Site icon The Bangladesh Chronicle

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে বাংলাদেশের সদস্য পাঠানোর বিষয়টি কেন আলোচনায়?

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,ত্রিশ বছরের বেশি সময় ধরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে নিয়োজিত বাংলাদেশ

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের পাঠানো এবং তারা যাতে মানবাধিকার লঙ্ঘন না করে তা নিশ্চিত করার বিষয়টি নিয়ে সম্প্রতি বাংলাদেশে নানা আলোচনা সামনে এসেছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, শান্তিরক্ষা মিশন নিয়ে এ ধরণের আলোচনার পেছনে রাজনৈতিক চাপের একটি বিষয় কাজ করতে পারে।

তারা বলছেন, বিষয়টি পুরোপুরি রাজনৈতিক না হলেও রাজনীতির কারণেই এই সময়ে এটি সামনে আসছে। সম্প্রতি যেহেতু বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র কঠোর একটি অবস্থানে রয়েছে এবং এনিয়ে তারা তাদের ভিসা নীতি ঘোষণা করেছে, তাই শান্তিরক্ষা মিশনের বিষয়টিকেও এক ধরণের চাপ হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়।

এ বিষয়ে রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “ এটাও এক ধরণের চাপ হতে পারে যাতে নির্বাচনের সময় যারা ল’এনফোর্সমেন্ট এজেন্সি আছে তারা সতর্ক অবস্থায় থাকে। ”

তবে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে যে, বিএনপির লবি করার কারণেই এ ধরণের মন্তব্য আসছে বিভিন্ন সংস্থার কাছ থেকে। তবে এমন অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিএনপি।

গত ২৫-২৬শে জুন ঢাকা সফর করেছেন মি. ল্যাক্রোয়ার। তিনি আগামী ডিসেম্বরে ঘানায় অনুষ্ঠিত হতে যাওয়া জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকের আগে ঢাকায় প্রথম প্রস্তুতি সভায় অংশ নেন। সেখানে তিনি তার বক্তব্যে অন্যান্য বিষয়ের সাথে শান্তিরক্ষা মিশনে মানবাধিকার লংঘনের বিষয়টি নিয়েও কথা বলেন।

মি. ল্যাক্রোয়ার তার বক্তব্যে বলেন, বিভিন্ন কমিউনিটির সাথে জাতিসংঘের সংযুক্তিকে সফল করতে তাদের সব কাজের পূর্বশর্ত থাকে যে, সব শান্তিরক্ষীর আচরণ যাতে সর্বোচ্চ মানের হয়। তাদের যাতে সততা, যোগ্যতা এবং দক্ষতার সর্বোচ্চ মান নিশ্চিত করা হয়। একইসাথে যেসব দেশ সেনা এবং পুলিশ সদস্যদের পাঠাচ্ছে সেসব দেশকে নিশ্চিত করতে হয় যে, তাদের পাঠানো আইনশৃঙ্খলা ও নিরাপত্তা বাহিনীর কোন সদস্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার বা আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইনের লঙ্ঘনের সাথে জড়িত নয় বা তাদের বিরুদ্ধে এমন কোন অভিযোগও নেই।

আরো পড়ুন:

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল জাঁ পিয়ের ল্যাক্রোয়া

সম্প্রতি বাংলাদেশের গুমের শিকার পরিবারগুলোর সংগঠন মায়ের ডাক জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জাঁ পিয়ের ল্যাক্রোয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠায় যেখানে তার প্রতি অনুরোধ করা হয় যে, জাতিসংঘ শান্তিরক্ষা অপারেশনে মোতায়েন করা সদস্যদের মানবাধিকারের সর্বজনীন নীতি এবং জবাবদিহিতা যাতে নিশ্চিত করা হয়।

এই চিঠির জবাবে মায়ের ডাককে পাঠানো ফিরতি মেইলে মি. ল্যাক্রোয়ার ওই বক্তব্যটির এই অংশটিকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে সামনে নিয়ে আসা হয়েছে। যদিও এখানে বাংলাদেশের নাম সরাসরি উল্লেখ করা হয়নি।

গত তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে সদস্য পাঠিয়ে আসছে বাংলাদেশ। এই মিশনে যেসব দেশ থেকে সবচেয়ে বেশি শান্তিরক্ষী পাঠানো হয় তার মধ্যে প্রথম সারির দেশ বাংলাদেশ। বর্তমানে বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলারক্ষাকারী ও সামরিক বাহিনীর ১০ হাজারের বেশি সদস্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে দায়িত্ব পালন করছেন।

‘রাজনৈতিক চাপ’

বিশ্লেষকরা বলছেন, সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপর ভিসা নীতি ঘোষণার পর থেকে এই দুই দেশের সম্পর্ক খুব একটা ভাল যাচ্ছে না। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সাম্প্রতিক আমেরিকা সফরের সময় জো বাইডেনের সাথে বৈঠকে বাংলাদেশের স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয় স্থান পাবে বলে ধারণা থাকলেও শেষমেশ সেটি হয়নি।

ফলে, যুক্তরাষ্ট্র নির্বাচন অনুষ্ঠান নিয়ে তার আগের অবস্থাতেই অটল আছে বলে মনে করা হচ্ছে। একই সাথে ইউরোপীয় ইউনিয়নও বাংলাদেশে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিষয়ে গুরুত্বারোপ করেছে।

আর নির্বাচন অনুষ্ঠানের সময়ও যেহেতু ঘনিয়ে আসছে তাই এমন রাজনৈতিক পরিস্থিতির কারণে জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনের মানবাধিকার নিশ্চিতের এই বিষয়টি সামনে বেশি করে সামনে আসছে বলে মত দিয়েছেন বিশ্লেষকরা।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার এম সাখাওয়াত হোসেন বলেন, “এখানে কিছুটা তো পলিটিক্যাল এলিমেন্ট থাকলেও থাকতে পারে। সম্পূর্ণটা পলিটিক্যাল না। তবে পলিটিক্যাল কারণে জিনিসটা আরো সামনে এসেছে।”

তিনি বলেন, “এটাও এক ধরনের চাপ হতে পারে যাতে নির্বাচনের সময় এই যারা ল’এনফোর্সমেন্ট ফোর্স আছে তারা যাতে সর্তক অবস্থায় থাকতে পারে।”

ছবির ক্যাপশান,অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল এম সাখাওয়াত হোসেন

বাংলাদেশের ভেতরে গুম এবং বিচারবহির্ভূত হত্যার বিষয়টি নিয়ে বরাবরই কথা হচ্ছে এবং মানবাধিকার বিষয়টি নিয়ে বহুদিন থেকেই আন্তর্জাতিক মহল থেকে বাংলাদেশকে বলা হয়েছে। তবে সে বিষয়ে এসব প্রতিষ্ঠান কোন সদুত্তর পায়নি। যার জের ধরে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন বা র‍্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা আসে বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।

এসব শর্ত আগে থেকেই প্রচলিত ছিল উল্লেখ করে মি. হোসেন বলেন, “যেহেতু বাংলাদেশ সরকার হিউম্যান রাইটস বিষয়টি তাদের(আন্তর্জাতিক সংস্থা) মতো করে সুরাহা করতে পারেনি, তাই আমি বিশ্বাস করি যে এই কথাটি বার বার উঠে আসছে। ”

জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা মিশনে যারা যায় তাদের মধ্যে র‍্যাব এবং পুলিশ নিয়ে দেশের মধ্যেই যথেষ্ট অভিযোগ আছে। এ সবকিছু মিলে জাতিসংঘের আন্ডার সেক্রেটারি জেনারেল এমন মন্তব্য করেছেন বলে মত দিয়েছেন তিনি।

আরেক রাজনৈতিক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমেদ বলেন, র‍্যাবের উপর একটা নিষেধাজ্ঞা এসেছে মানবাধিকার লংঘনের কারণে। অতি সম্প্রতি আমেরিকা তাদের ভিসা নীতিতে পরিবর্তনের ঘোষণা দিয়েছে।

সামনে যে নির্বাচন আসছে তা নিয়ে অনেক ধরণের অস্বস্তি তৈরি হয়েছে এবং আমেরিকার কর্তৃপক্ষ স্পষ্ট করে জানিয়ে দিয়েছে যে, নির্বাচনে কোন কারচুপি বা অনিয়মের সাথে জড়িতরা ভিসা কড়াকড়ির আওতায় পড়ে যাবে।

বাংলাদেশের যে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী ও সশস্ত্র বাহিনী আছে তারা যাতে কোন ধরণের মানবাধিকার লঙ্ঘন জনিত কাজে জড়িত না হয় সেটা নিয়ে এক ধরণের চাপে রাখার জন্যই এমন মন্তব্য এসেছে।

“এখানে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট যে, যদি তারা অভিযোগ পায় যে কোন ধরণের অনৈতিক, মানবাধিকার ক্ষুণ্ন হয় এরকম কোন কাজ যদি তারা লিপ্ত হয় তাহলে ভবিষ্যতে শান্তিরক্ষী মিশনে যাওয়াটা বাধাগ্রস্ত হতে পারে।”

তিনি বলেন, “সুষ্ঠু নির্বাচন নিশ্চিত করা যেহেতু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীরও দায়িত্ব, তাই যদি না হয় তাহলে স্বভাবতই তাদের উপর একটা দায় এসে পড়ে। ইঙ্গিতটা হয়তো সেদিকেও আছে।”

ছবির উৎস,GETTY IMAGES

ছবির ক্যাপশান,র‍্যাবের বিরুদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে

‘বিএনপি লবি নিয়োগ করেছে’

শান্তিরক্ষা মিশনের এই বিষয়টি নিয়ে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলছে যে, বিএনপি এবং জামায়াত লবি নিয়োগ করে বিদেশিদের মাধ্যমে এ ধরণের মন্তব্য করাচ্ছে।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব উল আলম হানিফ বলেন, বাংলাদেশে এখন বিএনপি ও জামায়াত রাজনৈতিকভাবে জনবিচ্ছিন্ন হওয়ার কারণে তারা বিদেশ নির্ভর হয়ে গেছে। বিদেশিদের সাথে লবি নিয়োগ করে তারা দেশের উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও দেশের অগ্রগতিকে ব্যাহত করার চেষ্টা করছে।

তিনি অভিযোগ করে বলেন, “একটা লবিস্ট নিয়োগ করে যখন বিদেশি কোন সংস্থার কাছে যদি এই ধরণের আবেদন করা হয় বলা হয়, তো স্বাভাবিকভাবেই সেই সংস্থা তাদের দায়িত্বশীলতার জায়গা থেকে বলতেই পারে যে, মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত কোন ব্যক্তি যেন গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় না যায়।”

এর আগে ২০২১ সালের ডিসেম্বরে ‘গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে র‍্যাবের উপর নিষেধাজ্ঞা দেয় আমেরিকা।

র‍্যাব কোথায় মানবাধিকার লঙ্ঘন করলো প্রশ্ন তুলে মি. হানিফ বলেন, র‍্যাবের দ্বারা এযাবতকালে যতগুলো অভিযান চালানো হয়েছে তার সবই সন্ত্রাস দমনের অংশ হিসেবে করা হয়েছে।

“এখন যদি বিএনপি সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে লবিস্ট নিয়োগ করে বিদেশিদের কাছে ধর্না দিয়ে লেখালেখি করে তাহলে এটা জাতির জন্য দুর্ভাগ্য ছাড়া কিছু হতে পারে না। ”

এ ধরণের মন্তব্য সরকারের উপর কোন চাপ সৃষ্টি করবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকার কোন চাপ অনুভবও করবে না। তবে বাংলাদেশকে নিয়ে এ ধরণের মন্তব্যই অসম্মানজনক।

লবি নিয়োগের অভিযোগ অস্বীকার করেছে বিএনপি। দলটি বলছে, বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় যে কোন ধরণের মানবাধিকার নেই, গণতন্ত্র নেই, কথা বলার অধিকার নেই, তা সবাই জানে। সে কারণেই বিশ্ব বিবেক সংস্থাগুলো এ ধরণের কথা বলছে।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সেলিমা রহমান বলেন, “বিএনপি লবি নিয়োগ করে নাই। বিএনপি যা করার তা দেশের মধ্যেই করে।”

তিনি পাল্টা অভিযোগ করে বলেন,“পাগলের মতো তারা বিশ্ব ঘুরে বেড়াচ্ছে। লবিস্ট নিয়োগ করছে বিভিন্ন জায়গায়। লবি নিয়োগ করে তারা চেষ্টা করছে ক্ষমতায় থাকার জন্য।”

“বিএনপি কেন লবি নিয়োগ করতে যাবে? এটা তো খুব সাধারণ একটা ব্যাপার।”

Exit mobile version