স্টাফ রিপোর্টার
২৩ জুলাই ২০২৫, বুধবার
তিনি শিক্ষক। তিনি মা। সন্তানতুল্য শিক্ষার্থীদের জন্য জীবন দিয়ে মানবিকতার অনন্য দৃষ্টান্ত রেখে গেলেন মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষক মাহরীন চৌধুরী। সোমবার যখন স্কুলে বিমান দুর্ঘটনার ঘটনা ঘটে তখন তিনি একটি শ্রেণিকক্ষে ক্লাস নিচ্ছিলেন। দুর্ঘটনাস্থল থেকে নিজে নিরাপদে বের হয়ে যেতে পারতেন। কিন্তু সেটি না করে অন্তত ২০ শিক্ষার্থীকে আগুন থেকে বের করে আনেন। শিক্ষার্থীদের জীবন বাঁচাতে গিয়ে নিজেই দগ্ধ হন তিনি। শরীরের ১০০ শতাংশই পুড়ে যায় তার। ওইদিন রাতেই রাজধানীর জাতীয় বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। শিক্ষক মেহরীনের এমন মহানুভবতা দেশ-বিদেশে আলোচিত হচ্ছে এখন। ৪৪ বছর বয়সী মাহরীন কলেজের প্রাইমারি সেকশনের শিক্ষক ছিলেন। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন তার শরীরের ১০০ শতাংশ পুড়ে গেছে। সোহেল হোসেন নামে মেহরীনের এক আত্মীয় জানান, তিনি (মাহরীন) অনেক শিক্ষার্থীকে নিরাপদে সরিয়ে নিতে পেরেছিলেন, কিন্তু নিজে আর বের হতে পারেননি। শরীরের একটা অংশে আগুন ধরে গিয়েছিল।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মাইলস্টোন কলেজের শিক্ষার্থী আরমান খান মোস্তফা, প্রলয় হাওলাদার ও আফজাল হোসেন। যারা কোনোভাবেই ভুলতে পারছেন না মর্মান্তিক এই ঘটনা। অগ্নিকাণ্ডের সময় তারা পাশের বিল্ডিংয়ে ছিলেন। এসব শিক্ষার্থী বলেন, প্রশিক্ষণ বিমানটি প্রজেক্ট ২ ভবনের মাঝ বরাবর আঘাত হানে। মাহরীন চৌধুরী ম্যাডাম কর্নারের একটি রুমে ক্লাস নিচ্ছিলেন। এ সময় শিক্ষার্থীরা বিচলিত হয়ে ওঠে। ভবনের কোণায় ছোট খোলা গ্রিলের মতো একটা ফাঁকা জায়গা রয়েছে। তিনি দগ্ধ, আহত, ভীত বাচ্চাদের কোলে করে বের করে উদ্ধারকারীদের কাছে দিচ্ছিলেন। তিনি চাইলেই সেখান দিয়ে বের হয়ে আসতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা না করে শিক্ষার্থীদের বের করে উদ্ধারকারীদের কাছে দেন। এরপর হঠাৎ আগুনের একটা হাওয়া স্রোতের মতো তার দিকে ছুটে আসে। প্রথমে তিনি ধোঁয়ার কারণে অস্বস্তিতে ভোগেন। কাশতে শুরু করেন। এই অবস্থাতেই এক শিক্ষার্থীকে বাইরে বের করে দেন। এরপর ধোঁয়ার কারণে হয়তো তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন বা শক্তি হারিয়ে মাটিতে পড়ে যান। এরপর তার শরীরে আগুন লাগে।
এদিকে শিক্ষক মাহরীন চৌধুরীকে নীলফামারীর বাড়ির পারিবারিক কবরে বাবা-মায়ের পাশে দাফন করা হয়েছে। গতকাল বেলা সাড়ে ৩টায় মরহুমার জানাজা গ্রামের বাড়ি জলঢাকা উপজেলার বগুলাগাড়ী গ্রামে বগুলাগাড়ী স্কুল অ্যান্ড কলেজ মাঠে অনুষ্ঠিত হয়। তার জানাজায় উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জায়িদ ইমরুল মোজাক্কিনসহ স্থানীয় বিএনপি ও জামায়াত নেতারা ও শত শত মানুষ অংশ নেন। জানাজায় ইমামতি করেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম মাওলানা মুনাব্বিরুল হক। মাহরীন চৌধুরী মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের বাংলা ভার্সনের কো-অর্ডিনেটর (তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণি) ছিলেন। এর আগে গত সোমবার (২১শে জুলাই) অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের বার্ন ইউনিটে নেয়া হলে সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় রাত সাড়ে ৭টায় তিনি মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। তার স্বামী মনসুর হেলাল জানান, তার স্ত্রী ইচ্ছা করলে প্রাণে বাঁচতে পারতেন। কিন্তু সে তা না করে তার শিক্ষার্থীদের বাঁচাতে মরণপণ চেষ্টা করেন। শ্রেণিকক্ষের ভেতরে আটকে পড়া কোমলমতি শিক্ষার্থীদের একের পর এক টেনে বের করে আনেন। এক পর্যায়ে অগ্নিদগ্ধ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। উল্লেখ্য, মাহরীন চৌধুরী শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমানের খালাতো ভাই মহিদুর রহমান চৌধুরীর কন্যা ছিলেন বলে জানা যায়।