- মো: হারুন-অর-রশিদ
- ১৪ জুন ২০২৩, ১৯:২০
আলবার্ট আইনস্টাইন তার Ideas and Opinions গ্রন্থের এক জায়গায় লিখেছেন- ‘ইহুদিরা শুধু আত্মরক্ষার জন্য সঙ্ঘবদ্ধ জার্মান খুনিদের বুলেট বেয়নেটের কবল থেকে জীবন বাঁচাতে গিয়ে প্রাণ হারিয়েছেন। আমি এই নৃশংস হত্যাকাণ্ডের জন্য পুরো জার্মান জাতিকেই দায়ী করব এবং পৃথিবীতে যদি ন্যায়বিচার বলে কিছু থাকে তাহলে আমি হিটলারের নজিরবিহীন ইহুদি-নিধনের অপরাধে গোটা জার্মান জাতির বিচার দাবি করব। কারণ জার্মানরা সেদিন হিটলারের জাত্যাভিমানী বই পাঠ ও ফ্যাসিবাদী বক্তৃতা শোনার পরও তারা হিটলারের পক্ষে ভোট দিয়েছিল।’ ইহুদি-নিধন ঠিক ছিল নাকি বেঠিক ছিল সেই বিতর্কে যাব না, তবে হিটলারের ফ্যাসিবাদী মনোভাব বক্তৃতা বিবৃতিতে প্রকাশ পাওয়ার পরও জার্মানরা তাকে ভোটে নির্বাচিত করার দায় এড়াতে পারবে না।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সংগঠিত হওয়ার পেছনে মূল কারণ ছিল, স্বৈরশাসক হিটলার ও তার নাৎসি পার্টির জার্মানির রাজনৈতিক অধিগ্রহণ এবং এর আগ্রাসী বৈদেশিক নীতি এবং ক্ষুদ্র পরিসরে কারণ ছিল ১৯২০-এর দশকের ইতালীয় ফ্যাসিবাদ এবং ১৯৩০-এর দশকে জাপান সাম্রাজ্যের চীন প্রজাতন্ত্রের আক্রমণ। জার্মানি ও জাপানের স্বৈরশাসকরা এই সামরিক আগ্রাসনমূলক পদক্ষেপ নেয়ার পর অন্য দেশগুলো যুদ্ধ ঘোষণা করে এবং সামরিক প্রতিরোধ শুরু করে। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানি কর্তৃক পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা ঘটে এবং ১৯৩৯ সালের ৩ সেপ্টেম্বর ব্রিটেন ও ফ্রান্স জার্মানির বিরুদ্ধে যুদ্ধের ঘোষণা দেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ। এই যুদ্ধে কোটি কোটি মানুষের প্রাণ গিয়েছিল। নিঃস্ব হয়েছিল অগণিত মানুষ। উপরিউল্লিখিত কথাগুলো বলার বলার মূল কারণ, জনগণের ভুল সিদ্ধান্তে একজন ভুল শাসক ক্ষমতা আরোহণ করলে গোটা জাতি এমনকি বিশ্ববাসীর কী পরিণতি হতে পারে, সেই দৃষ্টান্ত উপস্থাপন মাত্র।
রাষ্ট্রের শাসক নির্বাচন করার আগে জনগণের উচিত, প্রার্থীর ইতিহাস ঘেঁটে দেখা। কারণ জনগণের ভুল সিদ্ধান্তে দেশ ও জনগণের ওপর নেমে আসতে পারে অপশাসনের ফল। শাসকের চরিত্র যদি ম্যাকিয়াভেলিজম চরিত্রের হয় তাহলে তাকে বিশ্বাস করা কতটা যৌক্তিক হবে তা সবার আগে বিবেচনায় নিতে হবে। নির্বাচনের আগে হিজাব-তাসবি ধারণ করে সাধারণ ভোটারের মনের মধ্যে আবেগের সৃষ্টি করে রাজনৈতিক ফায়দা লুটার পর যদি ধর্মপ্রাণ মানুষের বুকের উপর বুটের লাথি উপহার দেয়া হয় তাহলে সেই নেতৃত্বকে ভণ্ড ছাড়া আর কি বলা যেতে পারে? ধর্মীয় অনুভ‚তির সহায়তা নিয়ে নির্বাচনী বৈতরণী পার করার পর এই দেশের মানুষ প্রত্যক্ষ করেছিল কুকুরের মাথায় টুপি। মসজিদে মসজিদে মুসল্লিদের ওপর পুলিশের তাণ্ডব। শাপলা চত্বরে হেফাজতে ইসলামের ওপর নারকীয় তাণ্ডবলীলা। মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠের দেশে একজন মুসলমান তার ধর্মীয় স্বাধীনতা কতটা স্বাধীনভাবে উপভোগ করতে পারছে, সেই প্রশ্ন কিন্তু থেকেই যাচ্ছে। আলেম-ওলামাদের প্রায়ই জেলের ঘানি টানতে হচ্ছে।
এ ছাড়াও ২০০৮ সালের পর থেকে আজ পর্যন্ত বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ওপর যে অত্যাচার-নির্যাতন, জেল-জুলুমের মহড়া চলছে তা অতীতের যেকোনো সময়ের চেয়ে এক ভয়ঙ্কর রূপ। একটি সরকার জনগণের মতামতের তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামাফিক সিদ্ধান্ত জনগণের ওপর চাপিয়ে দিচ্ছে। জনগণ সরকারের সিদ্ধান্ত না মানতে চাইলে তার কী পরিণতি হয়, তাও এই দেশের জনগণ প্রতিনিয়ত প্রত্যক্ষ করছে। আজকে সরকারের একনায়কোচিত কর্মকাণ্ডের ফলাফল হিসেবে এই দেশের জনগণকে বহির্বিশ্বের কাছে তার মূল্য দিতে হচ্ছে। রাষ্ট্রের একটি বাহিনী ও তার সাবেক সাত কর্মকর্তার ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র স্যাংশন দিয়ে রাষ্ট্রের একটি বাহিনীকে বিশ্ব দরবারে হেয় করা হয়েছে। এখন আবার বাংলাদেশের জনগণের জন্য মার্কিন ভিসানীতি চালু করেছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিঙ্কেন ২৪ মে ২০২৩ বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে উৎসাহিত করার জন্য নতুন ভিসানীতি ঘোষণা করেছেন। কোনো দেশের নির্বাচন উৎসাহিত করার জন্য আমেরিকা আনুষ্ঠানিকভাবে এ ধরনের ভিসানীতি আগে কখনো ঘোষণা করেছে বলে জানা নেই। তবে এটি ঠিক, যুক্তরাষ্ট্র সবসময় গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া চলমান রাখতে সহযোগী রাষ্ট্রগুলোকে তাগাদা দিয়ে থাকে। বাংলাদেশের বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার নির্বাচনী সঙ্কটকে এমন জায়গায় দাঁড় করিয়েছে, সেখানে কোনো অবস্থাতেই একটি সুষ্ঠু নির্বাচন আশা করা যায় না। বিরোধী রাজনৈতিক দল থেকে শুরু করে দেশের আপামর জনগণের কেউই বিশ্বাস করে না, এই সরকারের অধীনে একটি নিরপেক্ষ নির্বাচন হতে পারে। কারণ ২০০৮ সালের পর থেকে জাতীয় কিংবা স্থানীয় কোনো নির্বাচনই এই সরকার সুষ্ঠু কিংবা নিরপেক্ষভাবে করতে সক্ষম হয়নি। উল্টো জনগণের ভোটের অধিকার পুরোপুরিভাবে কেড়ে নিতে সক্ষম হয়েছে। এমনকি পরবর্তী যেকোনো নির্বাচনে একতরফা বিজয়ী হওয়ার জন্য স্তরে স্তরে পুলিশ, প্রশাসন, নির্বাচন কমিশনকে সাজিয়ে রেখেছে। যাতে কোনো অবস্থাতেই জনগণের ভোটের সত্যিকারের প্রতিফলন ঘটতে না পারে, তার জন্য সবরকম ব্যবস্থা করা আছে।
এই সরকার আবারো একটি একতরফা নির্বাচনের আয়োজন করতে পারে, এই শঙ্কা থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের মানুষের জন্য নতুন ভিসানীতি দিতে বাধ্য হয়েছে। ‘ভিসানীতির সেকশন ২১২(এ)(সি) (৩) (‘৩সি’)-এর ইমিগ্রেশন অ্যান্ড ন্যাশনালিটি অ্যাক্টের আওতায় অবাধ, স্বচ্ছ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য বাংলাদেশের লক্ষ্যকে সমর্থন করার কথা বলা হয়েছে। এ নীতির আলোকে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করার জন্য দায়ী ব্যক্তিকে যুক্তরাষ্ট্র ভিসা দিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারবে। বর্তমান ও সাবেক আমলা, সরকারি বা বিরোধী রাজনৈতিক দলের সদস্য, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী, বিচারবিভাগ, নিরাপত্তা বাহিনীর সদস্যদের জন্য এ নীতি প্রযোজ্য হবে। গণতান্ত্রিক নির্বাচনে ভোটডাকাতি, ভোটারকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, সহিংসতা সৃষ্টি, মানুষকে ভোটাধিকার প্রদানে বাধাসৃষ্টি, দল ও শান্তিপূর্ণ সমাবেশের স্বাধীনতা, রাজনৈতিক দল, ভোটার, সুশীল সমাজ অথবা গণমাধ্যমকে মতামত প্রচারে বাধা প্রদান এসবের আওতায় পড়বে। এখানে আরো বলা হয়েছে- অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে, ভোটার, রাজনৈতিক দলসমূহ, সরকার, নিরাপত্তা বাহিনী, সুশীল সমাজ এবং গণমাধ্যম সবার দায়িত্ব রয়েছে।’
এই ভিসানীতি ঘোষণা করার পর সরকারের মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা কাজ করছে যদিও সরকারের লোকজন মুখে বলে বেড়াচ্ছে- এই ভিসানীতিতে তাদের ভয়ের কোনো কারণ নেই। তবে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো বিনাভোটে কিংবা ভোটডাকাতি করে পুনরায় ক্ষমতায় থাকার জন্য যে প্রহসনের ভোটের আয়োজন করার মহাপরিকল্পনা তারা এঁটেছিল, মার্কিন এই ভিসানীতি ঘোষণা করার পর মনে হচ্ছে, তাদের সব পরিকল্পনা ভেস্তে গেছে। সে কারণেই তাদের মধ্যে এক ধরনের ভয় ও অস্থিরতা কাজ করছে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র যদি প্রকৃত অর্থেই বাংলাদেশের গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ দেখতে চায় এবং এর পেছনে কোনো ভিন্ন উদ্দেশ্য না থাকে, তাহলে এই ভিসানীতি বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে যাবে। একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন করার জন্য বিদেশী শক্তির চাওয়ার চেয়ে এই দেশের জনগণের চাওয়াটা খুব বেশি প্রয়োজন। কিন্তু আজকে যে সঙ্কট, জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করে একপেশে নির্বাচনী সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে; এর থেকে পরিত্রাণের জন্য এই দেশের জনগণকে রুখে দাঁড়াতে হবে। কারণ নির্বাচনে জনগণের অংশগ্রহণ না থাকলে তা বৈধ নির্বাচন হিসেবে স্বীকৃতি পায় না যা ২০১৪ এবং ২০১৮ সালে হয়েছে। ১৯৭৩ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে চ্যালেঞ্জ করার মতো কোনো রাজনৈতিক দল ওই সময়ে বাংলাদেশে ছিল না। তারপরও সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ব্যাপক ভোট কারচুপির অভিযোগ উঠেছিল। তারপরও সেটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনই ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ গণতন্ত্রকে বেশি দিন বাঁচতে দেয়নি। বাকশাল গঠনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রের কবর রচিত করেছিল। আজকের আওয়ামী লীগও ২০০৮ সালের নির্বাচনে কারচুপির অভিযোগ নিয়ে নির্বাচিত হয়ে নতুন করে গণতন্ত্রকে নির্বাসনে পাঠিয়ে একদলীয় বাকশালের রূপেই আরেকটি ভয়ঙ্কর বাকশালতন্ত্র কায়েম করেছে। এটি করতে গিয়ে রাষ্ট্রের বেসিক স্ট্রাকচারকে ধ্বংস করে ফেলা হয়েছে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, পুলিশ, প্রশাসন,পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ রাষ্ট্রের এমন কোনো প্রতিষ্ঠান নেই যেখানে আওয়ামী দুর্বৃত্তায়ন ব্যতীত অন্য কিছু চর্চা হতে পারে। দেশে আজ বিদ্যুৎ নেই, তীব্র তাপদাহে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। খাদ্যপণ্যের ক্রয়ক্ষমতাহীন মূল্যবৃদ্ধি, নিত্যপণ্যের বাজারে দাম বৃদ্ধির আগুন,বিদ্যুৎ, তেল, গ্যাসের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধিতে মানুষ অতিষ্ঠ। কিন্তু জনগণ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নামক চারচোখওয়ালা ভূত এবং সরকারের তাণ্ডব বাহিনীর ভয়ে নিশ্চুপ নিস্তেজ। কিন্তু জনগণের এই নীরবতা ক্ষমতাসীনদের আরো বেশি স্বৈরাচারী করে তুলছে। বেপরোয়া হয়ে উঠছে সরকারের অ্যাজেন্ডা বাস্তবায়কারী প্রতিষ্ঠাগুলো।
আজকের এই সঙ্কটময় পরিস্থিতিতে দাঁড়িয়ে জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, আসলে তারা জুজুর ভয়ে গর্তে লুকিয়ে থেকে রাষ্ট্রকে বিপদের দিকে ধাবিত করবে, নাকি মুক্তির জন্য রাজপথে দাঁড়িয়ে প্রতিবাদ করবে। যেটিই করুক, জনগণ আজকে যে ভুল করবে অনাগত দিনে সেই ভুলের দায় জনগণকেই বহন করতে হবে। কাজেই রাষ্ট্র মেরামতের যে ডাক এসেছে, জনগণের উচিত সেই মিছিলে শরিক হওয়া। রাষ্ট্র বিনির্মাণের কাজে নিজেদের সোচ্চার হওয়া এবং অধিকার আদায়ে আপস না করা।
harun_980@yahoo.com