সরকারের উচ্চপদস্থ একজন কর্মকর্তা টিবিএসকে জানান, সঞ্চয় অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার বন্ড বিধিমালার ভুল ব্যাখ্যায় নিরাশজনক আর্থিক এ জটিলতা তৈরি হয়েছে।
এ বিষয়ে সঞ্চয় অধিদপ্তরের পরিচালক (নীতি, অডিট ও আইন) মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট ও প্রিমিয়াম বন্ড বিষয়ক যে বিধিমালা রয়েছে, সেখানে মেয়াদপূর্তির আগে বন্ড ভাঙ্গালে বাংলাদেশি টাকায় মূলধন পরিশোধ করতে হবে এ কথা বলা নেই। বরং, ব্যাংকগুলোকে সেটা বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করারই নির্দেশনা রয়েছে।
‘সঞ্চয় অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তার ভুল ব্যাখ্যায় এরকম পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। ওই কর্মকর্তা এখন লিয়েনে বিদেশে আছেন, তিনি কোনো এক মিটিংয়ের রেফারেন্স দিয়ে এ ধরনের কথা বলেছেন। এরপর কোন কোন ব্যাংক তার সুযোগ নিচ্ছে।’
দুই দশক আগে অনাবাসী বাংলাদেশিদের ডলারে সঞ্চয়ে উৎসাহ দিতে – ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড – নামে প্রবাসীদের জন্য দুটি বন্ড চালু করে বাংলাদেশ সরকার।
কিন্তু, দেশের চলমান অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা ও অব্যাহত ডলার সংকট বন্ডের মেয়াদপূর্তির আগেই অনাবাসীদের তা ভাঙাতে বাধ্য করছে। এতে দেশের বৈদেশিক মুদ্রা সংকট আরও বাজে রূপ নিচ্ছে।
বন্ডের বিধিমালায় বলা হয়েছে, বিনিয়োগের আসল বা মূলধনের অঙ্ক পরিশোধ করতে হবে বৈদেশিক মুদ্রায়। তবে সুদের অর্থ স্থানীয় মুদ্রায় দেওয়া যেতে পারে। অথচ, বিনিয়োগকারীদের সুদ ও আসল দুইই টাকায় পরিশোধ করছে ব্যাংকগুলো।
এই পরিস্থিতিতে মেয়াদপূর্তির আগেই যেসব প্রবাসী বন্ড ভাঙাচ্ছেন তাদের স্থানীয় মুদ্রায় অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে। এ ঘটনা ভবিষ্যতে প্রবাসীদের থেকে আরও বিনিয়োগ আসাকে নিরুৎসাহিত করবে।
এনিয়ে প্রবাসীরা সরকারের উচ্চমহলে আপত্তি তোলায় গত ১২ অক্টোবর অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ থেকে জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরে চিঠি দিয়ে এ দুটি বন্ডে বিনিয়োগ করা অর্থ মেয়াদপুর্তির আগে বিনিয়োগকারী তুলে নিতে চাইলে তা কোন মুদ্রায় পরিশোধ হবে এবং বিনিয়োগকারী তার অর্থ বিদেশে নিয়ে যেতে পারবেন কিনা– তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের যুগ্ম-সচিব (সঞ্চয়) মো. আব্দুল গফুর টিবিএসকে বলেন, ‘এ বিষয়ে সঞ্চয় অধিদপ্তরের মতামত জানতে চেয়ে চিঠি দেওয়া হয়েছে। সঞ্চয় অধিদপ্তর শীঘ্রই তাদের মতামত জানাবে।’
ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড বিধিমালা ২০০২ (২০১২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংশোধিত) এবং ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বিধিমালা ২০০২ (২০১২ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত সংশোধিত) অনুযায়ী, বন্ডের মেয়াদ শেষে মূল অর্থ ক্রেতার বৈদেশিক মুদ্রা হিসাবে (ফরেন কারেন্সি একাউন্ট) পরিশোধ করার নিয়ম রয়েছে।
সঞ্চয় অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, মেয়াদপূর্তির পর বিনিয়োগকারীরা এই অর্থ বিদেশেও নিতে পারবেন। তবে মেয়াদ পুর্তির আগে কেউ বন্ড ভাঙ্গিয়ে ফেললে কোন মুদ্রায় পরিশোধ হবে বা বিদেশে নিতে পারবে কিনা – এ বিষয়ে বিধিমালায় স্পষ্ট করে কিছু বলা নেই।
নাম না প্রকাশের শর্তে সঞ্চয় অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেন, ডলার সংকটের আগে ব্যাংকগুলো মেয়াদ শেষের নিয়ম– মেয়াদপূর্তির আগের ক্ষেত্রেও অনুসরণ করতো, এবং বিনিয়োগের মূল অর্থ বৈদেশিক মুদ্রায় পরিশোধ করতো। কিন্তু চলমান ডলারের সংকটের মধ্যে কোনো গ্রাহক চাইলেই ব্যাংকগুলো তা দিতে চাচ্ছে না। এমনকী গ্রাহক অনুরোধ করলেও না।
এ কারণে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ বিষয়টির ব্যাখ্যা চেয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সম্প্রতি বিদেশে আমানতের সুদহার বেড়ে যাওয়ায় এবং বাংলাদেশের কোনো কোনো ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার সংকটে ভুগছে এমন তথ্য প্রকাশ পাওয়ায়– মার্কিন ডলার বন্ডে বিনিয়োগকারীদের মধ্যে মেয়াদপুর্তির আগে ভাঙ্গিয়ে ফেলার প্রবণতা দেখা দিয়েছে।
বিনিয়োগকারীদের দুর্ভোগ
জানা গেছে, দুবাই, সিঙ্গাপুর থেকে কয়েক ডজন প্রবাসী বাংলাদেশী এ ধরনের সমস্যায় পড়ে অর্থ বিভাগ ও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরে চিঠি দিয়ে সহায়তা চেয়েছে।
গত মে মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাতার সফরের সময় সেখানকার প্রবাসীরা তার কাছে এনিয়ে অভিযোগ করেন। আর গত ১৭ সেপ্টেম্বর ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রীর কাছে এনিয়ে অভিযোগ করেছেন এনআরবি সিআইপি অ্যাসোসিয়েশনের নেতারা।
এরপর প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় প্রবাসীদের বন্ডে বিনিয়োগ সুবিধা বাড়ানো, বিনিয়োগ করা অর্থ সহজে ফেরত পাওয়ার উদ্যোগ নিতে অর্থ মন্ত্রণালয় ও বাংলাদেশ ব্যাংকে চিঠি দিয়েছে বলে জানান প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব ড. আহমেদ মুনিরুছ সালেহীন।
সবশেষ গত ১০ অক্টোবর সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশী রাষ্ট্রদূত মো. আবু জাফর এক চিঠিতে অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগের সিনিয়র সচিব আবু হেনা রহমাতুল মুনিমকেও বিষয়টি অবহিত করেন। রাষ্ট্রদূত চিঠিতে জানিয়েছেন, প্রবাসী বাংলাদেশিদের বন্ডে বিনিয়োগ করা মূল অর্থ ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রায় ফিরিয়ে দিতে অপারগতা প্রকাশ করছে। ফলে প্রবাসী বিনিয়োগকারীদেরকে বালাদেশি টাকায় মূল অর্থ গ্রহণ করতে হচ্ছে।
কোন ব্যাংকগুলো বিধিমালা অমান্য করছে?
জানা গেছে, সোনালী, জনতা ব্যাংকের বিদেশি শাখা এবং কয়েকটি বেসরকারি ব্যাংকের বিদেশি এক্সচেঞ্জ হাউজ থেকে প্রবাসীদের বন্ডে মূল বিনিয়োগের অর্থ বাংলাদেশি টাকায় নিতে প্রস্তাব দেওয়া হচ্ছে।
জনতা ব্যাংকের বিদেশি একটি শাখা সম্প্রতি দুজন প্রবাসীর বন্ডের মূলধন টাকায় ফেরত দেওয়ার জন্য ব্যাংকটির স্থানীয় কার্যালয়ের রেমিট্যান্স শাখাকে চিঠি দিয়েছে।
জনতা ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. আবদুল জব্বারের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে টিবিএসকে বলেন, তিনি বিষয়টি জানেন না। এমনকি এসব বন্ডের বিনিয়োগ মেয়াদপূর্তির আগে তুলে নিতে চাইলে কোন মুদ্রায় পরিশোধ করা হয়, সে বিষয়েও অবহিত নন।
তবে সোনালী ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘মেয়াদপূর্তির আগে বন্ড ভাঙ্গিয়ে নিতে চাইলে ক্রেতাকে বাংলাদেশি টাকায় মূলধন ফেরত দেওয়া হবে। সঞ্চয় অধিদপ্তর এ বিষয়ক যে অনলাইন সিস্টেম দাঁড় করিয়েছে সেখানেই বাংলাদেশি টাকায় পরিশোধের বাধ্যবাধকতা রাখা হয়েছে।’
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র মো. মেজবাউল হক এ বিষয়ে টিবিএসকে বলেন, ‘এসব বন্ড ইস্যু ও ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও জাতীয় সঞ্চয় অধিদপ্তরের। এর নীতিমালা, বিধিবিধান সবই অভ্যন্তরীণ তাদের করা। বাংলাদেশ ব্যাংক ও অন্যান্য তফসিলি ব্যাংক শুধুমাত্র বন্ডের লেনদেন প্রক্রিয়ায় জড়িত। ফলে মেয়াদ শেষে বা মেয়াদ শেষের আগে বন্ড ভাঙ্গালে মূলধন কোন মুদ্রায় পরিশোধ করা হবে– সেটি নির্ধারণের কাজও অভ্যন্তরীণ সম্পদ বিভাগ ও সঞ্চয় অধিদপ্তরের।’
কমছে বন্ডে বিনিয়োগ
১৫ অক্টোবর পর্যন্ত ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড- এ প্রবাসীদের বিনিয়োগ স্থিতি দাঁড়িয়েছে ৩৮৭.৬১ কোটি টাকা। আর ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড- এ বিনিয়োগ স্থিতির পরিমাণ ৯২৭.৯৯ কোটি টাকা।
২০২২-২৩ অর্থবছরে ইউএস ডলার ইনভেস্টমেন্ট বন্ড বিক্রি হয়েছিল ৩৭৩ কোটি টাকা। ওই অর্থবছরে গ্রাহকরা এই বন্ড ভাঙ্গিয়ে (মেয়াদপুর্তির পরে ও আগে) ৭৭১.৯৮ কোটি টাকা তুলে নেন।
একইভাবে গত অর্থবছরে ইউএস ডলার প্রিমিয়াম বন্ড বিক্রি হয় ৯১.৫৫ কোটি টাকার। আর এই বন্ড ভাঙ্গানো হয়েছিলো ৮৭.৫৭ কোটি টাকার।
উভয় বন্ডেরই মেয়াদ তিন বছর। ইনভেস্টমেন্ট বন্ড এর সুদহার মেয়াদ ও স্লাব অনুযায়ী, ২ থেকে ৬.৫ শতাংশ পর্যন্ত। আর প্রিমিয়াম বন্ডের সুদহার মেয়াদ ও স্লাব অনুযায়ী, ২.৫০ থেকে ৭.৫০ শতাংশ পর্যন্ত।
এসব বন্ডে বিনিয়োগের ঊর্ধ্বসীমা নেই। তবে ৫ লাখ ডলারের বেশি বিনিয়োগে সুদহার সবচেয়ে কম। বাংলাদেশের যেকোনো ব্যাংকের অনুমোদিত ডিলার (এডি) শাখা এবং ব্যাংকগুলোর বিদেশে অবস্থিত শাখা, এক্সচেঞ্জ হাউজ বা এক্সচেঞ্জ কোম্পানি থেকে এসব বন্ড কেনা ও ভাঙ্গানো যায়।
বিনিয়োগের আগ্রহ হারাচ্ছেন প্রবাসীরা
বাংলাদেশে প্রবাসীদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন এনআরবি সিআইপি এসোসিয়েশন বলছে, বন্ড ভাঙ্গানোর সময় ব্যাংকগুলো বৈদেশিক মুদ্রা না দেওয়ায় প্রবাসীরা বিনিয়োগের আগ্রহ হারাচ্ছে। এতে হুন্ডি ব্যবহারের প্রবণতা বাড়ছে- যা অর্থ লেনদেনের অবৈধ মাধ্যম।
এ বিষয়ে এনআরবি সিআইপি এসোসিয়েশনের উপদেষ্টা ও এনআরবিসি ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান পারভেজ তমাল টিবিএসকে বলেন, বন্ডে বিনিয়োগ করা মূলধন বাংলাদেশি টাকায় পরিশোধ করা হলে প্রবাসীরা বিভিন্ন সমস্যায় পড়েন। এটা চুক্তি ভঙ্গও। প্রথমত এই টাকা বিদেশে ফেরত নিতে অনেক ধরনের জটিলতার মধ্যে পড়তে হয়। দ্বিতীয়ত ডলারে রুপান্তর করতে গিয়ে বিনিময় হারে লোকসান হয়। এজন্য নিয়ম অনুযায়ী, বন্ডে বিনিয়োগ করা মূলধন বৈদেশিক মুদ্রায় প্রবাসীর এফসি অ্যাকাউন্টে জমা করার দাবি জানাচ্ছেন প্রবাসীরা।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে নিযুক্ত বাংলাদেশি রাষ্ট্রদূতও এমন মনে করছেন।
তিনি এনবিআর চেয়ারম্যানকে লেখা চিঠিতে বলেছেন, প্রবাসীরা বন্ডে বিনিয়োগ করা মূলধন বাংলাদেশি টাকায় পেয়ে তা অবৈধ পন্থায় অর্থাৎ হুন্ডির মাধ্যমে (ডলার কিনে) পুনরায় বিদেশে নিয়ে যাচ্ছেন।
অগ্রণী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের চেয়ারম্যান জায়েদ বখত এবিষয়ে টিবিএসকে বলেন, ‘কেউ বৈদেশিক মুদ্রায় বন্ড কিনলে, তাকে একই মুদ্রায় মূলধন ফেরত দিতে হবে। তবে বিধিমালাতে এ বিষয়টি পরিস্কার করা উচিত, যাতে কেউ অষ্পষ্টতার সুযোগ না নেয়।’