ড. মারুফ মল্লিক :
নির্বাচনকে সামনে রেখে নিত্য নতুন রাজনৈতিক ঘটনা সামনে আসছে। রবিবার দুটো বিষয় আমরা দেখলাম। এক, নির্বাচন নিয়ে জাতীয় পার্টির মধ্যে দ্বিধা-বিভক্তির মধ্যেই রওশন এরশাদ রাষ্ট্রপতি সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সব দলকে নিয়ে আলোচনার কথা বলেছেন। যদিও অনেকেই মনে করছেন দ্বিধা-বিভক্তি থাকলেও শেষ পর্যন্ত জাতীয় পার্টি নির্বাচনে যাবে। এবং জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধন বাতিল বহাল রেখেছে উচ্চ আদালত।
ক্রিকেটের অনুমেয় দল হিসাবে অস্ট্রেলিয়া বা ফুটবলে জার্মানি বেশ পরিচিত। জার্মানি নিয়ে নেদারল্যান্ডের কিংবদন্তি ফুটবলার ইউহান ক্রুয়েফ একবার বলেছিলেন, ফুটবল এমন এক ধরনের খেলা যেখানে সবাই খেলে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিতে জার্মানি। জাতীয় পার্টিও আমাদের রাজনীতিতে এমনই এক দল। সারাবছর জাতীয় পার্টি নিয়ে নানা ধরনের আলাপ-আলোচনা হবে। চায়ের টেবিলে ঝড় উঠবে। জাতীয় পার্টির নেতারাও বেশ জোশ নিয়ে বিপ্লবী বিপ্লবী কথা বলবেন।
এই যেমন আজকে (রবিবার) জাতীয় পার্টির প্রধান পৃষ্ঠপোষক ও সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী রওশন এরশাদ রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের সঙ্গে দেখা করে যথা সময়ে নির্বাচনের দাবি জানিয়েছেন। তবে সব দলের সঙ্গে নির্বাচন নিয়ে আলোচনার বিষয়টিও রাষ্ট্রপতির কাছে তুলে ধরেছেন। সব দলের সঙ্গে আলোচনার প্রস্তাবের মধ্যেই রাজনীতি লুকিয়ে আছে। তবে কি জাতীয় পার্টির পরামর্শে সরকার সব দলকে আলোচনায় ডাকবে? ডাকতে পারে। আবারও নাও ডাকতে পারে। যদিও সরকার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডনাল্ড লুকে চিঠি দিয়ে বলেছে, এখন আর আলোচনার সুযোগ নেই। এর আগে ডনাল্ড লু বিএনপি, আওয়ামী লীগ ও জাতীয় পার্টিকে পৃথক পৃথক চিঠি দিয়ে শর্তহীন সংলাপে বসে চলমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের আহ্বান জানিয়েছিলেন। চিঠি দিয়ে মাকির্নীদের না করে দেয়ার পর সরকারের পক্ষে আবার আলোচনা শুরুর আহ্বান করা সম্মানজনক না। কিন্তু আমরা আঁচ করতে পারি রাজনৈতিক সংকট সমাধানের জন্য সরকারের উপর দেশের ভিতরে ও বাইরে থেকে চাপ আছে। বিএনপিসহ আন্দোলনে থাকা দলগুলো টানা অবরোধ, হরতাল পালন করছে। এই মুহূর্তে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সুবিধাজনক নয়। বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ নিয়ে সরকার বিপাকে আছে। মজুদ ক্রমশ কমছেই। বাজারে পর্যাপ্ত ডলার নেই। ফলে দাম বাড়ছে ডলারের। দ্রব্যমূলের ঊর্ধ্বগতি আকাশের দিকে ধাইছে। বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের অন্যতম পথ পোশাক খাতে অস্থিরতা বিরাজ করছে। শ্রমিকরা বেতন বৃদ্ধির দাবিতে মাঠে নেমেছিল। শ্রমিক আন্দোলনে চারজন নিহত হয়েছেন পুলিশের গুলিতে।
এই অবস্থায় সরকার হয়ত নিজেদের মতো রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে নির্বাচন করে ফেলতে পারবে। কিন্তু পরিস্থিতি সামাল দেয়া সহজ হবে না। ২০১৪ বা ২০১৮ সালের মতো নির্বাচন করলে আওয়ামী লীগের উপর চাপ আরো বাড়বে। কিন্তু আওয়ামী লীগ রাজনীতিকে এমন এক জায়গায় নিয়ে গিয়েছে যেখান থেকে ফিরে আসা অসম্ভব না হলেও রাজনৈতিক পরাজয়ের কারণ হবে। ফলে আওয়ামী লীগের দরকার ছিল নিজস্ব লোক যারা আলোচনার প্রসঙ্গটি তুলবেন এবং এতে অন্যরা আশান্বিত হবেন। এতে করে কিছুটা সময়ক্ষেপণ হবে। আওয়ামী লীগ নতুন করে কৌশল নির্ধারণের সুযোগ পাবে। জাতীয় পার্টি ঠিক সেই কাজটিই করে দিচ্ছে আওয়ামী লীগের হয়ে। আর আওয়ামী লীগ যদি খুব বেশি চাপ অনুভব করে তবে জাতীয় পার্টির পরামর্শ মোতাবেক মনোনয়ন জমা দেয়ার তারিখ পরিবর্তন করে সব দলকে আলোচনার জন্য ডাকতে পারে শেষ পর্যন্ত। বাইরে থেকে দেখা না গেলেও পর্দার আড়ালে নানা ধরনের কথাবার্তা নিশ্চয়ই হচ্ছে। জাতীয় পার্টি পর্দার আড়ালের বিষয়টিই সামনে আনার চেষ্টা করছে আওয়ামী লীগের হয়ে। রাষ্ট্রপতির সঙ্গে সাক্ষাতের সময় নিশ্চিত হওয়ার পরই বলাবলি হচ্ছিল রওশন এরশাদ সব দলকে আলোচনায় ডাকার জন্য অনুরোধ করতে পারেন। হয়েছেও তাই।
জাতীয় পার্টির জন্য এটা করা ছাড়া খুব বেশি বিকল্পও নেই। কারণ পরিস্থিতি খুব বেশি অনুকূলে না। দলটি রওশন এরশাদ ও জি এম কাদেরের নেতৃত্বে দুই ধারায় বিভক্ত। রওশনপন্থীরা নির্বাচনে যাবেন বলেই নির্বাচন কমিশনকে চিঠি দিয়েছেন। তবে জি এম কাদেরপন্থীরা নির্বাচনে যাওয়ার চূড়ান্ত ঘোষণা দেননি। দেশ এখন দুইভাগে বিভক্ত। একদিকে গণতন্ত্রকামীরা। যারা একটি একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছেন। আরেকটি অংশ হচ্ছে সরকারপন্থী যারা ক্ষমতাকে ধরে রাখতে চাইছেন। নতুন এই মেরুকরণের সামনে দাঁড়িয়ে জাতীয় পার্টি নির্বাচনে গিয়ে নতুন করে জাতীয় বেইমান হবে না জনগণের সঙ্গে থাকবে তা দেখার বিষয়। ১৯৮৬ সালে জাতীয় বেইমান বলে চিহ্নিত করার হুমকি দিয়ে আওয়ামী লীগ নিজেই নির্বাচনে গিয়েছিল। এ কারণে অনেকেই ঠাট্টা তামাশা করে আওয়ামী লীগকে জাতীয় বেইমান বলে থাকে। ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতীয় পার্টি সেই ঋণ শোধ করেছে নির্বাচনে গিয়ে। এখন এই সরকারের অধীনে যারাই ২০১৪ বা ২০১৮ মার্কা নির্বাচনে যাবে তারাই নতুন করে জাতীয় বেইমান বলে পরিচিতি পাবেন। জাতীয় পার্টি সরকারে ছিল। জাতীয় পার্টির নেতারা ক্ষমতার কাছাকাছি ছিলেন দীর্ঘদিন। জাতীয় পার্টির শীর্ষ নেতারাও জীবন সায়াহ্নে এসে উপনীত হয়েছেন। জাগতিক চাওয়া পাওয়ার অনেক কিছুই তাদের পূরণ হয়েছে। জনমানুষের পক্ষে দাঁড়ানোর বড় সুযোগ জাতীয় পার্টির সামনে। কিন্তু জনগণের দাবি থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে এই তকমা নিজেদের কপালে লাগাবেন কি না সে সিদ্ধান্ত তারাই নিবেন।
এবার জামায়াত প্রসঙ্গে আসি। আওয়ামী লীগের সঙ্গে জামায়াতের আতাঁতের গুঞ্জন ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জামায়াতের নিবন্ধন সরকার দেয়নি। ফলে বুঝাই যাচ্ছে জামায়াতকে পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যেতে দিবে না সরকার। এখন নিবন্ধন দিলে জামায়াত আর আওয়ামী লীগের কথা নাও শুনতে পারে। বরং আবারো সরকার গঠন করতে পারলে নিবন্ধনের বিষয়টি বিবেচনা করা হবে, এই টোপ ফেলে জামায়াতকে নির্বাচনে যাওয়ার জন্য চাপ দিতে পারে আওয়ামী লীগ। প্রশ্ন হচ্ছে নিবন্ধন ছাড়া জামায়াত নির্বাচন করবে কিভাবে? এক্ষেত্রে জামায়াতকে নিবন্ধনপ্রাপ্ত তৃণমূল বা বিএনএম এর সঙ্গে ভিড়িয়ে দিতে পারে আওয়ামী লীগ। যদিও জামায়াত বার বার বলেছে তারা দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে না। এবং দলটি আন্দোলনে ভালোভাবেই সক্রিয় আছে। নিবন্ধন না দিয়ে আওয়ামী লীগ জামায়াতকে চাপে রাখতে চাইছে। আওয়ামী লীগ চাইবে যে কোনো প্রকারেই জামায়াতকে আন্দোলন থেকে সরিয়ে আনতে।
পরিশেষে বলা যায়, রাজনীতিতে নানা হিসাব নিকাশ থাকে। এই প্রক্রিয়া কখনো শেষ হয় না। বরং নিরন্তর নতুন নতুন হিসাবের খাতা খোলা হয়। জাতীয় পার্টি ও জামায়াতকে নিয়েও নতুন হিসাবের খাতা খুলে বৈতরণী পার হতে চাইছে আওয়ামী লীগ। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, এই হিসাব সরল অংকের মতই প্যাঁচানো ও জটিল। তাই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগের হিসাব মিলবে কি না তা দেখার জন্য আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
-লেখক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক, জার্মানি
মানব জমিন