Site icon The Bangladesh Chronicle

জব্দের আগেই অ্যাকাউন্ট খালি করেন বেনজীর

জব্দের আগেই অ্যাকাউন্ট খালি করেন বেনজীর

জব্দের আগেই ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরিয়ে নিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবার। দুদকের তথ্যের ভিত্তিতে গত ২৩ মে তাদের অ্যাকাউন্ট জব্দের আদেশ দেন আদালত। তবে এসব অ্যাকাউন্টে কী পরিমাণ টাকা ছিল, তা জানা যায়নি।

ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা সরানোর মতো করে জমি, ফ্ল্যাট বা অন্য কোনো সম্পদ বিক্রি বা স্থানান্তর করেছেন কিনা, সে তথ্যও পাওয়া যায়নি। তিনি দেশে আছেন কিনা, তা নিয়েও ধোঁয়াশা সৃষ্টি হয়েছে। একটি সূত্র জানিয়েছে, পরিবার নিয়ে বেনজীর দুবাইয়ে অবস্থান করছেন।

এদিকে, বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের নামে বেসরকারি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেল সিটিজেন টিভির মালিকানার তথ্য পাওয়া গেছে। ২০১৭ সালে এ টিভির অনুমোদনের সময় তারা দু’জনই ছিলেন শিক্ষার্থী। অন্যদিকে, দুদকের চিঠি আমলে নিয়ে তিন দেশে কোনো সম্পদ আছে কিনা জানতে চেয়ে চিঠি দিয়েছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)।

সার্বিক বিষয়ে বক্তব্যের জন্য বেনজীর আহমেদের সঙ্গে মোবাইল ফোন ও হোয়াটসঅ্যাপে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি।

জানা গেছে, বেনজীর আহমেদ, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, দুই মেয়ে ও তাদের স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ৩৩টি অ্যাকাউন্টের সন্ধান মিলেছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে সঞ্চয়ী, মেয়াদি, এসএনডি আমানত হিসাব। কিছু ঋণ হিসাবও আছে। অ্যাকাউন্ট জব্দ কার্যকরের আগেই আমানত হিসাব থেকে নগদ টাকা উত্তোলন কিংবা সরিয়ে ফেলা হয়েছে। অ্যাকাউন্ট জব্দ হতে পারে– বিষয়টি তিনি আগেই জেনে গিয়েছিলেন, নাকি ধারণা থেকে সরিয়ে ফেলেছেন, তা নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

বেনজীরের সম্পদের বিষয়ে যেসব সরকারি সংস্থা খোঁজ রাখছে, তাদের মধ্যে একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, গত সপ্তাহে তাঁর অ্যাকাউন্টগুলো ফাঁকা করা হয়েছে। তিনি বলেন, এর আগের অভিজ্ঞতা থেকে দেখা গেছে, যখনই কেউ বুঝতে পারেন তাঁকে ধরার চেষ্টা চলছে, তখনই তিনি টাকা সরিয়ে ফেলেন। অবশ্য টাকা তুললেও নগদে রেখেছেন, নাকি অন্য কারও অ্যাকাউন্টে জমা করেছেন– তা বের করা সম্ভব।

বেসরকারি একটি ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পুরো বিষয়টি আরও পরিষ্কার করে সমকালকে বলেন, ডকুমেন্টের ভিত্তিতে কাজ করে ব্যাংক। ফলে সুনির্দিষ্ট আদেশের কপি ছাড়া মৌখিক কোনো তথ্য কিংবা গণমাধ্যমের খবরের ভিত্তিতে কারও অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলতে বা স্থানান্তর না করতে দেওয়ার সুযোগ নেই। কেননা, আদালত কারও অ্যাকাউন্ট ফ্রিজের আদেশ দিলে পরে স্থগিতাদেশ দিতে পারেন। এ রকম ক্ষেত্রে কোনো ব্যাংক টাকা তুলতে না দিলে বিপদে পড়বে।

তিনি বলেন, সাধারণভাবে এ ধরনের ব্যক্তির বিভিন্ন পর্যায়ে নিজস্ব লোক থাকে। ফলে গোপনে জানিয়ে দেওয়া হতে পারে। আবার পত্রিকায় লেখালেখি এবং দুদকের কার্যক্রমের ফলে এমনিতেই তিনি টাকা সরিয়ে ফেলতে পারেন। সাধারণত এসব ক্ষেত্রে নগদে তুলে বিশ্বস্ত কারও কাছে রাখা হয়। এখন দেখার বিষয় বেনজীর ও তাঁর স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের অ্যাকাউন্ট থেকে লেনদেন প্রোফাইলের নিয়ম মেনে টাকা উত্তোলন হয়েছে কিনা। আবার টাকা উত্তোলন বা স্থানান্তরের পর ব্যাংকগুলো নিয়ম মেনে সন্দেহজনক লেনদেন রিপোর্ট (এসটিআর) এবং নগদ লেনদেন রিপোর্ট (সিটিআর) করেছে কিনা।

বেনজীর, তাঁর স্ত্রী জীশান মীর্জা, দুই মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীরের বিরুদ্ধে গত ২২ এপ্রিল অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। দুদকের প্রধান কার্যালয়ের উপপরিচালক হাফিজুল ইসলামের নেতৃত্বে তিন সদস্যের বিশেষ অনুসন্ধান টিম অভিযোগটি অনুসন্ধান করছে। দুদকের অনুরোধে বিএফআইইউ বিভিন্ন ব্যাংকে তথ্য তলব করে চিঠি দেয়। বিএফআইইউ এসব তথ্য পাঠায় দুদকে। এর পর দুদকের তথ্যের ভিত্তিতে আদালত গত ২৩ মে বেনজীর ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের বিভিন্ন ব্যাংকের ৩৩টি হিসাব জব্দ ও অবরুদ্ধের আদেশ দেন। একই দিন তাদের ৩৪৫ বিঘা (১১৪ একর) জমি জব্দেরও আদেশ দেওয়া হয়।

দু’দিনের সাপ্তাহিক ছুটি শেষে গত ২৬ মে রোববার ১১৯টি জমির দলিল, ২৩টি কোম্পানির শেয়ার ও গুলশানে চারটি ফ্ল্যাট জব্দের আদেশ দেন আদালত। আদালতের নির্দেশনা এরই মধ্যে সব অফিসে পাঠিয়েছে দুদক। দুদক জানিয়েছে, ব্যাংক হিসাবের অর্থ যাতে হস্তান্তর বা রূপান্তর না হয়, সে জন্য আদালতের আদেশ সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে পাঠানো হয়েছে। এ ছাড়া বেনজীর আহমেদ ও তাঁর পরিবারের সদস্যদের নামে থাকা জমি যাতে হস্তান্তর না হয়, সে জন্য সংশ্লিষ্ট জেলার সাব-রেজিস্ট্রার বরাবর আদালতের জব্দের আদেশ পাঠানো হয়েছে।

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের প্রাক্তন অধ্যাপক ড. মইনুল ইসলাম অর্থ পাচার, মানি লন্ডারিংসহ এ ধরনের অপরাধ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে গবেষণা করছেন। গতকাল তিনি সমকালকে বলেন, দুর্নীতিবাজরা আগেই টাকা সরিয়ে ফেলে, এটাই স্বাভাবিক। বিদ্যমান ব্যাংকিং নিয়মে এটি নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তবে সরকার এখন মিডিয়ায় দেখাতে চাচ্ছে, তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে। তিনি বলেন, বেনজীর আহমেদ এক দিনে বেনজীর হননি। তাঁকে পুলিশের আইজি, র‍্যাবের ডিজি এ সরকারই বানিয়েছে। হঠাৎ তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে বহির্বিশ্বে দেখানো হচ্ছে, সরকার দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর।

বিদেশে সম্পদ অনুসন্ধানে বিএফআইইউর চিঠি

দুবাই, কানাডা ও যুক্তরাষ্ট্রে বেনজীর আহমেদ এবং তাঁর পরিবারের কোনো সম্পদ আছে কিনা– সে তথ্য অনুসন্ধানের অনুরোধ জানিয়ে বিএফআইইউতে চিঠি দিয়েছে দুদক। দুদকের অনুরোধ বিবেচনায় নিয়ে এসব দেশের কাছে তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে বিএফআইইউ। প্রাথমিক অনুসন্ধানে এসব দেশে সম্পদ পাওয়া গেলে পরবর্তী সময়ে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এ ক্ষেত্রে মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্টের (এমএলএআর) আওতায় তথ্য চেয়ে চিঠি দেবে সরকার।

বিএফআইইউর একজন কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, দেশের বাইরে সম্পদ আছে কিনা, তা জানতে চেয়ে কয়েকটি দেশে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এসব দেশ থেকে কোনো তথ্য পেলে পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেননা, প্রাথমিকভাবে পাওয়া গোয়েন্দা তথ্য সাধারণত আদালত বা অন্য কোনো সংস্থার কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে উপস্থাপন করা যায় না। ফলে কোনো দেশে তাঁর সম্পদের তথ্য পাওয়া গেলে পরে এমএলএর আওতায় সরকারের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে আবার তথ্য চাইতে হবে। এরপর পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার ব্যবস্থা করতে হবে। তবে একবার কেউ পাচার করলে তা ফেরত আনা অনেক জটিল। এখন পর্যন্ত খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকো ছাড়া কারও পাচার করা অর্থ ফেরত আনার নজির নেই।

সিটিজেন টিভির মালিকানায় বেনজীরের দুই মেয়ে

সিটিজেন টিভি নামে একটি স্যাটেলাইট টেলিভিশন চ্যানেলে বেনজীর আহমেদের দুই মেয়ের মালিকানার তথ্য পাওয়া গেছে। সিটিজেন টিভির পরিচালক তাঁর বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর ও ছোট মেয়ে তাহসিন রাইসা বিনতে বেনজীর। ২০১৭ সালে এই টিভি চ্যানেল অনুমোদনের সময় তারা দু’জনই শিক্ষার্থী ছিলেন। বেনজীর পরিবারের সম্পদ অনুসন্ধান করতে গিয়ে এ তথ্য জানতে পেরেছে বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। এ তথ্য ইতোমধ্যে দুদকে পাঠানো হয়েছে।

জানা গেছে, সরকারি অনুমোদন পেয়েও এখনও সম্প্রচারে আসেনি সিটিজেন টিভি। তবে টেলিভিশন চ্যানেলটির নামে বেসরকারি এক্সিম ব্যাংকে ২০২১ সালে একটি শর্ট নোটিশ ডিপোজিট (এসএনডি) অ্যাকাউন্ট খোলা হয়, যা বর্তমানে সক্রিয়। অ্যাকাউন্ট খোলার ফরমে বেনজীরের দুই মেয়ের ঠিকানা উল্লেখ রয়েছে– ২২৮/৩, শেখপাড়া রোড, দক্ষিণ যাত্রাবাড়ী।

২০১৭ সালে সিটিজেন টিভি অনুমোদনের সময় র‍্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন বেনজীর আহমেদ। তখন তাঁর বড় মেয়ে ফারহিন রিশতা বিনতে বেনজীর নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। সিটিজেন টিভি অনুমোদনের অন্যতম শর্ত ছিল– এক বছরের মধ্যে সম্প্রচারে আসতে হবে। আর পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারে যাওয়ার আগে এবং পূর্ণাঙ্গ সম্প্রচারে যাওয়ার পর দুই বছর পার না হওয়া পর্যন্ত কোনো শেয়ার হস্তান্তর করা যাবে না।

দুদকে বেনজীরের বিরুদ্ধে অভিযোগ অনুসন্ধানের সঙ্গে যুক্ত একটি সূত্র জানায়, তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দ করার আগে কাছাকাছি সময়ে সংশ্লিষ্ট ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করা হলে এ ক্ষেত্রে তাঁকে আইনের আওতায় আনা হবে। ওই টাকা কোথাও বিনিয়োগ করা হলে সেটি অপরাধলব্ধ অর্থ হিসেবে ধরা হবে। এবং এটি দুর্নীতির মাধ্যমে অর্জিত মোট সম্পদের সঙ্গে যুক্ত হবে। আর উত্তোলনকৃত অর্থ কোনো খাতে বিনিয়োগ করা না হলে তাঁকে মানি লন্ডারিং অপরাধের আওতায় আনা হবে।

দুদক আরও জনায়, ব্যাংক হিসাব অবরুদ্ধ করার পর সংশ্লিষ্ট অভিযুক্ত ব্যক্তি কোনোভাবেই ওই সব হিসাব থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারবেন না। এ পর্যায়ে অভিযুক্ত ব্যক্তি সংশ্লিষ্ট ব্যাংক হিসাব থেকে টাকা তুলে নিলে এ ক্ষেত্রে ব্যাংকের দায়িত্বশীল কর্তৃপক্ষকে আইনের আওতায় আনা হবে।

samakal

Exit mobile version