Site icon The Bangladesh Chronicle

জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের ‘জিরো পারফরম্যান্স’ কেন

নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে শহীদ নূর হোসেন চত্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় গণতন্ত্র মঞ্চ। এছাড়া আরও কয়েকটি সংগঠনের উপস্থিতি ছিল সেখানে। কিন্তু সেখানে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি ছিল না।
সারফুদ্দিন আহমেদ
নূর হোসেন দিবস উপলক্ষে শহীদ নূর হোসেন চত্বরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানায় গণতন্ত্র মঞ্চ। এছাড়া আরও কয়েকটি সংগঠনের উপস্থিতি ছিল সেখানে। কিন্তু সেখানে আওয়ামী লীগের উপস্থিতি ছিল না।ছবি: সাজিদ হোসেন

শেখ হাসিনা ভারতে। তাঁর মেয়ে সায়মা ওয়াজেদ পুতুল ভারতে; ছেলে সজিব ওয়াজেদ জয় আমেরিকায়; বোন শেখ রেহানা হয় ভারতে নয়তো যুক্তরাজ্যে (তাঁর অবস্থান পরিষ্কার নয়) ; শেখ রেহানার ছেলে রেদওয়ান মুজিব সিদ্দিক ববি বাংলাদেশের বাইরে (তবে কোথায় তা অজানা) ; রেহানার বড় মেয়ে ব্রিটিশ এমপি টিউলিপ সিদ্দিক ও ছোট মেয়ে আজমিনা সিদ্দিক রূপন্তী যুক্তরাজ্যে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছোট ভাই শেখ আবু নাসেরের পাঁচ ছেলের মধ্যে শেখ হেলাল ও শেখ জুয়েল গত সংসদেও সদস্য ছিলেন। শেখ হেলালের ছেলে শেখ তন্ময়ও গত দুই সংসদের সদস্য ছিলেন। হেলাল ও তাঁর ছেলে তন্ময় এখন ভারতে। হেলালের অন্য ভাইয়েরা শেখ জুয়েল, শেখ সোহেল, শেখ রুবেল ও শেখ বেলাল (দেশে বা দেশের বাইরে) আত্মগোপনে আছেন।

শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই শেখ সেলিম; শেখ সেলিমের দুই ছেলে শেখ ফজলে ফাহিম ও শেখ ফজলে নাইম আত্মগোপনে; শেখ সেলিমের ভাই শেখ ফজলুল হক মনির এক ছেলে ঢাকা দক্ষিণ সিটির মেয়র শেখ ফজলে নূর তাপস সরকার পতনের দুই দিন আগে সিঙ্গাপুর হয়ে দেশ ছেড়েছেন; তাপসের ভাই শেখ ফজলে শামস পরশও দেশের বাইরে।

শেখ সেলিমের ছোট ভাই শেখ মারুফ সিঙ্গাপুরে, শেখ সেলিমের ভগ্নিপতি যুবলীগের সাবেক চেয়ারম্যান ওমর ফারুক চৌধুরীও আত্মগোপনে; শেখ হাসিনার ফুফাতো ভাই আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ ভারতে; তাঁর ছেলে সাদিক আবদুল্লাহ ও ভাই আবুল খায়ের আব্দুল্লাহও কোথায় আছেন, তা জানা যাচ্ছে না।

তবে যদ্দুর জানা যাচ্ছে, শেখ পরিবারের সদস্যদের অধিকাংশ দেশের বাইরে আছেন। নিরাপদ আছেন। ভালো আছেন।

আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগের এক সময়কার প্রচণ্ড প্রভাবশালী যেসব নেতা রাজপথ দখলে রাখতেন, মাঝে মাঝেই ‘খেলা হবে’ বলে হুমকি ধামকি দিতেন, তাদেরও বেশির ভাগ নেতা দেশের বাইরে আছেন। নিরাপদ আছেন। ভালো আছেন।

৫ আগস্টের পর এই নেতারা প্রকাশ্যে নিজেদের চেহারা দেখাতে চাননি। হয়তো সে কারণেই তাঁরা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও নিজেদের উপস্থিতির জানান দেন না।

অন্যদিকে, আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের যে নেতারা ১৫ বছর ধরে মাঠ দখলে রেখেছিলেন, কিন্তু নানা কারণে সরকার পতনের পর দেশ ছেড়ে পালাতে পারেননি, তাঁরা এখন মহাবিপদে।

একদিকে, নানা মামলায় জড়ানোর কারণে পুলিশ তাঁদের খুঁজছে; অন্যদিকে, এক সময় তাঁদের হাতে নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হওয়া ভুক্তভোগী লোক এবং বিএনপি, জামায়াতসহ প্রতিপক্ষের লোকজনের সামনে পড়লেই তাঁদের হামলার মুখে পড়তে হচ্ছে।

মোদ্দা কথা, আওয়ামী লীগের মাঠ পর্যায়ের নেতা-কর্মীদের একটা বড় অংশকে এখন পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে। লোকজনের কাছে নিজেকে আওয়ামী লীগের নেতা বা কর্মী পরিচয় দেওয়াই এখন তাঁদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে গেছে।

তো, এই রকম একটা পরিস্থিতির মধ্যে আওয়ামী লীগ তাদের ফেসবুকের ভেরিফায়েড পেজে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারে ১০ নভেম্বর (আজ রোববার) জিরো পয়েন্টে আসার ডাক’ দিয়েছে।

দলের পক্ষ থেকে যখন কোনো কর্মসূচির ঘোষণা দেওয়া হয়, তখন তা দলটির যে কোনো নিবেদিতপ্রাণ কর্মীর জন্য অবশ্য পালনীয় হয়ে ওঠে।

প্রত্যেক দলে এমন কর্মী থাকেন যাঁরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দলের আদেশ পালন করতে যান। সাধারণ কর্মীরা যদি দলের শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে সর্বোচ্চ ত্যাগের মানসিকতা দেখেন, তাহলে তা তাঁদের মধ্যে তীব্র উদ্দীপনার সৃষ্টি করে। তাঁরা তখন প্রবল আবেগে উজ্জীবিত হয়ে দলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে ঝাঁপিয়ে পড়েন।

কিন্তু মাঠের কর্মীরা যদি দেখেন, ওপরের সারির নেতাদের প্রায় সবাই নিজেদের জান মালের সুরক্ষা নিশ্চিত করে, নিরাপদ দূরত্বে গিয়ে ফুট সোলজারদের ‘নির্ভয়ে এগিয়ে যাও’ বলে আদেশ দিচ্ছেন, তখন তাঁদের মধ্যে প্রতারিত হওয়ার অনুভূতি কাজ করে।

তাঁরা যখন দেখেন, তাঁদের নেতারা যে আদর্শ প্রতিষ্ঠার কথা বলছেন, তাঁরা নিজেরাই সেই আদর্শের উল্টো কাজ করতে তাঁদের ব্যবহার করছেন, তখন তাঁরা নৈতিকভাবে ডিমোটিভেটেড হয়ে যান।

তখন তাঁদের জীবনের বাজি ধরে নেতার কথায় এগিয়ে যেতে আর মন চায় না।

আওয়ামী লীগের ফেসবুক পেজে দেওয়া ঘোষণায় বলা হয়েছে, ‘…দেশে গণতন্ত্রের সংকট, অপশাসন, এবং মানুষের মৌলিক অধিকার হরণের বিরুদ্ধে আমাদের এক হতে হবে।…এটি শুধু একটি সমাবেশ নয়, এটি আমাদের আন্দোলন। আমাদের প্রতিবাদ। প্রতিবাদ—দেশের মানুষের অধিকার হরণের বিরুদ্ধে, মৌলবাদী শক্তির উত্থানের বিরুদ্ধে, এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করার চক্রান্তের বিরুদ্ধে—স্বাধীনতা রক্ষার অঙ্গীকার। জয় বাংলা স্লোগানে আপনার শক্তি, আপনার আওয়াজে গর্জে উঠবে বাংলাদেশ। ১০ নভেম্বর, নূর হোসেন চত্বরে, জিরো পয়েন্টে আমাদের সঙ্গে যোগ দিন। একত্রিত হয়ে, এক জোট হয়ে, আমরা প্রমাণ করব গণতন্ত্র, অধিকার এবং স্বাধীনতা কখনো পরাজিত হবে না।’

আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক ও বড় দল। দলটির লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক আছেন। কিন্তু আজকে তাঁরা রাজপথে কেউ নেই। কেন নেই? এর কারণ কি শুধুই বিএনপি-জামায়াতের হাতে মার খাওয়ার ভয়? এর কারণ কি শুধুই পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ভয়? নিশ্চয়ই নয়। কারণ এই ভয় কোনো রাজনৈতিক দলের শতভাগ নিবেদিতপ্রাণ আন্দোলনকর্মীদের রাস্তায় নামা থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না।

এখানে বলা হয়েছে, ‘জয় বাংলা স্লোগানে আপনার শক্তি, আপনার আওয়াজে গর্জে উঠবে বাংলাদেশ’।

এই ‘আপনার শক্তি’ এবং ‘আপনার আওয়াজ’ মানে কার শক্তি? কার আওয়াজ? এই ‘আপনারা’ মানে কি নেতারা? নাকি প্রাণভয়ে পালিয়ে বেড়ানো মাঠ পর্যায়ের কর্মী-সমর্থকেরা?

বলা হয়েছে, ‘আমরা প্রমাণ করব গণতন্ত্র, অধিকার এবং স্বাধীনতা কখনো পরাজিত হবে না।’

এই ‘আমরা’ মানে কারা? এই ‘আমরা’র মধ্যে কি শেখ হাসিনা আছেন? শেখ রেহানা? জয়? পুতুল? ববি? টিউলিপ? রূপন্তী? শেখ হেলাল? শেখ জুয়েল? শেখ তন্ময়? শেখ সোহেল? শেখ রুবেল? শেখ বেলাল? শেখ সেলিম? শেখ ফাহিম? শেখ নাইম? শেখ ফজলে নূর তাপস? শেখ ফজলে শামস পরশ? শেখ মারুফ? ওমর ফারুক চৌধুরী? আবুল হাসনাত আব্দুল্লাহ? সাদিক আবদুল্লাহ? আবুল খায়ের আব্দুল্লাহ? ওবায়দুল কাদের? হাছান মাহমুদ? আরাফাত? শামীম ওসমান?

এরা কেউ কি আছেন?

নেই। এরা কেউ নেই। শেখ পরিবারের কেউ নেই। আওয়ামী লীগের ওপরের সারির কেউ নেই। মাঝের সারির কেউ নেই। এমনকি তলার সারির সামনের দিকের আধা-সিকি নেতাদেরও কেউ নেই।

অথচ দলটি বিরাট ওজনদার এক ঘোষণা দিয়ে বসে আছে।

বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে রোববার বেলা ১১টার কিছু আগে আওয়ামী লীগের সমর্থক বলে একজনকে পেটানো হয়।ছবি: সাজিদ হোসেন

দেশের বাইরে নিরাপদে আছেন, এমন আওয়ামী নেতারা এই ঘোষণার সঙ্গে সংহতি জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের ভার্চুয়াল জগতে বিপুল বিক্রম দেখিয়েছেন।

দুনিয়ার যত ভুয়া ভিডিও ক্লিপিং দিয়ে ‘লাখো জনতা ঢাকার দিকে ধেয়ে আসছে’ বলে গুজবের প্রচার চালিয়েছেন।

দিন শেষে যা হওয়ার তা-ই হয়েছে। জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগের ‘জিরো অবস্থান’ দেখা গেছে।

রাজধানীর বাইরের জেলাগুলোতেও আওয়ামী লীগের নেতা কর্মীদের মাঠে নামতে বলা হয়েছিল। সেখানেও মাঠ ফাঁকা ছিল।

আওয়ামী লীগের ঘোষণার পর শনিবার রাত থেকেই জিরো পয়েন্টে অবস্থান নিয়েছে ‘ছাত্র-জনতা’। রাতে খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে তাঁরা জিরো পয়েন্টে জড়ো হন।

বিকেল তিনটায় জিরো পয়েন্টে আওয়ামী লীগ তাদের কর্মীদের জড়ো হয়ে বিক্ষোভ করতে বলেছিল। কিন্তু বিকেল তিনটায় সেখানে তাঁদের কাউকে দেখা যায়নি।

তবে সকাল এগারোটার দিকে তিন চারজন ব্যক্তি আওয়ামী লীগের কার্যালয়ের সামনে গিয়ে ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে আওয়ামী বিরোধী লোকদের হাতে বেধড়ক মার খেয়েছেন।

আওয়ামী লীগ একটি ঐতিহাসিক ও বড় দল। দলটির লাখ লাখ কর্মী-সমর্থক আছেন। কিন্তু আজকে তাঁরা রাজপথে কেউ নেই। কেন নেই? এর কারণ কি শুধুই বিএনপি-জামায়াতের হাতে মার খাওয়ার ভয়? এর কারণ কি শুধুই পুলিশের হাতে আটক হওয়ার ভয়?

নিশ্চয়ই নয়। কারণ এই ভয় কোনো রাজনৈতিক দলের শতভাগ নিবেদিতপ্রাণ আন্দোলনকর্মীদের রাস্তায় নামা থেকে ফিরিয়ে রাখতে পারে না।

পুলিশ গুলি চালাচ্ছে—তারপরও ছাত্র আন্দোলনকারীদের আমরা বুক পেতে সামনে এগিয়ে যেতে দেখেছি।

আমরা দেখেছি, ‘গুলিতে একটাই মরে, একটাই যায়, বাকিডি যায় না’। যায় না, কারণ আন্দোলনকারীরা মোরালি মোটিভেটেড ছিলেন।

তাঁরা রাজপথে নামাকে নিজের বিবেক তাড়না থেকে মুক্তির উপায় বলে উপলব্ধি করেছিলেন।

এ কারণে দুই হাত প্রসারিত করে আবু সাঈদেরা নিজের বুকে বুলেট বরণ করতে পিছ পা হন না।

আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতৃত্বে থাকা লোকজন নিজেরা কোটি কোটি টাকা লুটপাট করে, অর্থ পাচার করে, পুলিশ-বিডিআর ব্যবহার হাজারের বেশি মানুষ হত্যা করে নিজেদের কর্মী-সমর্থকদের মধ্যে নিজেদের দানবিক ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছেন।

কর্মীরা স্বার্থের জন্য এই নেতাদের তোয়াজ করতেন ঠিকই, কিন্তু শ্রদ্ধা করতেন না। তাঁরা নেতাদের ডাকে এত দিন রাজপথ দখলে রেখে নানা অপকর্ম করেছিলেন। সেই অপরাধবোধ তাঁদের স্বতঃস্ফূর্ত আন্দোলনের চেতনাকে নষ্ট করে দিয়েছে।

দলের জন্য জীবন বাজী রাখার জন্য দলের যে আদর্শিক অবস্থান থাকা দরকার, তা যখন তাঁরা আর খুঁজে পাননি, তখন তাঁরা মোরালি ডিমোটিভেটেড হয়েছেন।

তাঁরা যখন দেখেছেন, দুর্দিনে নেতারা সব পগার পার হয়ে পগারের ওপার থেকে তাঁদের ‘একত্রিত হয়ে, এক জোট হয়ে’ ঝাঁপিয়ে পড়তে বলছেন, তখন তাঁরা বিরক্ত হয়েছেন।

আজ সকালে আওয়ামী লীগের এক কর্মী বন্ধুকে বলেছিলাম, ‘জিরো পয়েন্টে যাচ্ছ তো?’

সে বলল, ‘জেনারেলরা ভাইগ্যা গিয়া আমাগো কয় ঝাঁপায় পড়ো! আমি সোলজার হইতে পারি, বলদ না।’

ওই কর্মীর কথা শুনে বুঝতে পারছি, আওয়ামী লীগকে উঠে দাঁড়াতে হলে দলটির ‘জেনারেলদের’ আগে কর্মীদের কাছে গ্রহণযোগ্য হতে হবে।

তার জন্য দলটিকে অবশ্যই নিজেদের ভুল-ত্রুটি ও অপরাধ স্বীকার করতে হবে। সব ভুলের জন্য, অপরাধের জন্য ক্ষমা চাইতে হবে। সৎসাহস নিয়ে বিচারের মুখোমুখি হতে হবে।

এতে দলটির প্রতি মানুষের ক্ষোভ প্রশমিত হবে। দলটির কর্মীরা অপরাধবোধের গ্লানি থেকে মুক্তি পাবে। জনতার সামনে যাওয়ার সৎসাহস ফিরে পাবে।

তখন কোনো নূর হোসেন দিবসে দলটি কর্মীদের জিরো পয়েন্টে জড়ো হওয়ার আহ্বান জানালে, তাতে তারা জড়ো হবে। বাধা দিলেও হবে। গুলি করলেও হবে।

prothom alo

Exit mobile version