- ড. রেজোয়ান সিদ্দিকী
- ০২ ডিসেম্বর ২০২২
আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সুষ্ঠু স্বাভাবিক প্রক্রিয়া কিংবা ভদ্রতা, সহনশীলতা খুব একটা দেখা যায় না। সেটি সংসদের ডেপুটি স্পিকার সাহেদ আলী হত্যা থেকেও শুরু হয়ে থাকতে পারে। তারপর অনেক ঘটনা। ১৯৭১ সালে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর এখানে তেমন কোনো বিরোধী দল ছিল না। পরে বীর মুক্তিযোদ্ধা আ স ম আব্দুর রব ও শাহজাহান সিরাজের নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়েই গঠিত হয়েছিল জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল। নেতৃত্বে ছিলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা সেক্টর কমান্ডার এম এ জলিল।
ক্ষমতাসীনদের জমি দখল, বাড়ি দখল, জায়গা দখল এসবের বিরোধিতা দিয়ে জাসদ রাজনীতি শুরু করে। ’৭২ পরবর্তী সরকার ক্ষমতায় আসীন হয়েই জাসদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। তাদের হামলা থেকে বাদ যায়নি মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টিও। এভাবে শুরু হয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের রাজনীতি। দিন যত যাচ্ছিল- গুম, খুন, গ্রেফতার, হামলা, মামলা ততই বাড়ছিল। জাসদের সশস্ত্র ক্যাডার বাহিনী ছিল গণবাহিনী। সরকারের হাতে বিভিন্ন বাহিনী থাকা সত্ত্বেও রক্ষীবাহিনী নামে একটি ঘাতক বাহিনী গঠন করে এবং বিরোধী দল দমনে তাদের অপরিমেয় ক্ষমতা ও দায়মুক্তি দেয়া হয়। ফলে রক্ষীবাহিনী ছিল সাধারণ মানুষের কাছে এক আতঙ্কের নাম। বাবা-মা, ছেলে-মেয়েদের ঘুম পাড়াতে বলতেন, ‘শব্দ করো না- রক্ষী আইবো’। জাসদের গণবাহিনী জনগণের সহায়তায় বিভিন্ন স্থানে রক্ষীবাহিনীর বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে। তাদের সাফল্য-ব্যর্থতা উভয়ই ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের স্বভাব এই দীর্ঘকালেও পরিবর্তন হয়নি।
এখন আওয়ামী লীগের লোকেরা কথা বলতেই শুরু করেন, বিএনপি আগুন সন্ত্রাস চালায়, মানুষ পুড়িয়ে মারে ও গ্রেনেড হামলা চালায়। এই মিথ্যা বলতে বলতে এটি এখন আওয়ামী নেতাকর্মীদের মুখের বুলি হয়ে গেছে। ২০১৩ সালে বাসে আগুন দিয়ে নাকি ১১ জনকে পুড়িয়ে মেরেছিল। কিন্তু ২০১৭ সালে মেহেন্দীগঞ্জ আওয়ামী লীগ নেতা মইদুল ইসলাম বরিশাল জেলা পরিষদ সম্মেলন কক্ষে এক সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, সরকারদলীয় সংসদ সদস্য পঙ্কজ দেবনাথের নির্দেশে বাসে আগুন দিয়ে ওই ১১ জনকে পুড়িয়ে মারা হয়। মইদুল আওয়ামী লীগ নেতা ও বরিশাল জেলা পরিষদের তৎকালীন চেয়ারম্যান। মইদুল বলেন, প্রধানমন্ত্রীর সহানুভূতি আদায় করে মনোনয়ন পাওয়ার জন্য বিহঙ্গ পরিবহনের চেয়ারম্যান পঙ্কজের নির্দেশে ১১ জনকে নির্মমভাবে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। পঙ্কজ অবশ্য পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে প্রশ্ন করেন বিতর্কিত প্রশ্ন তুলে মইদুল ইসলাম কার স্বার্থ রক্ষা করছেন।
মইদুল ইসলাম সংবাদ সম্মেলন করে বলেন, এলাকায় দখল, সরকারি অর্থলুট সর্বশেষ ইউপি নির্বাচনে দলীয় প্রার্থীর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী প্রার্থী দাঁড় করান পঙ্কজ দেবনাথ। এর প্রতিক্রিয়ায় বিএনপির কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও বরিশাল মহানগর বিএনপির সভাপতি মজিবর রহমান সরোয়ার বলেন, বিরোধী দলের আন্দোলন দমন করার জন্য ২০১৩ সালে সরকারি মদদে গাড়িতে যে আগুন দেয়া হয় এবং মানুষ পুড়িয়ে মারা হয়েছে মইদুলের বক্তব্যে সেটি প্রমাণিত।
এ ধরনের ঘটনা ধারাবাহিকভাবে চলছে। আমরা দেখতে পাচ্ছি, বিএনপি নেতাকর্মীদের ওপর হামলা চালায় পুলিশ বা ছাত্রলীগ; কিন্তু মামলা হয় শতশত বিএনপি নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে। পুলিশ যে সব মামলা দায়ের করে তাতে ১০-১২ জনের নাম লিখে বলা হয়, আরো অজ্ঞাত ৩০০ জন আসামি। এই ৩০০ জনকে পাকড়াও করতে যেকোনো সময় যেকোনো বাড়িতে হানা দিতে পারে পুলিশ এবং তা দিচ্ছেও। ফলে পরিস্থিতি অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। শহরে কোনো ঘটনা ঘটলে সেটি নিউজ হয় হয়তো, তার ফলোআপও হয়। কিন্তু গ্রাম-গ্রামান্তরে পুলিশের এ রকম কর্মকাণ্ডে মানুষ খুব অসহায় হয়ে পড়ে। এর মধ্যে আছে পুরনো মামলা পুনরুজ্জীবিত করা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, মামলার জট লেগে গেছে, এগুলোর তো মীমাংসা করতে হবে। খাঁটি কথা, কিন্তু মীমাংসার নামে গ্রাম-গ্রামান্তরে হাজার হাজার মানুষকে ঘরছাড়া করা কোন ধরনের রাজনীতি!
সম্প্রতি দৈনিক সমকালে ‘এত্ত ককটেল বিস্ফোরণ/কেউ শোনেনি, কেউ দেখেনি’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট প্রকাশ করেছে। শরীর হিম হয়ে আসার মতো রিপোর্ট। তাতে বলা হয়েছে, নভেম্বরে দেশের বিভিন্ন স্থানে রাতের বেলায় ককটেল বিস্ফোরণ হয়েছে, উদ্ধারও হয়েছে বিপুল। পুলিশের ওপর হামলা ও গাড়ি ভাঙচুর হয়েছে। গত বুধবার রাতে খোদ রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোডে মুহুর্মুহু ককটেলের বিস্ফোরণ ও বাস ভাঙচুর হয়েছে। কিন্তু স্থানীয়রা বিস্ফোরণের শব্দ শোনেননি, সংঘর্ষও দেখেননি। বাস মালিকরা জানিয়েছেন, বাসে ভাঙচুর হয়নি। গণমাধ্যমে ‘বিস্ফোরণ হামলা ও সংঘর্ষ’ হওয়ার খবর না এলেও মামলা হয়েছে। মামলার বাদি পুলিশ কিংবা আওয়ামী এবং এর অঙ্গ সংগঠনের নেতাকর্মীরা আর আসামি বিএনপি নেতাকর্মীরা। বেশির ভাগ মামলার অভিযোগ হুবহু এক। এজাহারে বলা হয়েছে, বিএনপির নেতাকর্মীদের গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে পুলিশ সেখানে গেলে আসামিরা ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায়। তবে স্থানীয় বাসিন্দা ও কয়েকটি মামলার সাক্ষী সংশ্লিষ্ট পত্রিকায় জানিয়েছেন, ককটেল বিস্ফোরণ হয়নি। বিএনপির অভিযোগ, সবই গায়েবি মামলা। ২০১৮ সালের মতো কাল্পনিক ঘটনায় মামলা হয়েছে। পত্রিকার রিপোর্ট বলা হয়, গত বৃহস্পতিবার রাজধানীর ভাটারা থানায় বিস্ফোরক আইনে মামলা করেন থানা ছাত্রলীগের সাবেক নেতা পরিচয় দেয়া মো: হাসান। বাস ভাঙচুর, চার-পাঁচটি ককটেল বিস্ফোরণসহ লাঠিসোটা নিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের ওপর হামলার অভিযোগ করা হয়েছে। বিএনপির ২২ নেতার নাম উল্লেখ করে ও অজ্ঞাত ৫০-৬০ জনকে আসামি করা হয়েছে। এজাহারে বলা হয়েছে, ছাত্রদলের নেতাদের ওপর হামলার প্রতিবাদে গত বুধবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে কুড়িল প্রগতি সরণিতে ফ্লাইওভারের পাশে বিশ্বরোডের মূল সড়কে বিএনপি ও ছাত্রদলের নেতাকর্মী প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে লাঠিসোটা, ককটেল ও পেট্রল বোমায় সজ্জিত হয়ে বাস গাড়ি ভাঙচুর করে। টায়ারে আগুন জ্বালিয়ে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। বাধা দিলে আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগের নেতাকর্মীকে পিটিয়ে আহত করা হয়। চারটি বিস্ফোরিত ককটেলের অংশবিশেষ, পাঁচটি পেট্রল বোমাসদৃশ বস্তু, বাঁশের লাঠি ও পোড়ানো টায়ার জব্দ দেখানো হয়েছে।
কিন্তু ‘সংঘর্ষস্থলের’ আশপাশের বাসিন্দা ও দোকানিরা জানিয়েছেন, বুধবার রাতে মিছিল, ককটেলের বিস্ফোরণ বা সংঘর্ষ হয়নি। ওই এলাকার সিএনজি কনভার্সন সেন্টারের কর্মী আরিফুজ্জামান জানান, বুধবার রাতে এলাকাতেই ছিলেন; কিন্তু মিছিল, সংঘর্ষ দেখেননি। ককটেল বিস্ফোরণের শব্দও শোনেননি।
ঢাকা মহানগর উত্তর ছাত্রদলের সাধারণ সম্পাদক রাসেল বাবু সমকালকে জানান, মামলায় যে ঘটনাস্থলের কথা বলা হয়েছে, তা থেকে প্রায় কিলোমিটার দূরে ছাত্রদল সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ ও সাধারণ সম্পাদক সাইফ মাহমুদ জুয়েলের ওপর হামলার প্রতিবাদে বুধবার রাতে শ্যাওড়া বাসস্ট্যান্ড থেকে রেডিসন হোটেলের দিকে মশাল মিছিল হয়। মিছিল থেকে একজনকে গ্রেফতারও করেছে পুলিশ। সে ঘটনায় ভাটারা থানায় কীভাবে মামলা হয়! মিছিল হয়েছে ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায়।
সমকালে যোগাযোগ করলে মামলায় আসামি কতজন- প্রশ্নে ভড়কে যান বাদি মো: হাসান। তিনি আর কথা বাড়াতে রাজি হননি। বলেন, ব্যস্ততা আছে। টেলিফোনে কথা বলতে পারবেন না।
জব্দ তালিকা করা পুলিশের উপপরিদর্শক নজরুল ইসলাম জানান, তিনি মিছিল দেখেননি। মিছিলের পর পুলিশকে খবর দেয়া হয়। সাক্ষীদের উপস্থিতিতে আলামত জব্দ করেন।
তিনজন সাক্ষীর একজন বাদি নিজেই। অপরজন ভাটারা থানার কনস্টেবল শাহজাহান সিরাজী। এ বিষয়ে কিছু বলতে অপারগতা প্রকাশ করেছেন তিনি। আরেকজনের নাম সজীব ইসলাম। তার সাথে যোগাযোগের চেষ্টা করে সমকাল। এজাহারে তার যে মোবাইল নম্বর দেয়া হয়েছে, কল দিলে বলা হয়, তা আর ব্যবহৃত হচ্ছে না।
এজাহারে বলা হয়েছে, কয়েকটি বাস ভাঙচুর করে বিএনপি কর্মীরা। তবে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহবুবুর রহমান সমকালকে জানিয়েছেন, বুধবার রাতে খিলক্ষেত, কুড়িল বা বিশ্বরোড এলাকায় বাস ভাঙচুরের কোনো ঘটনা জানেন না। সমিতিকে কেউ জানায়নি। ঘটনা ঘটলে সমিতির কাছে তথ্য থাকত।
একই ঘটনায় খিলক্ষেত থানায় আরেকটি মামলা করেছে পুলিশ বাদি হয়ে। তবে ঘটনাস্থল বলা হয়েছে, রাস্তার অপর পাশ নিকুঞ্জের গেটের সামনের ভাস্কর্য।
বিএনপির অভিযোগ, জুলাই থেকে ‘গায়েবি’ মামলা দেয়া শুরু হলেও গত ১০ দিনে সারা দেশে এ সংখ্যা বেড়েছে। বিভাগীয় গণসমাবেশ ঠেকাতে ঢাকায় ৬০টিসহ সারা দেশে ১৩৬টি মামলা হয়েছে। রাজশাহীর আট জেলায় ৩৭ মামলাতেই আসামি ১০ সহস্রাধিক। আগামী ৩ ডিসেম্বর রাজশাহীতে বিএনপির সমাবেশ।
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, আন্দোলন বাধাগ্রস্ত করতে গায়েবি মামলার খেলা শুরু করেছে সরকার। কোনো কিছু ঘটেনি; হঠাৎ বলে দিলো- নাশকতা হয়েছে। নিজেরাই বোমা রেখে মামলা দিচ্ছে। নিজেদের অফিস ভাঙচুর করে বিরোধী দলের নেতকর্মীকে আসামি করার খেলা চলছে।
ঢাকা ছাড়াও রাজশাহী, নাটোর, পাবনা, জয়পুরহাট, সিরাজগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, খুলনা, বরিশাল, ফরিদপুর, ফেনী, চট্টগ্রামসহ অন্তত ১৬ জেলায় এমন মামলার তথ্য পেয়েছে সমকাল।
চারঘাট (রাজশাহী): গত মঙ্গলবার (২৮ নভেম্বর) রাত সাড়ে ৯টার দিকে রাজশাহীর চারঘাট উপজেলার নিমপাড়া ইউনিয়নের জোতকার্তিক বিএন উচ্চবিদ্যালয় মাঠে গোপন বৈঠক থেকে ককটেল বিস্ফোরণের ‘ঘটনায়’ বিএনপির ১৫০ নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা হয়েছে। পুলিশের ভাষ্য, খবর পেয়ে গেলে বিএনপি কর্মীরা চারটি ককটেল বিস্ফোরণ ঘটিয়ে, ইট ও পাথর নিক্ষেপ করে পালিয়ে যায়। বিপুলসংখ্যক বাঁশের লাঠি ও হামলায় ব্যবহৃত পাথরের টুকরা জব্দ করা হয়েছে আলামত হিসেবে।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, হামলা ও সংঘর্ষ দেখেননি। জোতকার্তিক বিএন উচ্চ বিদ্যালয়ের নৈশপ্রহরী আব্দুল কুদ্দুস বলেন, যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, তখন তিনি স্কুলের মাঠেই ছিলেন। সেখানে সভা দূরে থাক, একজন মানুষও ছিল না। রাত ১০টার দিকে একটি মোটরসাইকেলে চার ব্যক্তি মাঠে আসেন। তিনজনকে মাঠে নামিয়ে দিয়ে একজন মোটরসাইকেল নিয়ে চলে যান। ১০-১৫ মিনিট পর সাইরেন বাজিয়ে পুলিশের গাড়ি মাঠে ঢোকে। তখন চার-পাঁচটি বিস্ফোরণের শব্দ শুনতে পান।
জোতকার্তিক বিএন উচ্চবিদ্যালয় মাঠের সামনে ফটোকপি ও কম্পিউটার কম্পোজের দোকানি মাসুদ রানা একই কথা জানান। তিনি বলেন, ওই দিন রাত ৮টার পর মাঠে কেউ ছিল না। পুলিশের গাড়ি আসার পর বিস্ফোরণের শব্দ পান। এরপর পুলিশ স্থানীয়দের ডেকে নিয়ে ককটেল, পাথর ও লাঠি পাওয়ার কথা জানায়।
চারঘাট মডেল থানার উপপরিদর্শক সোহাইল রানা মামলার বাদি। ‘তদন্তের স্বার্থে’র কথা বলে আসামিদের নাম-পরিচয় জানায়নি পুলিশ। এজাহারের কপিও দেয়নি। তাই মামলার সাক্ষী কারা, জানা যায়নি। ওসি মাহবুবুল আলম বলেন, নাশকতার উদ্দেশ্যে গোপন বৈঠক করছিল বিএনপি নেতাকর্মী। পুলিশ আত্মরক্ষার্থে একটু দূরে থাকায় আসামিরা পালিয়ে যায়।
রাজশাহী জেলা বিএনপির আহ্বায়ক আবু সাঈদ চাঁদ বলেন, কোনো সভাই হয়নি। সবই পুলিশের সাজানো নাটক।
পাবনা থেকে পাঠানো রিপোর্টে বলা হয়েছে, জেলার ৯ থানায় ‘ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা’য় ১১টি পৃথক মামলায় বিএনপির আট শতাধিক নেতাকর্মীকে আসামি করা হয়েছে। মামলার তথ্য অনুযায়ী, গত মঙ্গল ও বুধবার রাতে ১৮টি ককটেল বিস্ফোরিত হয়েছে। ২১টি অবিস্ফোরিত ককটেল উদ্ধার করা হয়েছে। পুলিশ ও আওয়ামী লীগ নেতারা এসব মামলার বাদি।
ভাঙ্গুড়া থানার ওসি রাশেদুল ইসলাম জানান, মঙ্গলবার রাত সোয়া ৯টার দিকে পৌর বাসস্ট্যান্ড এলাকায় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী বিশ্বকাপ ফুটবলের খেলা দেখার সময় চারটি ককটেল বিস্ফোরিত হয়। পুলিশ গিয়ে আরো ককটেল জব্দ করেছে।
উপজেলা আওয়ামী লীগ সদস্য আব্দুল জব্বার বাদি হয়ে উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক রফিকুল ইসলাম, যুগ্ম আহ্বায়ক শহীদুল ইসলাম, পৌর বিএনপির সদস্য সাইদুল ইসলাম বুরুজসহ ৯ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৬০-৭০ জনকে আসামি করে মামলা করেছেন। তবে স্থানীয় এক চা-দোকানি বলেছেন, বোমার শব্দ শুনেছেন; কাউকে দেখেননি।
আটঘরিয়াতেও মামলা হয়েছে আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী দলীয় কার্যালয়ে বসে বিশ্বকাপের খেলা দেখার সময় ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে।
ঈশ্বরদী থানায় মামলার এজাহার অনুযায়ী, মঙ্গলবার রাত সাড়ে ৮টার দিকে আলহাজ টেক্সটাইল হাইস্কুলে বিএনপি নেতাকর্মীর গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে পুলিশ গেলে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায় আসামিরা। তবে আলহাজ মোড়ের একজন দোকানি সমকালকে বলেন, বোমা বা ককটেল বিস্ফোরণের শব্দ পাননি। আশপাশের সব দোকান খোলা ছিল। কেউ কিছুই জানেন না।
চাটমোহর থানার মামলার বয়ানও অভিন্ন। ওসি জালাল উদ্দিন জানান, পৌর সদরের আফ্রাতপাড়ায় উপজেলা বিএনপির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাসাদুল ইসলাম হীরার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানে গোপন বৈঠকের খবর পেয়ে পুলিশ গেলে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পালিয়ে যায় আসামিরা। তবে প্রতিবেশী নজরুল ইসলাম সমকালকে জানান, হীরার বাড়িতে বিএনপির লোকজন দেখেছেন; বিস্ফোরণের শব্দ পাননি। পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মাসুদ আলম বলেন, ঘটনা যা ঘটছে, তার আলোকে মামলা হচ্ছে। কে কী বলছে, তা দেখার বিষয় নয়।
নারায়ণগঞ্জ : জেলার চার থানায় পাঁচ মামলায় ৯৪৯ জনকে আসামি করা হয়েছে। তবে ছাত্রদল নেতা অনিক নিহতের ঘটনায় তার বাবার মামলা নেয়নি পুলিশ। পরে আদালতে মামলা করেন। গত ২২ নভেম্বর ‘শীর্ষ সন্ত্রাসী’ জাকির খানের হাজিরার সময় আদালতপাড়ায় মিছিল ও সড়কে বিস্ফোরণের অভিযোগে বিএনপির ৩৪ জনের নাম উল্লেখ করে ২৮৪ জনের বিরুদ্ধে মামলা করেছে পুলিশ। তবে প্রত্যক্ষদর্শী জেলা পরিষদের কার্যালয়ের প্রধান ফটকের চায়ের দোকানি মো: সবুজ জানান, ওই দিন বড় মিছিল হয়েছিল; কিন্তু বিস্ফোরণের শব্দ পাননি।
আরেক প্রত্যক্ষদর্শী রাসেল কনফেকশনারির রাশেদ মিয়া জানান, তিনিও বিস্ফোরণের শব্দ শোনেননি। তবে ওই দিন বিএনপি নেতা জাকির খানের সমর্থকরা মিছিল করেছিল। আওয়ামী লীগ কার্যালয় ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের অভিযোগে বন্দর থানায় ছাত্রলীগ কর্মী মো: সোহেল মামলা করেছেন। প্রত্যক্ষদর্শী বাগবাড়ির ৪৫ বছরের নুরে আলম জানান, তিনি ঘটনার সময় পাশের চায়ের দোকানে ছিলেন। রাতে আওয়ামী লীগের মিছিল হয়; কিন্তু ভাঙচুর বা বিস্ফোরণ হয়নি।
জয়পুরহাট : জেলার কালাই থানায় বিস্ফোরক আইনে বিএনপির ১৮ জনের নাম উল্লেখ করে অজ্ঞাত আরো ৭০-৮০ জনকে আসামি করে গত বৃহস্পতিবার মামলা করেছে পুলিশ। এজাহারে বলা হয়েছে, রাজশাহী ও ঢাকার সমাবেশ উপলক্ষে সরকারি স্থাপনায় নাশকতা ও অন্তর্ঘাতমূলক কর্মকাণ্ড ঘটাতে বুধবার রাতে পৌরবাজারে বিএনপি কার্যালয়ে গোপন সভায় দুই পক্ষের মারামারি হয়। পুলিশ লাঠিচার্জ করে দু’পক্ষকে ছত্রভঙ্গ করে। পরে বিএনপির কার্যালয় থেকে দুই বিস্ফোরিত ককটেল, ২১টি বাঁশের লাঠি উদ্ধার করা হয়।
মামলার ২ নম্বর সাক্ষী কালাই উপজেলা ছাত্রলীগের আহ্বায়ক তৌফিকুল ইসলাম তৌহিদ সমকালকে জানান, ঘটনার সময় বাজারেই ছিলেন। বিএনপির কার্যালয় থেকে হট্টগোলের শব্দ শুনেছেন; কিন্তু ককটেল বিষয়ে কিছু জানেন না। উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ইব্রাহিম হোসেন বলেছেন, সভা শেষে যে যার মতো চলে গিয়েছিল। এরপর ককটেল উদ্ধারের নাটক সাজিয়ে মিথ্যা মামলা হয়েছে, যাতে বিএনপি কর্মীরা রাজশাহীর সমাবেশে যেতে ভয় পায়। তবে কালাইয়ের ওসি এস এম মঈনুদ্দীন বলেন, ঘটনা সত্য। আসামিদের গ্রেফতারে অভিযান চলছে।
বরিশাল : গৌরনদীতে পৃথক দু’টি ঘটনায় দুই মামলায় আসামি করা হয়েছে বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের দুই শতাধিক নেতাকর্মীকে। স্থানীয় সূত্র জানিয়েছে, নারীঘটিত বিরোধে ৩০ অক্টোবর বিকেলে উপজেলার খাঞ্জাপুর ইউনিয়নের বাকাই বাজারে যুবলীগের দু’পক্ষের সংঘর্ষ হয়। ঘটনার দু’দিন পর যুবলীগ নেতা শাজাহান হাওলাদার বিএনপির ২৬ নেতাকর্মীকে আসামি করে মামলা করেন। মামলার আসামি যুবদল নেতা সালাউদ্দিন সরদার বলেন, শাজাহান হাওলাদারের ওপর হামলা করে তার প্রতিপক্ষ।
গত ৫ নভেম্বর সকালে বিএনপি নেতা ইঞ্জিনিয়ার ইশরাক হোসেনের গাড়িবহরে হামলা হয় মাহিলাড়া বাসস্ট্যান্ডে; কিন্তু ওই ঘটনায় যুবলীগ নেতা রাসেল রাঢ়ীর মামলায় আসামি করা হয়েছে ইশরাকসহ বিএনপির ১৩০ জনকে।
নাটোর : মামলার এজাহার অনুযায়ী গত ১৯ নভেম্বর রাতে লালপুরের গোপালপুরে বিএনপি কার্যালয়ের সামনে থেকে পাঁচটি ককটেল, দু’টি পেট্রল বোমা ও ২১ নভেম্বর নাটোর সদর উপজেলার ডাঙ্গাপাড়া বাজার এলাকায় নির্মাণাধীন ভবনের পাশ থেকে আটটি ককটেল উদ্ধার করেছে পুলিশ। স্থানীয় আওয়ামী লীগ কর্মীরা আবদুর রাজ্জাক নামে এক বিএনপিকর্মীকে পুলিশে দিয়েছে।
বাদি যুবলীগকর্মী নেওয়াজ শরীফ বিকির দাবি, বিএনপি অফিস থেকে গালাগাল করে ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটিয়ে হামলা করা হয়। তবে স্থানীয়রা ও বিএনপি নেতারা বলছেন, এমন ঘটনা ঘটেনি।
সদর থানার ওসি নাছিম আহমেদ বলেন, পুলিশ কাউকে হয়রানি করছে না। আটটি ককটেল সাক্ষীদের সামনে উদ্ধার করা হয়েছে।
এরকম আজগুবি গায়েবি মামলা করা যায় কোনো সভ্য মানুষ তা কল্পনাও করে না। কোথাও কোনো প্রমাণ নেই, শুধু বিএনপি নেতাকর্মীদের হয়রানি করা ও ভবিষ্যতে পাইকারি হারে গ্রেফতার করার জন্য এই মামলাগুলো দায়ের করা হয়েছে। এর আরো একটি উদ্দেশ্য বিএনপির ঢাকার গণসমাবেশে যাতে অন্যান্য সমাবেশের মতো বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী উপস্থিত না হয় সেই ভয় দেখানো; কিন্তু এক মাসের মধ্যে পুলিশ এতগুলো মামলা সাজালো কেন? পুলিশের আরো একটি ভাষা আছে আর তা হলো- নাশকতার উদ্দেশ্যে কিছু লোক কোথাও সমবেত হয়েছিল। হতে পারে সেটি রেস্টুরেন্ট কিংবা কারো বাসভবন। পুলিশ যে পদক্ষেপ নিচ্ছে তাতে মানুষ আত্মীয়স্বজনদের দাওয়াত করে খাওয়ানোর সাহস পাবে না, একসাথে রেস্টুরেন্টে বসে খেতেও পারবে না। নাশকতার উদ্দেশ্যে সমবেত হয়েছিল- এ কথটি বলতে তথ্য প্রমাণ লাগে না। তারা বিএনপি নেতাকর্মীদের অন্তরের কথা জেনে যান।
কিন্তু মানুষের অন্তরের কথা জানেন একমাত্র আল্লাহ। সরকারের এসব তৎপরতা খোদগারির শামিল। তবে আমরা সব সময় দেখেছি, বালির বাঁধ দিয়ে জোয়ারের পানি ঠেকানো যায় না। সরকারও সেটি পারবে বলে মনে হয় না।
লেখক : সাংবাদিক ও সাহিত্যিক
rezwansiddiqui@yahoo.com