Site icon The Bangladesh Chronicle

ছয় মাসেই আওয়ামী লীগ এত চাপে কেন

ছয় মাসেই আওয়ামী লীগ এত চাপে কেন

সোহরাব হাসান

বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনগুলোর কমিটিতে হঠাৎ সংযোজন-বিয়োজনের ঘটনায় আওয়ামী লীগ নেতারা উল্লাস প্রকাশ করতে পারেন। ভাবতে পারেন, প্রতিপক্ষ যত দুর্বল হবে, তাদের শক্তি ও জনপ্রিয়তা তত বাড়বে। কিন্তু মাঠপর্যায়ের চিত্র তা মোটেই সমর্থন করে না।

পেশাগত কারণে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন স্তরের নেতাদের সঙ্গে প্রায়ই কথা হয়। ব্যক্তিগত আলাপে অনেকে দুঃখ-বেদনার কথা বলেন। ক্ষোভের কথা জানান। সাম্প্রতিক আজীম–বেনজির-আজিজ কাণ্ডের কথা উল্লেখ করে সংসদ সদস্যদেরও কেউ কেউ খেদ প্রকাশ করে বলেন, সরকার তো আওয়ামী লীগ চালাচ্ছে না। আওয়ামী চালালে এসব কাণ্ড ঘটতে পারত না।

নির্বাচনের পর সরকারের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ ছিল নিত্যপণ্যের দাম কমানো। কিন্তু সেটি তারা করতে পারেনি। বিশেষ করে খাদ্য পণ্যের দাম লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়ছে। গত পনের বছরে যদি কোনো খাতে বড় ধরনের ধস নেমে থাকে, সেটা হলো ব্যাংকিং খাত।

নানা কায়দা কৌশল করেও সরকার মন্দ ব্যাংকগুলোকে টেনে তুলতে পারছে না। খেলাপি ঋণের পরিমাণ বেড়েই চলেছে। অন্যদিকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। বাজেটের ঘাটতি মোকাবিলা করতে হচ্ছে দেশিয় ও বিদেশি উৎস থেকে ঋণ নিয়ে। ব্যবসায়ীদের শঙ্কা সরকার দেশিয় উৎস থেকে বেশি ঋণ নিলে তারা বেকায়দায় পড়বেন। ঋণ পাবেন না।

ফলে টানা চতুর্থ মেয়াদে ক্ষমতায় আসার পর আওয়ামী লীগের নেতা–কর্মীদের যেমনটি ফুরফুরে মেজাজে  থাকার কথা, তার ছিটোফোটাও দেখছি না।  ছয় মাসের মাথায় দলটি ঘরে–বাইরে এতটা চাপের মধ্যে পড়বে কেউ ভাবেননি। প্রথমত, আওয়ামী লীগ একতরফা নির্বাচনে জিতে মনে করেছিল, তাদের সামনে আর কোনো চ্যালেঞ্জ নেই।  জাতীয় সংসদে তাদের একক আধিপত্য, প্রশাসনের নিরঙ্কুশ কর্তৃত্ব, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী তাদের কথার বাইরে কিছু করবে না। এখন  প্রতিদ্বন্দ্বীহীন আওয়ামী লীগ নিজেই নিজের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠেছে।

নির্বাচনের আগে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর মনোভাব দেখালেও নির্বাচনের পর তারাও দৃশ্যত অবস্থান বদলেছে। মার্কিন কর্মকর্তারা বলছেন, অতীত পেছনে ফেলে তারা সম্পর্ককে এগিয়ে নিতে চান।  তাদের এই কথার আড়ালে আরও কোনো কথা আছে কি না, সেটাও ভাবার বিষয়। যুক্তরাষ্ট্রের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডোনাল্ড লু যেদিন দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ক জোরদার করার কথা বললেন, তার দুই দিন পরই সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের বিরুদ্ধে মার্কিন ভিসা নিষেধাজ্ঞা জারি হলো। এটা নিশ্চয়ই সরকার তথা আওয়ামী লীগের জন্য স্বস্তিকর নয়।

বিএনপি ও সমমনা দলগুলোর বর্জনের মুখে আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ দেখাতে এক অভিনব কৌশল নিল, যা বহুদলীয় গণতন্ত্রে দেখা যায় না। দল একজনকে মনোনয়ন দিয়ে অন্যদেরও বলল, ‘তোমরাও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পার’।

এ অবস্থায় আওয়ামী লীগের নির্বাচনী বিরোধ এখন ঘরে ঘরে, পাড়ায় পাড়ায় ছড়িয়ে পড়েছে। নৌকার বিরুদ্ধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে যাঁরা এমপি হয়েছেন, তাঁরা মনে করেন, তাঁরাম দলের চেয়ে ক্ষমতাবান। নৌকা নেওয়ার পরও যারা পরাজিত হয়েছেন, তাঁরা মনে করেন, দল তাদের ধাপ্পা দিয়েছে।

দেশে এখন যে গণতন্ত্র চলছে, সেটা পুরোপুরি এমপিনির্ভর। এমপি হলে স্থানীয় প্রশাসন তাঁর সঙ্গে থাকবে। এমপি হলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা তাঁর নির্দেশ মেনে চলবে। এমপি হলে উপজেলা পরিষদ, জেলা পরিষদ, ইউনিয়ন পরিষদ সবই তার হুকুমমতো চলবে।

উপজেলা নির্বাচনে এমপি-মন্ত্রী ও সাবেক মন্ত্রীরা যে কেন্দ্রের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে স্বজনদের দাঁড় করিয়েছেন, তার পেছনেও এই মনস্তত্ত্ব কাজ করেছে। দলের পক্ষ থেকে বলা হয়েছিল, মন্ত্রী-এমপিদের স্বজনদের যেন উপজেলায় প্রার্থী করা না হয়। বেশির ভাগ মানেননি এবং এমপিরা নিজেদের স্বজন ও পছন্দের লোকদের জিতিয়ে এনেছেন। অর্থাৎ কিছু ব্যতিক্রম ছাড়া সারা দেশে এমপিতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।

প্রথম আলোর বিশ্লেষণে দেখা যায়, ‘নির্বাচিত উপজেলা চেয়ারম্যানদের ৭০ শতাংশের বেশি মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন কিংবা ঘনিষ্ঠ, যা নির্বাচনী এলাকায় মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের আধিপত্য বিস্তারে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন ক্ষমতাসীন দলের নীতিনির্ধারকেরা। নির্বাচিত চেয়ারম্যানদের মধ্যে ৩৩ জন বর্তমান মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন। আরও তিন শতাধিক বিজয়ী চেয়ারম্যান স্থানীয় মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের পছন্দের। সব মিলিয়ে মন্ত্রী-সংসদ সদস্যদের স্বজন ও ঘনিষ্ঠদের সংখ্যা ৩৫০, যা মোট উপজেলা চেয়ারম্যানের প্রায় ৭৭ শতাংশ।’

উপজেলা নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সংঘাতে সাতজন নিহত হয়েছেন। আহত প্রায় এক হাজার। তাঁদের প্রায় সবাই আওয়ামী লীগের দলীয় নেতা-কর্মী।

এই মুহূর্তে আওয়ামী লীগকে সবচেয়ে বেশি বেকায়দায় ফেলেছে ঝিনাইদহ-৪ আসনের এমপি আনোয়ারুল আজীম ওরফে আনার খুনের ঘটনা। গত ১৩ মে তিনি কলকাতায় খুন হন। সোনা চোরাচালান নিয়ে বিরোধের জেরে তাঁকে খুন করা হয় বলে সংবাদমাধ্যমে এসেছে। খুনের প্রধান পরিকল্পক হিসেবে মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীনের নাম এসেছে। তিনি তাঁর পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করতে কলকাতায় বাড়ি ভাড়া করেন, ঢাকা থেকে খুনিদের নিয়ে যান। আওয়ামী লীগ এত দিন এটাকে দলের দায় বলে চালিয়ে দিয়েছে।

কিন্তু আনোয়ারুল আজীম খুনের ঘটনায় অভিযুক্ত শিমুল ভূঁইয়া জবানবন্দিতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের দুই নেতার নাম বলেছেন। তাঁরা হলেন ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিম ওরফে মিন্টু এবং ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ সম্পাদক কাজী কামাল ওরফে বাবু। তবে আসামির স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দীকে শত ভাগ সত্য ধরে নেওয়ারও কারণ নেই। এটা বিচার প্রক্রিয়ার অকাট্য প্রমাণ হিসেবেও ধরা হয় না।

আওয়ামী লীগ কিংবা এর সহযোগী ছাত্র সংগঠনের অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্বে খুনোখুনির ঘটনা নতুন নয়। ১৯৭৪ সালে মহসিন হলে ব্রাশফায়ার করে ছাত্রলীগের সাতজন নেতা-কর্মীকে খুন করেন প্রতিদ্বন্দ্বী গ্রুপের সদস্যরা। যাঁরা সেদিন সাত ছাত্রনেতাকে খুন করেছিলেন, তাঁরাই পরদিন ক্যাম্পাসে খুনের বিচার চেয়ে মিছিল করেছিলেন। সাত খুনের প্রধান আসামি শফিউল আলম প্রধানসহ কয়েকজন দণ্ডিাত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময় প্রধান জিয়াউর রহমানের অনুকম্পায় মুক্ত হয়ে আওয়ামী লীগবিরোধী রাজনীতি করেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যাঁরা প্রশাসনের শীর্ষ পদে ছিলেন, তাঁদের দু-একজন সম্পর্কে যেসব তথ্য-উপাত্ত আসছে, সেটা ভয়ংকর। প্রথমে সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদের বিপুল সম্পদের হদিস পাওয়া গেল। বান্দরবান থেকে গোপালগঞ্জের প্রত্যন্ত অঞ্চল, ঢাকার অভিজাত এলাকা থেকে  গাজীপুরের ভাওয়াল—সবখানেই তাঁর ও তাঁর পরিবারে সদস্যদের নামে সম্পদ আছে। আছে ডজন ডজন ফ্ল্যাট ও প্লট।

অনেকে ভেবেছিলেন, প্রশাসনকে ব্যবহার করে এক বেনজীরই বিপুল সম্পদের মালিক হয়েছেন। গত ১৫ বছরে আরও কত প্রশাসনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তা আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে আখের গুছিয়েছেন, বিদেশে সম্পদ পাচার করেছেন, তা খতিয়ে দেখা দরকার। কয়েক বছর আগে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এ মোমেন বিদেশি সংস্থার প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে বলেছিলেন, দেশ থেকে সম্পদপাচারকারীদের তালিকায় সাবেক আমলারাই শীর্ষে। আমলাদের পর এসেছে রাজনীতিকদের নাম।

ঈদের আগের দিন উত্তরাঞ্চলের এক আওয়ামী লীগ নেতা খেদের সঙ্গে বললেন,  সরকার আওয়ামী লীগের হলেও প্রশাসন আওয়ামী লীগের নয়।

বিএনপির কথা এলেই আওয়ামী লীগের নেতারা বড়াই করে বলেন, বিএনপি সামরিক শাসকের দল। ওই দলে গণতন্ত্র নেই। তারা নিয়মিত সম্মেলন করে না। প্রেস বিজ্ঞপ্তি দিয়ে কমিটি করে। কিন্তু আওয়ামী লীগ সম্মেলন করলেও কয়টি কমিটি কাউন্সিলদের ভোটে করেছে, সেই হিসেব নেওয়া দরকার।  দলের মহানগর, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের অধিকাংশ কমিটি হয় ওপরের নির্দেশে। সম্মেলনের পর সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করলেও পূর্ণাঙ্গ কমিটি হতে বছরের পর বছর পার হয়ে যায়।

সে ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পার্থক্য অনুষ্ঠানগত, মর্মগত নয়। দুই দলের গঠনতন্ত্রে গণতান্ত্রিকভাবে নেতৃত্ব তৈরির যে বিধান আছে, কোথাও তা মানা হয় না। সব সিদ্ধান্ত নেওয়ার দায়িত্ব একজনকে দেওয়া হয়। এ ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে অদ্ভুত মিল আছে।

সোহরাব হাসান প্রথম আলোর যুগ্ম সম্পাদক ও কবি

প্রথম আলো

Exit mobile version