Prothom Alo
ট্রাম্পের ‘মেক আমেরিকা গ্রেট এগেইন’ (আমেরিকাকে আবার মহান করো) নীতিগুলো কি উল্টো ফল দেবে? মানে, ট্রাম্প কি আসলে তাঁর নিজের দেশের বদলে এশিয়াকে—বিশেষ করে পূর্ব এশিয়াকে—আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী করে তুলছেন?
বর্তমানে যা দেখা যাচ্ছে, তাতে পরিস্থিতি তেমনই দেখাচ্ছে। কারণ, প্রেসিডেন্ট ট্রাম্পের শুল্ক ও বাণিজ্যনীতি তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী দেশগুলোকে দূরে ঠেলতে গিয়ে মিত্রদেরও সরিয়ে দিচ্ছে। আর এই নীতিগুলোর ফলে পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপ পরস্পরের কাছাকাছি আসার সুযোগ পাচ্ছে।
একটা সম্ভাব্য জোটের কথা এখন অনেকেই বলছেন। এর নাম সিপিটিপিপি। এই কাঠামো গড়ে উঠলে তা বিশ্বের সবচেয়ে বড় ও সক্রিয় মুক্ত বাণিজ্য অঞ্চলগুলোর একটি হয়ে উঠতে পারে। আর তেমন হলে আমেরিকার একঘরে হয়ে পড়ার আশঙ্কাও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
ট্রাম্পের শুল্কনীতি যদি চীন ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের চোখে অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক মনে হয়, তাহলে ইউরোপ-এশিয়া অর্থনৈতিক জোট একটি কৌশল হিসেবে খুব কার্যকর হবে। যদিও অনেকে মনে করেন, এশিয়ায় আমেরিকার উপস্থিতি এতটাই দৃঢ় যে এমন হুমকিকে খুব একটা গুরুত্ব দেওয়ার কিছু নেই।
টোকিওর ন্যাশনাল গ্র্যাজুয়েট ইনস্টিটিউট ফর পলিসি স্টাডিজের অর্থনীতির অধ্যাপক ইউকিং শিং-এর মতে, ট্রাম্প প্রশাসনের আনা তথাকথিত ‘বিপ্লবাত্মক পরিবর্তনগুলো’ চীনের সিপিটিপিপিতে যোগ দেওয়ার জন্য ভালো সহায়ক পরিবেশ তৈরি করেছে। এখন এই সম্ভাব্য সিপিটিপিপি চুক্তিতে ইউরোপীয় ইউনিয়নও যোগ দেবে কি না, তা নিয়েও এখন বিতর্ক চলছে।
সম্প্রতি টোকিওতে ফরেন করেসপনডেন্টস ক্লাব অব জাপানে এক আলোচনায় শিং বলেন, বিশ্বায়নের এই যুগে সিপিটিপিপি হয়তো বৈশ্বিক বাণিজ্যের একটি নতুন কাঠামো হয়ে উঠতে পারে।
সিপিটিপিপি কী? এ হলো যুক্তরাষ্ট্রের প্রস্তাবিত ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপের উত্তরসূরি। এই পার্টনারশিপ ট্রাম্প তাঁর প্রথম রাষ্ট্রপতি পদে থাকা অবস্থায় বেরিয়ে যাওয়ার কারণে ভেঙে পড়েছিল। এতে যুক্ত আছে অস্ট্রেলিয়া, ব্রুনেই, কানাডা, চিলি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, নিউজিল্যান্ড, পেরু, সিঙ্গাপুর, ব্রিটেন এবং ভিয়েতনাম। দক্ষিণ কোরিয়াও এতে যোগ দেওয়ার বিষয়ে ভাবছে।
ট্রাম্পের শুল্ক পদক্ষেপগুলো তাঁর দ্বিতীয় মেয়াদের শুরুর দিকেই আর্থিক বাজারগুলোকে বড় আঘাত দিয়েছে। শুধু তা–ই নয়, সেই সঙ্গে আমেরিকার রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে। এই পদক্ষেপগুলোর প্রাথমিক লক্ষ্য ইউরোপ ও এশিয়া। মনে হচ্ছে, ট্রাম্প ইউরোপ ও এশিয়ার সম্পর্কের বিষয়ে নতুন চিন্তাভাবনা তৈরি করতে উত্সাহ জোগালেন।
অর্থনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান খোঁজার আশায় এ ধরনের জটিল এক ব্যবস্থায় হঠাৎ করে এলোপাতাড়ি ছুরি চালালে এর ফলাফল ভয়ানক হতে পারে। এমনকি জীবনঘাতী হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
চীন পূর্ব এশিয়া ও ইউরোপে আক্রমণাত্মক কূটনীতি থেকে ধীরগতির কূটনীতি গ্রহণ করবে। চীনের উদ্দেশ্য হবে বিশ্বজুড়ে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ময়দান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমাগত সরে যাওয়ার ফলে তৈরি হওয়া শূন্যতার সুযোগ কীভাবে গ্রহণ করা যায়। শুধু চীন নয়, বরং ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান এবং দক্ষিণ কোরিয়াও ট্রাম্পের আমেরিকা ফার্স্ট নীতির শিকার। ফলে তারা সবাই হয়তো একসঙ্গে কাজ করার কথা ভাবতে পারে। নইলে বিশ্ববাজারভিত্তিক আন্তর্জাতিক ব্যবস্থা এবং বৈশ্বিক বাণিজ্য ব্যবস্থা রক্ষা করা কঠিন হয়ে যাবে।
চীন এবং এশিয়ার অন্যান্য কিছু দেশ বৈশ্বিক উত্পাদন সরবরাহ চেইনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ। যদি বাণিজ্যযুদ্ধ তীব্র হয়, তাহলে এই দেশগুলোর হাতে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে কাজে লাগানোর মতো শক্তিশালী কিছু হাতিয়ার আছে। আমেরিকার বহুজাতিক কোম্পানিগুলো এ দেশগুলোর ওপর নির্ভরশীল। দেশগুলো থেকে কোম্পানিগুলো পণ্য উৎপাদন করিয়ে বিশ্বব্যাপী রপ্তানি করে। তাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আমেরিকার বাণিজ্য ভারসাম্য গভীর আঘাত পেতে পারে। এমনকি আমেরিকার শেয়ারবাজারেও মারাত্মক ধস নামতে পারে।
পূর্ব এশিয়ার শক্তিগুলোর মধ্যে একটি বাড়তি বোঝাপড়ার পরিবেশ লক্ষ করা যাচ্ছে। জাপান, চীন ও দক্ষিণ কোরিয়া ৩০ মার্চ একমত হয়েছে যে তারা ত্রিপক্ষীয় অর্থনৈতিক এবং বাণিজ্যিক সহযোগিতা বাড়াবে। একে পূর্ব এশিয়ার একীকরণের দিকে একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হচ্ছে। কারণ, এই তিনটি দেশই এই অঞ্চলের তিনটি বৃহত্তম অর্থনীতি।
তবে এত কিছুর পরেও এর মানে এই নয় যে পূর্ব এশিয়ায় ‘চীন নিয়ন্ত্রিত রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক ব্যবস্থার’ জন্ম হচ্ছে—এমনটাই মনে করেন অধ্যাপক কেন্ট ক্যাল্ডার। তিনি ওয়াশিংটনের জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের এডউইন ও. রেইশোয়ার সেন্টারের পরিচালক। টোকিওর এক আলোচনায় তিনি বলেন, ‘আমাদের স্বীকার করতেই হবে যে যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার সম্পর্কের পেছনে খুব গভীর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতা কাজ করে।’
কেন্ট ক্যাল্ডার বলছেন, এমন কিছু ‘স্থিতিশীল বাস্তবতা’ আছে, যা আগামী বছরগুলোতে যুক্তরাষ্ট্র ও এশিয়ার সম্পর্ক আরও মজবুত করতে পারে। যেমন খাদ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে চীনের জনসংখ্যা যুক্তরাষ্ট্রের চেয়ে চার গুণ বেশি। এটা চীনের জন্য একধরনের দুর্বলতা, আর যুক্তরাষ্ট্রের জন্য একধরনের শক্তি। কারণ, তারা খাদ্য রপ্তানিতে বড় এবং খাদ্য উৎপাদন-সম্পর্কিত উদ্ভাবনেও এগিয়ে।
শক্তির জোগানেও যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েক বছরে বড় রপ্তানিকারক হয়ে উঠেছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার (এআই) ক্ষেত্রে বড় অগ্রগতি হয়েছে। যেমন চীনের ডিপসিক প্রযুক্তির আবির্ভাব। কিন্তু চীন আমেরিকার সিলিকন ভ্যালির সমতুল্য কিছু তৈরি করতে পেরেছে কি না, তা এখনো বলা যাচ্ছে না। এ ছাড়া এশিয়া মহাদেশ ঘিরে থাকা সমুদ্রপথগুলোর ভূরাজনৈতিক গুরুত্ব অনেক বেড়েছে। এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষে এই অঞ্চলে শক্তিশালী ভূমিকা রাখা সম্ভব হতে পারে।
পণ্য ও জ্বালানির বিপুল পরিমাণ লেনদেন সম্প্রতি চীনকে আরও ঝুঁকির মধ্যে ফেলেছে। একসময় চীন ছিল জ্বালানি রপ্তানিকারক। কিন্তু এখন তারা বিশ্বের অন্যতম বড় জ্বালানি আমদানিকারকে পরিণত হয়েছে। চীন এখন প্রতিদিন এক কোটিরও বেশি ব্যারেল অপরিশোধিত তেল আমদানি করে। এর বেশির ভাগই আসে মধ্যপ্রাচ্য থেকে।
অধ্যাপক ক্যাল্ডার বলছেন, গত এক প্রজন্মে চীন ও বাকি বিশ্বের মধ্যে একটি গভীর নির্ভরশীল সম্পর্ক গড়ে উঠেছে।
এই নির্ভরতা সবচেয়ে স্পষ্টভাবে দেখা যায় ভারত মহাসাগর অঞ্চলে। এই অঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্র এখনো ভূরাজনৈতিকভাবে প্রভাবশালী।
চীনের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই নির্ভরতা বেড়েছে। এটি একদিকে স্থিতিশীলতার ভিত্তি হতে পারে। কিন্তু অন্যদিকে তা চীনের জন্য একটি বড় ঝুঁকিও তৈরি করেছে। একটি দেশ হিসেবে তাদের প্রবৃদ্ধি ঘটছে। বিশ্বের সঙ্গে তাদের যোগসূত্র দিনে দিনে গভীরতর হচ্ছে।
ট্রাম্পের আমলে বাণিজ্য ও শুল্কযুদ্ধ ক্রমেই তীব্র হচ্ছে। তা থেকে একটা জিনিস খুব স্পষ্ট হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য ও বিনিয়োগের কাঠামো আসলে অনেক বেশি জটিল। এই বাস্তবতা বোধ হয় ট্রাম্প প্রশাসনের বোঝার বাইরে।
অর্থনৈতিক সমস্যার দ্রুত সমাধান খোঁজার আশায় এ ধরনের জটিল এক ব্যবস্থায় হঠাৎ করে এলোপাতাড়ি ছুরি চালালে এর ফলাফল ভয়ানক হতে পারে। এমনকি জীবনঘাতী হলেও অবাক হওয়ার কিছু নেই।
এন্টনি রাওলি সাংবাদিক, ফার ইস্টার্ন ইকোনমিক রিভিউর সাবেক বাণিজ্য সম্পাদক
সাউথ চায়না মর্নিং নিউজ থেকে নেওয়া ইংরেজির অনুবাদ