- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ২১ নভেম্বর ২০২০
প্রিয় শামীম ভাই, তথা এস এম গোলাম কিবরিয়া ভাই, আমাদের শত কোটি সালাম ও শুভাশিস জানবেন। আমরা অতীব দুঃখের সাথে লক্ষ করলাম, একটি আজেবাজে পত্রিকায় আপনার কারাবাস সম্পর্কে মিথ্যা, উদ্দেশ্যমূলক, অমানবিক, নিষ্ঠুর রিপোর্ট করার পরিপ্রেক্ষিতে সদাশয় সরকার আপনার চরম অসুস্থতা উপেক্ষা করে আপনাকে বিএসএমএমইউ হাসপাতাল থেকে ফের কারাগারে পাঠিয়েছে। সংশ্লিষ্ট পত্রিকার এমন অমানবিক কর্মকাণ্ডের জন্য আমরা পত্রিকাটির সম্পাদকের বিরুদ্ধে সারা দেশে এক হাজার মানহানির মামলা করব এবং এর সম্পাদককে প্রতি জেলার ঘোলা পানি খাইয়ে ছাড়ব। এ ছাড়াও আমরা পত্রিকার সম্পাদক, প্রকাশক, রিপোর্টার- এমনকি হকারদের বিরুদ্ধেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করব। ব্যাটারা ঘুঘু দেখেছে, ফাঁদ তো দেখেনি। এবার জি কে শামীম ভাই তাদের ফাঁদ দেখিয়ে ছাড়বেন।
যা হোক, কিছু লোকের আনাড়িপনা আর বেঈমানির কারণে আপনার মসৃণ চলার পথ খানিকটা বাধাগ্রস্ত হয়েছে। ক্যাসিনো বাণিজ্যে সহযোগী ছিলেন বটে, কিন্তু আপনি তো সরাসরি সে বাণিজ্যে যুক্ত ছিলেন না। আপনি হলেন কিংবদন্তি নির্মাতা, বিল্ডার। হাজার হাজার কোটি টাকার কারবার আপনার। আপনি কৌশলী মানুষ। হাজার হাজার কোটি টাকার টেন্ডার বাগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু কেউ বলতে পারবে না, আপনি সিমেন্টের বদলে মাটি দিয়েছেন, রডে ফাঁকি দিয়েছেন। দামটা একটু বেশি নিয়েছেন, এই যা। কিন্তু দাম বেশি কে না নিচ্ছে? বালিশ কেনা হয়েছে পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে। পর্দা কেনা হয়েছে ৬৭ লাখ টাকা দিয়ে। তারা বেশি নেয়নি? অনেকে আবার কার্টন জমা দিয়ে কোটি কোটি টাকার বিল তুলে নিয়েছে। আপনি তো তা করেননি। আপনার তৈরি করা বহুতল ভবনগুলো ঠিকই দাঁড়িয়ে আছে। কোনো বাপের ব্যাটা থাকলে বলুক, এখানে কোনো ভবনই নির্মিত হয়নি। জি কে শামীম ভবন চুরি করেছে।
কিন্তু আপনার কাজ বন্ধ করে দিয়ে সরকার মারাত্মক ভুল করেছে। কে যে সরকারকে কী বোঝায়, বলতে পারি না। ঠিক আছে, যদি আপনি বিল বেশি নিয়ে থাকেন, তা হলে বাড়তি টাকাটা চাইলে নিশ্চয়ই দিয়ে দিতেন। দু-চার শ’ কোটি টাকা আপনার হাতের ময়লা ছিল। এখন সরকারি কাজ বন্ধ। নির্দিষ্ট সময়ে নির্মাণকাজ শেষ হবে না। আপনাকে ছাড়া কেমন করে হবে? দেখবেন, ওই আজেবাজে পত্রিকাগুলো বলতে শুরু করবে- নির্দিষ্ট সময়ে প্রকল্পের কাজ শেষ হলো না। এসব কাজ সম্পন্ন করতে প্রকল্প ব্যয় বাড়বে। তাতে সরকারের ক্ষতি বৈ লাভ হবে না। আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস, সরকার ওসব অসম্পূর্ণ কাজ শেষ করতে আপনাকে ডাকল বলে।
হে মহৎপ্রাণ শামীম ভাই, কিছু জুয়াড়ির অপরিণামদর্শী ঢিলেঢালা কাজের জন্য তাদের সাথে আজ আপনাকেও কারাগারে যেতে হয়েছে। স্বীকার করতে হবে, তারা রাজনীতিতে আপনার চেয়ে প্রভাবশালী ছিলেন। কিন্তু একটা বিষয় তো আপনি মানবেন, তাদের পেছনেও যে শক্তি আছে, আপনার পেছনে আছে তার চেয়েও বড় শক্তি। আপনার কলিজা বড়। এক চিফ ইঞ্জিনিয়ারকেই আপনি দেড় শ’ কোটি টাকা ঘুষ দিয়েছেন। তারা সবাই তো নিকমহারামি করেননি। ওই ইঞ্জিনিয়ার টাকাটা একা খাননি। দিয়ে থুয়েই খেয়েছেন। সেসব তো ওয়ার্ক করেছে। একেবারে কোনো কাজ দেননি, তা তো বলা যাবে না। কাজ দিয়েছেন। আর সে কারণে যুবলীগ নেতা সম্রাটের মতো আপনিও হাসপাতালে ঠাঁই পেয়েছিলেন।
জি কে ভাই, আপনার জন্য আমরা সাগরেদরা কিছুই করিনি, তা কিন্তু বলতে পারবেন না। আপনার যে সব টাকা-পয়সা আমাদের কাছে রয়েছে, তার হদিস কেউ জানে না। সবাই মনে করছে, শামীমের সব কিছু তো জব্দ। কিন্তু আমরা আছি না? আর সেভাবেই আপনি কারাগারের নামে বিএসএমএমইউতে ভিআইপি সেবাও পাচ্ছিলেন। আমরাও আপনার নগদ টাকা সিন্দুকে লুকিয়ে রেখেছি এবং আপনার নির্দেশমতো একে ওকে দিচ্ছি।
ভাই মনে কষ্ট নেবেন না। আপনি যে শামীম ছিলেন, এখনো তাই আছেন। আপনার প্রভাবকে আশা করি ছোট করে দেখবেন না। যেমন, ক্যাসিনোকাণ্ডে আপনাকে গ্রেফতার করা হলো। আপনার বাসায় পাওয়া গেল শত শত কোটি টাকার এফডিআর। নগদ কোটি কোটি টাকা। মদের বোতল। তাতে কী? মদ বড় লোকে খাবে, নাকি ফহিন্নির পুতেরা খাবে? আপনি নিজে বড় লোক। বড় লোকদের আসর বসিয়ে মদ পান করতেন। তাতে দোষের কিছু ছিল না।
হাতের ব্যথার কথা বলে হাসপাতালে এসেছিলেন গত ৫ এপ্রিল, প্রায় আট মাস আগে। সেখানে আপনাকে এই আট মাস ধরে ভিআইপি সেবা দেয়া হয়েছে। চিকিৎসা শেষে ৭ এপ্রিলই আপনাকে কেরানীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে ফেরত পাঠানোর কথা ছিল; কিন্তু আর কি নিতে পারে? হাসপাতালে আপনার নিরাপত্তার জন্য কারাকর্তৃপক্ষের রয়েছে বিশেষ ব্যবস্থা। আপনাকে হাসপাতাল থেকে কারাগারে ফেরত নেয়ার জন্য কারা কর্তৃপক্ষ হাসপাতাল প্রশাসনকে ১২ বার চিঠি দিয়েছে। কিন্তু আপনাকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষ থেকে বের করে নিতে পারেনি। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ কারা প্রশাসনকে কোনো সন্তোষজনক জবাব দিতে পারেনি এ ব্যাপারে।
জি কে শামীমের অসুস্থতার বিষয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের চিকিৎসক মাহমুদুল হাসান বলেছেন, ‘আট মাস আগে আমরা তাকে চিকিৎসার জন্য পাঠিয়েছিলাম। এখন শুনি, তার প্রেসারসহ নানা রোগ। আমরা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ জানিয়েছি তাকে ফেরত পাঠানোর জন্য। ফেরত না পাঠালে আমরা কী করতে পারি?’ কারা অধিদফতরের একটি সূত্র বলেছে, শামীমকে হাসপাতালে পাঠাতে উচ্চপর্যায়ের তদবির ছিল। এখনো তাকে আরাম-আয়েশে হাসপাতাল রাখার জন্য প্রভাবশালীদের অনুরোধ রয়েছে। সাবেক আইজি প্রিজন এ কে এম মোস্তফা কামাল পাশার সুপারিশে জি কে শামীমকে চিকিৎসার জন্য হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।
শামীম ভাই, এসব থেকেও অনুমান করতে পারেন, সবাই আপনাকে ছেড়ে যাননি। আপনার সুবিধাভোগীদের অনেকেই এখনো আপনার পাশে রয়েছেন। সর্বশেষ গত ৯ নভেম্বর কারা কর্তৃপক্ষ ফের হাসপাতাল প্রশাসনকে চিঠি দেয়, জি কে শামীমকে কারাগারে ফেরত পাঠানো হোক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলসুপার সুভাষ কুমার ঘোষ বলেন, ‘চিকিৎসার জন্য আমরা পাঠালেও ফেরত দেওয়ার দায়িত্ব হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের। আমরা প্রত্যেক মাসে চিঠি দিচ্ছি এই বন্দীকে ফেরত পাঠাতে। আমরা আর কী করতে পারি?’ প্রিয় শামীম ভাই, আপনি ঘাবড়াবেন না। আপনার সহযোগী যুবলীগ নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাটও চিকিৎসার নামে প্রায় এক বছর এই হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষে আরাম-আয়েশে কাটিয়ে গেছেন। ধৈর্য ধরুন। আমরা শিগগিরই অন্য আরেকটা গুরুতর অসুখের নাম করে আপনাকে ফের বিএসএমএমইউ হাসপাতালের শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কক্ষের আরাম-আয়েশের মধ্যে ফিরিয়ে আনব। এবার সবাই মিলে স্লোগান ধরো, ‘জেলের তালা ভাঙব, শামীম ভাইকে আনব।’
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com