![প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হয়তো আগামী ফেব্রুয়ারিতে হতে যাওয়া জার্মানির নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন।](https://images.prothomalo.com/prothomalo-bangla%2F2024-12-23%2Fj4v8onoh%2Fzelenoskyll.jpg?rect=40%2C0%2C720%2C480&auto=format%2Ccompress&fmt=webp)
এক বছর আগে মৃত্যুবরণ করা মার্কিন কূটনীতিক হেনরি কিসিঞ্জার ১৯৮০-এর দশকে ইরাক-ইরান যুদ্ধ নিয়ে বলেছিলেন, তিনি চান দুই পক্ষই যাতে যুদ্ধে হেরে যায়। ২০২৪ সাল শেষ হতে চলেছে, সবাই নতুন বছরের ২০ জানুয়ারি হোয়াইট হাউসে ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের প্রস্তুতি নিচ্ছে, এ অবস্থায় ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধের জন্য ভয়ংকর উপযুক্ত সমাধান যেটি মনে হচ্ছে, দুই পক্ষই যেন হেরে যায়।
গত ১২ মাসে ভয়াবহ সংঘাতে দুই পক্ষই ভীষণ ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। কেউই বড় কোনো অর্জন করতে পারেনি। রাশিয়ার সেনাবাহিনী পূর্বাঞ্চলে সামান্য কিছুটা ভূখণ্ড জয় করতে পেরেছে।
ইনস্টিটিউট অব ওয়্যার স্টাডিজের ডিসেম্বর মাসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এ বছর রুশ বাহিনী ২ হাজার ৭০০ বর্গকিলোমিটার ভূমি নিজেদের দখলে নিতে পেরেছে। গত বছরের তুলনায় ৪৬৫ বর্গকিলোমিটার বেশি। কিন্তু ইউক্রেনের মোট ভূমির তুলনায় এটা কেবলমাত্র শূন্য দশমিক ৪ শতাংশ।
এই সামান্য ভূমি দখলে নিতে ইউক্রেনে সাড়ে তিন লাখ রুশ সেনা হতাহত হয়েছে। যুক্তরাজ্যের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নভেম্বর মাসে বলেছিল, প্রতিদিন রাশিয়া গড়ে ১ হাজার ৫০০ সেনা হারাচ্ছে। এটা ২০২২ ও ২০২৩ সালের তুলনায় শোচনীয়। মিডিয়ায় ভাষ্যকারেরা নিয়মিত বলে যাচ্ছে, ইউক্রেনের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়েছে; কিন্তু বাস্তবে সেটি হচ্ছে না।
পক্ষান্তরে রাশিয়ায় ইউক্রেন স্থল অভিযান শুরু হয় এ বছর আগস্ট মাসে। সীমান্ত পেরিয়ে ইউক্রেনীয় সেনারা রাশিয়ার কুরস্ক অঞ্চলের ১ হাজার ৪০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা দখলে নেয়। ইউক্রেনীয় বাহিনীকে হটাতে রাশিয়া সেখানে ১২ হাজার উত্তর কোরীয় ভাড়াটে সেনাসহ মোট ৫০ হাজার সেনা পাঠায়। এখন পর্যন্ত সেটি করতে সফল হয়নি তারা। তবে ইউক্রেনীয় বাহিনীর দখলে নেওয়া ভূমি প্রায় ৮০০ বর্গকিলোমিটার সংকুচিত হয়ে গেছে।
এ ছাড়া সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দুই দেশই একে অপরের দেশের অনেকে ভেতরে আক্রমণ করে চলেছে। রাশিয়া ইউক্রেনের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ অবকাঠামোয় এবং শহরগুলোতে হামলা অব্যাহত রেখেছে। অন্যদিকে ইউক্রেন রাশিয়ার অস্ত্র ভান্ডার, তেল শোধনাগার ও সামরিক বাহিনীর নেতৃত্ব লক্ষ্য করে হামলা করে যাচ্ছে।
এই যুদ্ধে রাশিয়া কিংবা ইউক্রেন কেউই সুবিধাজনক অবস্থানে নেই। দুই পক্ষই আশা করছে নতুন বছরের প্রথম দিকে বিশ্বের কিছু রাজনৈতিক পরিবর্তনে তারা সুবিধা পাবেন। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন হয়তো ডোনাল্ড ট্রাম্পের অভিষেকের জন্য অপেক্ষা করে আছেন। এর কারণ হলো পুতিন ভাবছেন, মার্কিন কংগ্রেস ইউক্রেনকে নতুন অস্ত্রের দেওয়ার অনুমোদন দেবে না।
ইউক্রেনের অস্তিত্বের লড়াইয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বীরের মতো লড়াই করেছেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতাও। কিন্তু ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসনের কারণে দেশটিতে সামরিক শাসন জারি করেন জেলেনস্কি। ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচন স্থগিত করতে হয়েছে। এ কারণে পুতিন দাবি করে বসতে পারেন চুক্তি করার জন্য জেলেনস্কির বৈধতা নেই।
প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি হয়তো আগামী ফেব্রুয়ারিতে হতে যাওয়া জার্মানির নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে আছেন। জরিপ বলছে, ওলাফ শলৎজকে হারিয়ে ক্রিস্টিয়ান ডেমোক্রেটিক পার্টির ফ্রেডরিখ মার্জ ক্ষমতায় আসতে পারেন। ইউক্রেনের আরও বড় একজন সমর্থক ফ্রেডরিখ।
সাম্প্রতিক যে রাজনৈতিক পরিবর্তন তাতে মিত্র হারিয়ে প্রেসিডেন্ট পুতিন দুর্বল হয়ে পড়েছে। সিরিয়ার বাশার আল-আসাদের পতনের কারণ হলো, তার মূল পৃষ্ঠপোষক ইরান ও রাশিয়ার সামরিক হস্তক্ষেপ করার অক্ষমতা।
দুই পক্ষই এখন শান্তি আলোচনার জন্য যে শর্ত দিচ্ছে, দুই পক্ষের জানতে হবে যে সেটা অবাস্তব। ১৯ ডিসেম্বর বার্ষিক সংবাদ সম্মেলনে পুতিন দাবি করেন যে তিনি সমঝোতা করতে আগ্রহী; কিন্তু সেটি শুরু হতে হবে যে পয়েন্টের ওপর ভিত্তি করে, সেটি হলো ইউক্রেনের সেনাবাহিনীকে ভেঙে দেওয়া এবং রাশিয়ার ভূখণ্ডগত দাবির পূর্ণ স্বীকৃতি।
একই দিন ব্রাসেলসে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও ন্যাটো নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে জেলেনস্কি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর নিরাপত্তা গ্যারান্টি এবং ন্যাটোয় ইউক্রেনের সদস্যপদ দেওয়া হলেই কেবলমাত্র একটি চুক্তি সম্ভব।
সমঝোতার আলোচন সব সময় অযৌক্তিক ও অবাস্তব দাবি দিয়ে শুরু হয়। আগামী বছর যদি সমঝোতার বাস্তব আলোচনা শুরু হয় তাহলে কিছু অস্বাভাবিক পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে পারে। দর–কষাকষি করার ক্ষেত্রে ইউক্রেন রাশিয়ার চেয়ে শক্তিশালী অবস্থানে থাকবে; কিন্তু ইউক্রেন যাতে সবচেয়ে ভালো ফল বের করে আনতে পারে, সে জন্য প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কিকে তার পদ থেকে সরে যেতে হতে পারে।
ইউক্রেনের অবস্থান অপেক্ষাকৃত শক্তিশালী বলে মনে হচ্ছে। তার কারণ, ডোনাল্ড ট্রাম্প দেখছেন যে সিরিয়ার রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে রাশিয়াও দুর্বল হয়েছে। এ অবস্থায় স্বঘোষিত শান্তি আলোচনার মধ্যস্থতাকারী রাশিয়াকে একটা সহজ লক্ষ্যবস্তু হিসেবে দেখবে।
জানুয়ারির মধ্যে ইউক্রেনের গোয়েন্দারা ও সামরিক বাহিনী যদি রুশ জেনারেলের গুপ্তহত্যার মতো আরও কিছু বিস্ময় জাগানিয়া অভিযান পরিচালনা করতে পারে, তাহলে রাশিয়ার অবস্থান আরও দুর্বলতর হবে।
ট্রাম্প এটা ভালো করেই বুঝতে পারবেন যে ইউক্রেনকে দূরপাল্লার অস্ত্র সরবরাহ করার বিষয়টি পুতিনের বিরুদ্ধে দর–কষাকষির ভালো হাতিয়ার।
তবুও ন্যাটোয় ইউক্রেনকে যোগদানের অনুমতি দেওয়া, এমনকি যোগদানের আকাঙ্ক্ষা, ট্রাম্পের জন্য দূরবর্তী একটা পদক্ষেপ হবে। কারণ, এটি ইউরোপের প্রতিরক্ষায় আমেরিকার বাধ্যবাধকতা হ্রাস করার জন্য ট্রাম্পের দীর্ঘদিনের আকাঙ্ক্ষার বিরুদ্ধে যায়।
ইউক্রেনকে নিরাপত্তা গ্যারান্টি দেওয়ার বিষয়টির সঙ্গে ট্রাম্প একমত হবেন না। সে ক্ষেত্রে ন্যাটোর ইউরোপীয় সদস্য জার্মানি, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য, ইতালি বা পোল্যান্ড এই ধরনের গ্যারান্টি দিতে সক্ষম কি না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকেই যায়।
ইউক্রেনের অস্তিত্বের লড়াইয়ে প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বীরের মতো লড়াই করেছেন। তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় নেতাও। কিন্তু ২০২২ সালে ইউক্রেনে রাশিয়া আগ্রাসনের কারণে দেশটিতে সামরিক শাসন জারি করেন জেলেনস্কি। ফলে ২০২৪ সালের নির্বাচন স্থগিত করতে হয়েছে। এ কারণে পুতিন দাবি করে বসতে পারেন চুক্তি করার জন্য জেলেনস্কির বৈধতা নেই।
- বিল এমোত, দ্য ইকোমিস্ট–এর সাবেক প্রধান সম্পাদক
এশিয়া টাইমস থেকে নেওয়া, ইংরেজি থেকে অনূদিত