Site icon The Bangladesh Chronicle

ডব্লিউএফপির প্রতিবেদন: খাবার কিনতে হিমশিম অবস্থা ৬৮% মানুষের

সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছেন সিলেট ও বরিশাল বিভাগের মানুষ। আর সবচেয়ে ভালো অবস্থায় আছেন ময়মনসিংহ ও চট্টগ্রাম বিভাগের অধিবাসীরা।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির ‘বাংলাদেশে খাদ্যনিরাপত্তা ও বিপন্নতা পর্যবেক্ষণ’ শীর্ষক প্রতিবেদনটি করা হয়েছে ১ হাজার ২০০ মানুষের ওপর জরিপের মাধ্যমে। গত মার্চ থেকে আগস্ট পর্যন্ত সময়ে আটটি বিভাগের এসব মানুষের তথ্য সংগ্রহ করা হয়।

প্রতিবেদনটিতে বলা হয়েছে, সামগ্রিকভাবে দেশের ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছেন (আগস্টে)। হারটি আগের মাস জুলাইয়ের চেয়ে কম। ওই মাসে ২৯ শতাংশ মানুষ মাঝারি মাত্রায় খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ছিলেন। আর নিম্ন আয়ের ৪২ শতাংশ পরিবারের জীবনযাত্রা এবং খাদ্য পরিস্থিতির সব ক্ষেত্রে অবনতি হয়েছে। এই পরিস্থিতির জন্য মূলত খাদ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি, জ্বালানি তেলের দাম বাড়িয়ে দেওয়া, প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং রোগবালাইয়ের মতো স্বাস্থ্যসমস্যা বেড়ে যাওয়াকে দায়ী করা হয়েছে।

জানতে চাইলে খাদ্যসচিব মো. ইসমাইল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, খোলাবাজারে কম দামে চাল বিক্রি ও খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতায় দেশের ৫০ লাখ দরিদ্র মানুষকে কম দামে খাদ্যসহায়তা দেওয়ার কাজ চলছে। সরকারের খাদ্য পরিধারণ ও মূল্যায়ন কমিটির (এফপিএমইইউ) সভায় খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া ও সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি বাড়ানোর বিষয়টি তোলা হবে। সেখানে অনুমোদন পেলে গরিব মানুষের জন্য খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম আরও বাড়ানো হবে।

জরিপে আগস্ট মাসের পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে বলা হয়, ওই মাসে পরিবারের খাদ্য কেনার জন্য ৬৪ শতাংশ মানুষ ঋণ নিয়েছেন। ২৯ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙেছে। আবার খাবার কিনতে গিয়ে ১০ শতাংশ পরিবার তাদের গত ১২ মাসের সব সঞ্চয় ভেঙে ফেলেছে। সবচেয়ে চাপে আছেন সিলেট ও বরিশাল বিভাগের মানুষ, হার ৭৫ শতাংশ।

সিলেট ও বরিশালে সংকট বেশি কেন, সেই ব্যাখ্যাও দেওয়া হয় প্রতিবেদনে। বলা হয়, সিলেট বিভাগের মানুষ এখনো বন্যার ধকল কাটিয়ে উঠতে পারেননি। চলতি বছরের মে মাসের ওই বন্যায় সিলেট বিভাগের তিন–চতুর্থাংশ এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। বিপুল পরিমাণ ধান নষ্ট হয়। বোরো মৌসুমের ওই ধান হচ্ছে দেশের হাওরপ্রধান সিলেট বিভাগের কৃষকদের বছরের একমাত্র ফসল।

অন্যদিকে বরিশাল বিভাগের দারিদ্রের হার বেশি। খাদ্যপণ্য ও জ্বালানির দাম বেড়ে যাওয়ার আঘাত সেখানকার মানুষের ওপরে সবচেয়ে বেশি পড়েছে। সেই সঙ্গে অনাবৃষ্টির কারণে ফসল নষ্ট হওয়া ওই সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে।

বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদনে বলা হয়, নিম্ন ও মধ্যম আয়ের পরিবারগুলো নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ নানা ধরনের চাপ সামলাতে পারছে না। এসব সমস্যা তাদের ভবিষ্যতের বড় সংকট মোকাবিলার সামর্থ্য কমিয়ে দিচ্ছে। তবে ধনী ও সচ্ছল পরিবারগুলো খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে যাওয়াসহ অন্যান্য সমস্যায় তেমন কোনো অসুবিধায় পড়েনি।

সবজি খাওয়া কমছে, আলু খাওয়া বাড়ছে

খাদ্যসংকট মোকাবিলায় বাংলাদেশ সরকারের নেওয়া নানা উদ্যোগের চিত্র তুলে ধরে প্রতিবেদনে বলা হয়, বেসরকারি খাতে চালের সরবরাহ বাড়াতে ও দাম কমাতে সরকার আমদানি শুল্ক কমিয়ে দিয়েছে। বেসরকারি খাতের মাধ্যমে ১২ লাখ টন চাল আমদানির অনুমতি দেওয়া হয়েছে। সরকারিভাবে রাশিয়া ও ভিয়েতনাম থেকে গম ও চাল আমদানির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ৫০ লাখ গরিব মানুষের জন্য বিশেষ সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি শুরু করেছে সরকার। সরকারের নেওয়া এতসব উদ্যোগের পরেও চাল ও গমের দাম যেমন বেড়েছে, তেমনি সবজি, ডিম, ডাল, মাছ, চিনি, পেঁয়াজ, আদা, রসুন ও হলুদের দাম নিয়মিতভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। জুলাই ও আগস্টে মূল্যস্ফীতি সাড়ে ৭ শতাংশ ছাড়িয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির ওই চাপ সামলাতে নিম্নবিত্ত ও মধ্যম আয়ের মানুষ খাদ্য কেনার পরিমাণ কমিয়ে দিচ্ছেন।

প্রতিবেদনে আরও উল্লেখ করা হয়, নিম্ন আয়ের পরিবারগুলো খাদ্যের দাম বেড়ে যাওয়া এবং আয় কমে যাওয়ায় নানাভাবে সাশ্রয়ের চেষ্টা করছে। যেমন অন্য সবজির দাম বেড়ে যাওয়ায় বেশির ভাগ মানুষ আলু খাওয়ার পরিমাণ বাড়িয়েছেন। ঢাকার বাইরের বেশির ভাগ বিভাগের অধিবাসীরা স্থানীয়ভাবে কিছুটা হলেও মাছ ও সবজি সংগ্রহ করতেন (আবাদ ও মুক্ত জলাশয় থেকে সংগ্রহ)। এ বছর বৃষ্টি কম হওয়ায় এবং চরম আবহাওয়া থাকায় সেই সুযোগ কম ছিল।

‘উদ্যোগ জরুরি’

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) নির্দেশনা অনুযায়ী, আট ধরনের প্রাণিজ আমিষে সবচেয়ে বেশি পরিমাণে পুষ্টিকর উপাদান আছে। বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচির প্রতিবেদন বলছে মাছ, মাংস, সামুদ্রিক খাবারসহ পুষ্টিকর উপাদানসমৃদ্ধ খাবার পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে মাত্র ১৭ শতাংশ পরিবার। বাকিরা পারছে না। সাধারণভাবে শিশু, গর্ভবতী মা ও অপুষ্টিতে ভোগা নারীদের এ ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া উচিত। এই খাবারগুলো তাঁদের নিয়মিতভাবে না পাওয়া আশঙ্কাজনক।

জাতিসংঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) বাংলাদেশ–এর প্রধান অর্থনীতিবিদ নাজনীন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, করোনার ধাক্কার পর বাংলাদেশে একের পর এক দুর্যোগ আঘাত হানছে। রাশিয়া–ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে প্রধান খাদ্যপণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ পরিস্থিতিতে সরকারের উচিত ডব্লিউএফপির প্রতিবেদনকে অস্বীকার না করে দ্রুত দরিদ্রদের পাশে দাঁড়ানো। তিনি বলেন, কর্মসূচি ও প্রকল্পভিত্তিক উদ্যোগ না নিয়ে একটি জাতীয় ত্রাণ তহবিল গঠন করা দরকার, যার মাধ্যমে সরকারি ও বেসরকারি খাত থেকে অর্থ নিয়ে দরিদ্রদের জন্য দীর্ঘমেয়াদি খাদ্যসহায়তা কার্যক্রম শুরু করতে হবে। নয়তো দেশের সামগ্রিক পুষ্টি পরিস্থিতির অবনতি হবে।

Exit mobile version