Site icon The Bangladesh Chronicle

ট্রাম্পের শুল্কে বেসামাল কলকাতার চামড়া হাব

বিশেষ প্রতিনিধি, কলকাতা
প্রকাশ : ০৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ১১: ৩৩

কলকাতা লেদার কমপ্লেক্স বা বানতলায় এক সময় ব্যাপক কর্মব্যস্ততা ছিল। পণ্যবাহী ট্রাকের হর্নের শব্দ ও শ্রমিকদের হাঁকডাকে মুখর থাকত ভারতের এই অন্যতম চামড়া হাব। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের বাড়তি শুল্কারোপের পর এখানে নেমে এসেছে বিপর্যয়, এখন শুধুই নীরবতা। যে ভোজেরহাটের মোড়ে কয়েক মাস আগেও কাঁচা চামড়া বোঝাই কয়েকশ ট্রাকের লম্বা জট লেগে থাকত, সেই রাস্তা বর্তমানে সুনসান। এশিয়ার বৃহত্তম এই চামড়া শিল্পাঞ্চল অভূতপূর্ব সংকটে পড়েছে।

বর্ষার পানিতে ভেজা কাদামাখা চত্বরে শ্রমিকদের আনাগোনা এখন নামমাত্র। কিছু কারখানা পুরোপুরি উৎপাদন বন্ধ করে দিয়েছে, আর কিছু শুধু কাঁচামাল বাঁচিয়ে রাখার জন্য টিমটিম করে চলছে। আদিল আনসারির মতো ট্যানারি কর্মীরাও এখন একটাই কাজ করছেনÑরোদে চামড়া শুকিয়ে সেটিকে পচনের হাত থেকে বাঁচানো। তিনি বলেন, বর্ষার সময় চামড়া স্যাঁতসেঁতে হয়ে যায়, নষ্ট হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। ভালো রোদ না উঠলে এগুলো বাঁচানো মুশকিল।

প্রায় সাড়ে চার বর্গকিলোমিটারজুড়ে ছড়িয়ে থাকা এই শিল্পাঞ্চলে ৫৩৮টি ট্যানারি এবং শত শত জুতা ও চামড়াজাত পণ্যের কারখানা আছে। কিন্তু ট্রাম্পের এক সিদ্ধান্তের জেরে গোটা শিল্পতালুকের ভবিষ্যৎ আজ অন্ধকার।

ঘটনার সূত্রপাত গত ৭ আগস্ট। ভারত রাশিয়া থেকে তেল কেনা বন্ধ না করায় ট্রাম্প ভারতীয় পণ্যের ওপর ২৫ শতাংশ শুল্ক বা ট্যারিফ আরোপ করেন। এরপর ২৭ আগস্ট আরো ২৫ শতাংশ শুল্ক চাপানো হয়। সম্মিলিতভাবে এই ৫০ শতাংশ শুল্কের বোঝা ভারতের চামড়াশিল্পের কোমর ভেঙে দিয়েছে। ভিয়েতনাম (২০ শতাংশ), চীন (৩০ শতাংশ) বা বাংলাদেশের (৩৫ শতাংশ শুল্ক) মতো প্রতিযোগী দেশগুলোর সঙ্গে দামে এঁটে ওঠা অসম্ভব হয়ে পড়েছে ভারতীয় রপ্তানিকারকদের জন্য।

কলকাতা থেকে প্রতি বছর প্রায় ৮৭০ কোটি টাকার চামড়াজাত পণ্য যুক্তরাষ্ট্রে রপ্তানি হয়। শিল্পমহলের আশঙ্কা, ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে এই ব্যবসার প্রায় ৭৫ শতাংশ বন্ধ হয়ে যেতে পারে, যার কারণে হাজার হাজার মানুষ কর্মহীন হয়ে যাবে। ইন্ডিয়ান চেম্বার অব কমার্সের লেদার ডিভিশনের চেয়ারম্যান নরেশ জুনেজা বলেন, এই বিপুল শুল্কের কারণে আমেরিকার বাজারে ভারতীয় জুতা, ব্যাগ ও অন্যান্য সামগ্রীর দাম আকাশছোঁয়া হয়ে গেছে। এর সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়েছে কলকাতার মতো হাবগুলোতে। ছোট ও মাঝারি সংস্থাগুলো বন্ধের মুখে এবং বহু মানুষ কাজ হারাতে চলেছে।

এই সংকটের প্রভাব সরাসরি পড়েছে শ্রমিকদের জীবনে। উত্তর ২৪ পরগনার সন্দেশখালী থেকে আসা দিনমজুর শফিকুল সর্দার ১৫ বছর ধরে এখানে কাজ করছেন। তিনি হতাশ হয়ে বলেন, ‘আগে দিনে ৫৫০-৭০০ টাকা রোজগার হত; কিন্তু কয়েক মাস ধরে শুনছি বাজার খুব খারাপ। উৎপাদন না হলে আমরা কাজ পাব কোথায়, খাব কী? আমাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকার।’

করোনা পরিস্থিতি, তারপর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের ধাক্কা সামলে ওঠার আগেই এই নতুন আঘাত শিল্পকে খাদের কিনারায় দাঁড় করিয়েছে। ট্যানারির কর্মী সুকান্ত লস্কর বলেন, ‘কাছাকাছি সাতটি বিধানসভা কেন্দ্রের মানুষ এই শিল্পের ওপর নির্ভরশীল। একের পর এক আঘাতে আমরা জর্জরিত।’

শিল্প সংগঠনগুলো ইতোমধ্যে সরকারের কাছে স্বল্প সুদে ঋণ এবং বর্ধিত ‘ড্র ব্যাক’ সুবিধার মতো সহায়তা প্যাকেজের দাবি জানিয়েছে। রাজ্য সরকারের পক্ষ থেকে এখনো কোনো আনুষ্ঠানিক ঘোষণা না এলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বিষয়টি নিয়ে উচ্চপর্যায়ের বৈঠক করেছেন বলে সূত্রে জানা গেছে।

অন্যদিকে, কেন্দ্রীয় সরকার সরাসরি সংঘাতে না গিয়ে প্রায় ২৫ হাজার কোটি টাকার ‘এক্সপোর্ট প্রমোশন মিশন’ এবং স্থানীয় চাহিদা বাড়াতে জিএসটি ছাড়ের মতো বিকল্প পথের কথা ভাবছে।

অর্থনীতিবিদ ইন্দ্রনীল দাশগুপ্ত বলেন, কেন্দ্র ও রাজ্য উভয় সরকারকেই অবিলম্বে ব্যবস্থা নিতে হবে। রাজনৈতিক লড়াই ছেড়ে এখন কারখানা মালিকদের ঋণে ছাড়, শ্রমিকদের জন্য সরাসরি আর্থিক সহায়তা এবং বিদ্যুৎ বিল মওকুফ করার মতো পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এটা এক ভয়ঙ্কর বিপর্যয়।

বানতলার আকাশে এখন দুর্যোগের ঘনঘটা। লাখ লাখ মানুষের রুটি-রুজি যে শিল্পের ওপর নির্ভরশীল, সেই চামড়াশিল্পকে বাঁচাতে ভারত সরকার কত দ্রুত এবং কতটা কার্যকর পদক্ষেপ নেয়Ñএখন সেটাই দেখার বিষয়।

Exit mobile version