্ত সুবিধা মেলে, তা অব্যাহত থাকবে। প্রস্তাবের দ্বিতীয় ভাগে আছে, শুল্কমুক্ত সুবিধা ছাড়া এলডিসি হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর কাছে অন্য যেসব সুবিধা পাওয়া যায়, সেগুলোও যেন অব্যাহত থাকে। যেমন এলডিসির সদস্য দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য কারিগরি সুবিধাসহ নানা সহায়তা করা হ

বাজার–সুবিধার সবচেয়ে বেশি ব্যবহারকারী হলো বাংলাদেশ। শুল্কমুক্ত বাজার–সুবিধা না থাকলে সবচেয়ে বেশি অভিঘাতও আসবে বাংলাদেশের ওপর।

খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম, গবেষণা পরিচালক, সিপিডি।

নতুন এই প্রস্তাব দেওয়ার পর উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে এলডিসি গ্রুপের পক্ষ থেকে একাধিকবার অনানুষ্ঠানিক আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে বড় দেশগুলো ইতিবাচক মনোভাব প্রকাশ করেছে বলে জানা গেছে। তবে করোনা সংক্রমণ এবং সর্বশেষ রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে এই বিষয়ে সুস্পষ্ট কোনো আশ্বাস মেলেনি। এ ছাড়া ডব্লিউটিওতে যুক্তরাষ্ট্র হলো প্রভাবশালী দেশ। ডব্লিউটিওতে বেশ কয়েক মাস ধরে তাদের প্রতিনিধি (অ্যাম্বাসেডর) নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সম্প্রতি তাদের প্রতিনিধি যোগ দিয়েছেন। এখন আলোচনা আরও গতি পাবে বলে মনে করেন বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

ডব্লিউটিওতে বাংলাদেশের কমার্শিয়াল কাউন্সিলর হিসেবে কাজ করেন দেবব্রত চক্রবর্তী। তিনি এলডিসি থেকে উত্তরণ ও ট্রেড–রিলেটেড অ্যাসপেক্টস অব ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি রাইটস (ট্রিপস) বিষয়ে এলডিসির ফোকাল পয়েন্ট কর্মকর্তা। যোগাযোগ করা হলে ওই কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, ‘এলডিসি থেকে উত্তরণের পরও বাণিজ্য–সুবিধা অব্যাহত রাখার বিষয়ে আমরা দর-কষাকষির চেষ্টা করছি। সেটাকে এখন মন্ত্রী পর্যায়ের সম্মেলনে অ্যাজেন্ডা হিসেবে তুলতে চাইছি। আশা করছি, ওই সম্মেলন থেকে এলডিসির জন্য ভালো ফল বয়ে আনতে পারব।’