Site icon The Bangladesh Chronicle

জাস্টিন ট্রুডোর নতুন তোপ, ভারত-কানাডা সম্পর্কের উন্নতির লক্ষণ নেই

ট্রুডো এ মন্তব্য করলেন যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের পররাষ্ট্র ও প্রতিরক্ষামন্ত্রীদের বৈঠক শেষ হওয়ার পরই। সেই বৈঠকে কানাডা-ভারত সম্পর্ক স্বাভাবিকীকরণের কোনো ইঙ্গিত পাওয়া যায়নি। ভারতের বিরুদ্ধে সে দেশের নাগরিক হত্যার যে অভিযোগ প্রধানমন্ত্রী ট্রুডো এনেছেন, তার তদন্তে সাহায্যের হাত বাড়ানোর যে অনুরোধ করেছেন, ভারত এখনো তা আমলে নিতে রাজি নয়। যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে সে বিষয়ে কোনো অগ্রগতি হয়নি। এরপরই ট্রুডোর ওই মন্তব্য। স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, কানাডা অবস্থান কঠোরতর করছে।

ওই অনুষ্ঠানে এক প্রশ্নের জবাবে ট্রুডো বলেন, ‘যেদিন আমাদের নাগরিক হত্যার বিশ্বাসযোগ্য তথ্য আমাদের হাতে এসেছে, সেদিন থেকেই আমরা ভারতকে সত্য উদ্‌ঘাটনে সাহায্যের হাত বাড়ানোর কথা বলে আসছি। যুক্তরাষ্ট্রসহ অন্য বন্ধুদেরও বলছি আন্তর্জাতিক আইন ভাঙা ও সার্বভৌমত্ব লঙ্ঘন করার মতো এই গুরুতর বিষয়টি নিয়ে উদ্যোগী হতে। আমরা এই প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখব। যেমন অব্যাহত থাকবে তদন্তের কাজ।’

ভারতের বিরুদ্ধে ভিয়েনা কনভেনশন লঙ্ঘনের সরাসরি অভিযোগ এনে ট্রুডো বলেন, ‘৪০ জন কূটনীতিককে একতরফাভাবে দেশত্যাগের নির্দেশ দেওয়া আমাদের হতাশ করেছে। ওই আচরণ ভিয়েনা কনভেনশনবিরোধী। কানাডার নাগরিককে হত্যায় ভারতের হাত থাকার বিশ্বাসযোগ্য কারণ আমাদের আছে। সেই কারণেই ভারত পাল্টা চাপ দিয়ে ৪০ জন কূটনীতিককে বহিষ্কার করেছে।’ ট্রুডো বলেন, ‘সত্যতা প্রমাণে শক্তির প্রয়োগ করা হলে, বড় রাষ্ট্র ফলাফলের দিকে না তাকিয়ে আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করলে প্রত্যেকের কাছেই পৃথিবীটা বিপজ্জনক হয়ে ওঠে।’

যুক্তরাষ্ট্র-ভারত মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন সম্পর্ক স্বাভাবিক করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর তাঁকে বুঝিয়ে দিয়েছেন, নিরাপত্তাজনিত উদ্বেগ নিরসনে কানাডাকেই বিশেষ উদ্যোগ নিতে হবে। সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়ার ক্ষেত্রে সেটা জরুরি। যুক্তরাষ্ট্র এ ক্ষেত্রে চিন্তিত কারণ, ভারত ও কানাডা দুই দেশই তাদের কাছে সমান গুরুত্বপূর্ণ।

এ অবস্থায় ভারতীয় কূটনৈতিক মহলসহ বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ মনে করছেন, অচিরে সম্পর্ক স্বাভাবিক হওয়া সম্ভব নয়। এর একটা কারণ, আগামী বছর ভারতের লোকসভার নির্বাচন; দ্বিতীয় কারণ, পরের বছর কানাডার ভোট।

ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের সাম্প্রতিক বৈঠকে কানাডা প্রসঙ্গ বিস্তারিতভাবে আলোচনার কথা দুই দেশই স্বীকার করেছে। গত শুক্রবার দিল্লিতে নিজের দেশের সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ব্লিঙ্কেন বলেন, ‘ভারত ও কানাডা—দুই দেশই আমাদের ঘনিষ্ঠতম বন্ধু ও সঙ্গী। বন্ধু বলেই আমরা চাই, দুই দেশ তাদের মধ্যে বিবাদ ও বিরোধ মিটিয়ে নিক। মতানৈক্যের অবসান ঘটুক।’ এরপরই ব্লিঙ্কেন জানান, ‘আমরা চাই, তদন্তের ক্ষেত্রে (শিখ নেতা হরদীপ সিং নিজ্জর হত্যা) কানাডার সঙ্গে ভারত একযোগে এগোক। এ ক্ষেত্রে যে মতপার্থক্য রয়েছে, সহযোগিতার ভিত্তিতে তা মিটিয়ে ফেলুক।’ ব্লিঙ্কেন অবশ্য সেই সঙ্গে এ কথাও মনে করিয়ে দেন, সেটা সম্ভবপর, কানাডা যদি তদন্তের কাজে গতি আনে এবং ভারত তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে।

কানাডায় বসবাসকারী স্বাধীন খালিস্তানপন্থী শিখ নাগরিক হরদীপ সিং নিজ্জর খুন হয়েছিলেন গত জুন মাসে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো সে দেশের পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে সেই হত্যায় ভারতের ‘হাত থাকার’ সন্দেহের কথা জানিয়ে ভারতকে তদন্তে সহযোগিতা করার অনুরোধ জানান। জবাবে ভারত বলেছিল, কানাডার কাছে যেসব তথ্য রয়েছে, তা ভারতকে দেওয়া হোক। ভারতের দাবি, কানাডা তা পেশ করেনি। কানাডার অভিযোগ, তদন্তে সহযোগিতা নিয়ে ভারত কোনো আগ্রহ দেখাচ্ছে না।

ভারতকে তদন্তে অংশ নেওয়া ও সহযোগিতা করার প্রশ্নটি নতুন করে তোলা হয়েছে কি না এবং ভারত সহযোগিতায় প্রস্তুত কি না, সেই প্রশ্ন পররাষ্ট্রসচিব বিনয় কোয়াত্রাকে করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি উত্তর দেননি। কানাডা–সংক্রান্ত প্রশ্নাবলির জবাবে তিনি ভারতের নিরাপত্তার প্রসঙ্গ ও সে বিষয়ে গভীর উদ্বেগের কথাই জানান। বলেন, ভারতের বন্ধু ও সহযোগীদেরও সেই উদ্বেগের কথা বোঝানো হয়েছে এবং তারা তা বুঝতেও পেরেছে। কিন্তু তদন্তের কাজে ভারত সহযোগিতা করবে কি না কিংবা সেই দাবি ওই বৈঠকে নতুনভাবে করা হয়েছে কি না, সে বিষয়ে কোনো মন্তব্য তিনি করেননি। অথচ একই দিনে ব্লিঙ্কেন বলেন, তদন্তে যোগ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তার কথা তাঁরা আরও একবার ভারতকে মনে করিয়ে দিয়েছেন। স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছে, কানাডা ও ভারত—দুই দেশ যেমন তাদের অবস্থানে অনড়, তেমনি যুক্তরাষ্ট্রের চাহিদা মানতেও ভারত রাজি নয়।

ওয়াশিংটনের উইলসন সেন্টারের সাউথ এশিয়া ইনস্টিটিউটের পরিচালক মাইকেল ক্লুগম্যান এ বিষয়ে রয়টার্সকে বলেছেন, দুই দেশের সম্পর্ক এতটা খারাপ আগে কখনো হয়নি। এ এক গভীর সংকট। পরিস্থিতি যাতে হাতের বাইরে না যায়, সে জন্য দুই দেশ হয়তো সজাগ। নিজেদের স্বার্থ তারা জানে। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে দুই পক্ষ সংকটমুক্ত হতে সচেষ্ট।

কেন সচেষ্ট নয়, তার একটা ব্যাখ্যা ভারতের কূটনৈতিক মহলে রয়েছে। এই মহল মনে করে, ট্রুডোর সরকার সংখ্যালঘু। শিখ নেতা জগমিৎ সিংয়ের দল নিউ ডেমোক্রেটিক পার্টির সমর্থনে তিনি ক্ষমতায় টিকে আছেন। এই দল আবার স্বাধীন খালিস্তানের পক্ষে বলে পরিচিত। ভারতের পরই সবচেয়ে বেশি শিখ বাস করে কানাডায়। তারা সে দেশের অর্থনীতির বড় জোগানদারও। স্বাভাবিক কারণেই শিখদের সমর্থন ট্রুডো হারাতে চান না। ২০২৫ সালে পুনরায় নির্বাচিত হতে হলে শিখ সমাজের সমর্থন তাঁর জরুরি। সেদিকে লক্ষ রেখেই তিনি ভারতের কৃষক আন্দোলনের সমর্থনে বিবৃতি দিয়েছিলেন। ভারতের কূটনৈতিক মহল মনে করে, সে কারণে ট্রুডো শিখদের প্রতি নমনীয়। তাদের নানা কর্মকাণ্ডকে গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে তিনি সমর্থন করে চলেছেন। এর বিপদ কোথায়, সে কথা ভারত বারবার কানাডাকে বোঝাতে চেয়েছে। কিন্তু লাভ হয়নি।

ভারতের পক্ষেও নমনীয় হওয়া সম্ভবপর নয়। শাসক দল বিজেপির কাছে সন্ত্রাসবাদ একটি বড় ইস্যু। সন্ত্রাসবাদের মোকাবিলার মধ্য দিয়ে হিন্দু জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটিয়ে বিজেপি নির্বাচনে সাফল্য পেয়ে চলেছে। শিখ সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি কানাডার নমনীয় মনোভাবকে প্রশ্রয় দেওয়া বিজেপির কাছে হিতে বিপরীত হতে পারে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র এ কথাও বলছে, নিজ্জর হত্যার বিষয়ে কানাডা যে অভিযোগ করেছে, তার সূত্র কী, কতটা বিশ্বাসযোগ্য, কোনো তথ্যই ভারতকে দিতে তারা রাজি নয়। অথচ চায়, ভারত তদন্তে সাহায্যের হাত বাড়াক। এ দাবি মানা কঠিন। বিশেষ করে আগামী বছর যখন ভারতের লোকসভা নির্বাচন।

বিদেশের মাটিতে বিদেশি নাগরিককে হত্যার অভিযোগ এই প্রথম ভারতের বিরুদ্ধে এত জোরালোভাবে উঠেছে। এ কারণে ভারতের কর্মকর্তাকে কানাডা বহিষ্কারও করেছে। এত বড় অভিযোগ আগে কখনো ওঠেনি। তাই ভারত এমন কিছু করতে চায় না, যার ফল সুদূরপ্রসারী হয়। কানাডায় নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত অজয় বিসারিয়া মনে করেন, দুই দেশ উত্তেজনা প্রশমনে সচেষ্ট। কোনো কোনো ক্ষেত্রে ভিসা দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ তারই ইঙ্গিত। কিন্তু তা সত্ত্বেও মনে করা হচ্ছে, রাজনৈতিক বাধ্যবাধকতার দরুন নিকট ভবিষ্যতে শীতলতা কাটিয়ে সম্পর্কের উষ্ণতা ফেরার সম্ভাবনা ক্ষীণ।

প্রথম আলো

Exit mobile version