Site icon The Bangladesh Chronicle

চীন-ভারত-যুক্তরাষ্ট্র: বিশ্বক্ষমতার সঙ্গে বাংলাদেশ

আনু মুহাম্মদ: বিশ্বে আমরা যে সময়টি পার করছি সেখানে ক্ষমতার ভারসাম্যে ফাটল দেখা যাচ্ছে এবং কেন্দ্র পরিবর্তনের চাপ বোঝা যাচ্ছে। বস্তুত বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্র একেক সময় পরিবর্তন হয়। যেমন একসময় প্রাচীন চীন, ভারত ছিল একেকটি কেন্দ্র। একসময় আরববিশ্ব ছিল গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। পুঁজিবাদের অভ্যুদয়কালে ঔপনিবেশিক সাম্রাজ্যের কারণে ক্রমে ব্রিটেন বিশ্বক্ষমতার কেন্দ্র হয়ে দাঁড়ায়।

রুশ বিপ্লবের মাধ্যমে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সোভিয়েত ইউনিয়নের আবির্ভাব ঘটলে নতুন মাত্রায় ক্ষমতার সংঘাত শুরু হয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ব্রিটেন থেকে পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রে চলে যায়। অন্যদিকে সোভিয়েত ইউনিয়ন হয়ে দাঁড়ায় সমাজতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থা ও আন্দোলনের কেন্দ্র। এভাবে দুই পরাশক্তির আবির্ভাব ঘটে। সেই সময়ে এই দুই পরাশক্তির ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও সংঘাত শুধু অর্থনৈতিকই ছিল না; মতাদর্শিক যুদ্ধেরও ব্যাপার ছিল।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর নব্বই দশকের শুরুতে বিশ্ব হয়ে দাঁড়াল এককেন্দ্রিক, যেখানে যুক্তরাষ্ট্রই কেন্দ্র। সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং সেই সূত্রে সমাজতান্ত্রিক আন্দোলন মোকাবিলার জন্য পুঁজিবাদী বিশ্বব্যবস্থার নেতৃত্বে যুক্তরাষ্ট্রের কর্তৃত্ব কার্যকর ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সেই ভারসাম্য ভেঙে যায়। এককেন্দ্রিক বিশ্বে নতুন পর্বে যুদ্ধ ফ্রন্ট খোলা হয় মধ্যপ্রাচ্যে।

যুক্তরাষ্ট্র ও চীন: শক্তি ও দুর্বলতা

আমরা আজকে চীনের উত্থান দেখতে পাচ্ছি, সেই চীনের সঙ্গে সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরোধ শুরু হয় ষাটের দশকে এবং ’৭১ থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে চীনের সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটতে থাকে। সত্তর দশকের শেষদিক থেকে চীনের বাজারমুখী অর্থনৈতিক সংস্কার শুরু। এই সংস্কারে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাতিষ্ঠানিক অনেক যোগসূত্র কাজ করেছে। বিভিন্ন ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকসহ বড় বড় প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসূত্র তৈরি হয়। গোল্ডম্যান স্যাকস, মরগ্যান স্ট্যানলি ব্যাংকসহ বড় বড় বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠানের ঘন ঘন ও বিস্তৃত যোগাযোগ স্থাপিত হয় চীনের এই সংস্কারের সময়। সে জন্য চীনের যে প্রবৃদ্ধি আমরা দেখতে পাই, তার সঙ্গে বৈশ্বিক পুঁজির সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ।

পুঁজির প্রধান বৈশিষ্ট্যই হচ্ছে মুনাফার জন্য সে যা প্রয়োজন তাই করবে; সেটি হোক অপরাধ, লুণ্ঠন, গণহত্যা বা জীবাণু যুদ্ধ। তবে পুঁজিবাদের ধরনের মধ্যে রকমফের থাকে। নরওয়ে, সুইডেনে যেভাবে পুঁজিবাদ কাজ করছে, বাংলাদেশ-ভার‍ত অথবা যুক্তরাষ্ট্রে কিন্তু ওইভাবে কাজ করে না। এখানে প্রাতিষ্ঠানিক বিষয়, অগ্রাধিকারের প্রশ্ন, শ্রমিক শ্রেণিসহ জনগণের আন্দোলন, জনআকাঙ্ক্ষা ও তাদের সাংগঠনিক শক্তির সঙ্গে সঙ্গে পুঁজিবাদের আপসও দেখা যায় নানা মাত্রায়। পুঁজি নিজেকে টিকিয়ে রাখার জন্যই অনেক সময় আপস করে। কিন্তু তার মূল যে ক্ষুধা বা চাহিদা, তার মধ্যে কোনো ধরনের পরিবর্তন হয় না।

বর্তমানে বিশ্বব্যবস্থায় যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের পেছনে তার অনেক সুবিধাজনক দিক আছে। কৃষি থেকে শুরু করে শিল্প, সার্ভিসসহ বহুজাতিক সংস্থার বেশির ভাগ কেন্দ্র যুক্তরাষ্ট্রে। যদিও বড় অনেক রাষ্ট্রীয় ও বেসরকারি সংস্থা তৈরি হয়েছে, যেগুলোর কেন্দ্র চীন, যেমন কনস্ট্রাকশন, এনার্জি, ব্যাংকিং সেক্টর। তারপরও যুক্তরাষ্ট্রের শক্তির জোরের জায়গা হচ্ছে বিশ্বব্যাপী বড় বড় বহুজাতিক সংস্থা। যুক্তরাষ্ট্রের অন্যান্য শক্তির জায়গা হচ্ছে শিক্ষা, গবেষণা এবং মিডিয়া। যুক্তরাষ্ট্রের নির্ধারক শক্তির জায়গা হচ্ছে তার সামরিক শক্তি। এটি অন্য কারও সঙ্গে তুলনীয় নয়। দুনিয়ার বাকি দেশগুলো এর পেছনে যত ব্যয় করে, যুক্তরাষ্ট্র একাই তার থেকে বেশি অর্থ ব্যয় করে এই ধ্বংসাত্মক খাতের পেছনে। উত্তর ও দক্ষিণ আমেরিকা, ইউরোপ, এশিয়া, আফ্রিকাসহ বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি রয়েছে এবং বিভিন্ন দেশের সামরিক শক্তির সঙ্গে নাড়িও বাঁধা আছে। নিজেদের এই আপেক্ষিক সুবিধাগুলোর ওপর ভরসা করেই যুক্তরাষ্ট্র তার অর্থনৈতিক আধিপত্যে এখন যে চিড় ধরেছে, সেটি মোকাবিলার চেষ্টা করছে।

অর্থনীতির জায়গা থেকে চীন সুবিধাজনক অবস্থায় থাকলেও, দেশে দেশে চীনের সামরিক ঘাঁটি নেই; শিক্ষা-গবেষণা কিংবা মিডিয়ার ক্ষেত্রে তার প্রভাব নেই। চীনের এক কর্মকর্তা একবার বলেছিলেন, আমাদের কোনো উপনিবেশ ছিল না। সুতরাং আমাদের সমৃদ্ধির পেছনে কোনো ঔপনিবেশিক ক্ষমতার ব্যাপার নেই। এটা ঠিকই, বিশ্বজুড়ে উপনিবেশ বিস্তারের মধ্য দিয়ে এখানে পুঁজির কেন্দ্রীভবন হয়নি। যেমনটি ইউরোপে হয়েছে, আর সেটির সূত্র ধরে তার সম্প্রসারণ হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের উদ্ভব, তার আধিপত্য ঔপনিবেশিক ক্ষমতার ধারাবাহিকতায়ই তৈরি হয়েছে; যেটি চীনের ক্ষেত্রে ঘটেনি। আবার ঔপনিবেশিক ও নয়া ঔপনিবেশিক ব্যবস্থার কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ভাষা, মিডিয়া এবং সমর্থক গোষ্ঠী যেভাবে তৈরি হয়েছে এবং সেই যোগাযোগ যেভাবে কাজ করছে, সেটি চীনের নেই। এটি চীনের বড় দুর্বলতার জায়গা।

বাংলাদেশে ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্র

যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়ন তো বটেই; এখন চীনও বাংলাদেশের রাজনীতি ও নির্বাচন নিয়ে কথা বলছে। রাজনৈতিক বিষয়ে এভাবে কথা বলার ধরন নতুন। একই সঙ্গে রাশিয়া, জাপান, ভারত– সব দেশই এ প্রেক্ষাপটে সক্রিয়। দেশের বর্তমান সরকারের কালে এই সব দেশেরই বিভিন্ন কোম্পানি গত ১০-১২ বছরে ব্যবসা-বাণিজ্য ও আধিপত্যের ক্ষেত্রে অনেক লাভবান হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, চীন, জাপান, ভারত, রাশিয়া প্রত্যেকেই। গত দেড় দশকে দেশে অতি ব্যয়ে বিভিন্ন মেগা প্রকল্প নেওয়া হয়েছে, যেগুলো দেশ ধরে বললে বোঝা কঠিন। কেননা, সেখানে বিভিন্ন ধরনের মিশ্রণ থাকে। যেমন রামপালকে আমরা ভারতীয় প্রকল্প বলে জানি। কিন্তু ওখানে মার্কিন ব্যাংক ও জার্মান কোম্পানি ফিখনারও সংশ্লিষ্ট। এ সময়ে বিভিন্ন নীতি ও নানা প্রকল্পের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের নতুন সম্পদশালী পুঁজিপতি গোষ্ঠীরও দ্রুত আর্থিক সমৃদ্ধি ঘটেছে। রাষ্ট্র আবার জনগণের করের টাকা থেকেও তাদের বসিয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা তুলে দিচ্ছে, যেমন বিদ্যুৎ খাতে ক্যাপাসিটি চার্জ। সরাসরি ব্যাংক লোপাট তো আছেই।

বিভিন্ন দেশের কোম্পানির সঙ্গে এই ধনিক গোষ্ঠীর অংশীদারিত্ব থাকে। যেমন মার্কিন কোম্পানি ইউনোকল যখন গ্যাস রপ্তানির জন্য উদগ্রীব হয়ে উঠেছিল, তখন বাংলাদেশে তাদের লোকাল এজেন্ট বৃহৎ ব্যবসায়ী গ্রুপ নানা অজুহাত দেখিয়ে গ্যাস রপ্তানির পক্ষে প্রচারণা চালাচ্ছিল। জনপ্রতিরোধের কারণে তারা সেটা করতে পারেনি। এখন আবার বিভিন্ন গ্রুপ এলএনজি, এলপিজি ও কয়লা প্রকল্পে লাভবান হচ্ছে। কয়লা প্রকল্পে বিভিন্ন কোম্পানির কয়লা সরবরাহ, সিমেন্টসহ নানা চুক্তি রয়েছে। রূপপুরসহ নানা প্রকল্পে এসব দেশীয় কোম্পানির সংশ্লিষ্টতা দেখি। এখানে কিন্তু কে সরকারকে সমর্থন করছে বা করছে না, তা কোনো বিষয় নয়। এখানে আছে পুঁজির সংহতি, পুঁজির আন্তঃরাষ্ট্রীয় ও আন্তঃভাষীয় সংহতি।

বাংলাদেশে ভারত ও চীনের মধ্যে প্রতিযোগিতা আছে; আবার নানা রকম সমঝোতাও আছে। বাংলাদেশে চীন থেকে আমদানি সর্বাধিক। তবে ভার‍তের সঙ্গে বেআইনি সীমান্ত বাণিজ্য ধরলে বৈধ-অবৈধ আমদানি ভারত থেকেই বেশি। এ দুই দেশেই বাংলাদেশ থেকে রপ্তানি অনেক কম। বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য বাড়ছে; নানা প্রকল্প আসছে; আরও আসবে। সড়ক, মহাসড়ক, টানেল, সেতু, কয়লা প্রকল্পসহ বহু ক্ষেত্রে চীনের আধিপত্য আছে।

তবে রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে ভারতের প্রভাব অনেক বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের ক্ষেত্রে ‘তলে তলে’ অনেক কিছু আছে বলে সরকারের মন্ত্রী ঘোষণা দিয়েছেন। প্রকাশ্যেও মার্কিন কোম্পানি এক্সনমবিল বঙ্গোপসাগরে ১৫টি ব্লকই চায় এবং সেটি যাতে তার জন্য লাভজনক হয়, সে জন্য উৎপাদন অংশীদারি চুক্তি বা পিএসসির বিভিন্ন দিক যেমন শেয়ার কে কত পাবে, মুনাফা কীভাবে ভাগ হবে, কত দামে কিনতে হবে, রপ্তানি করতে পারবে কিনা– এসব সংশোধন করে এক্সনমবিলের পক্ষে সব সুবিধা অনেক বাড়ানো হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম এজেন্ডা হচ্ছে এ অঞ্চলে তার আধিপত্য নিশ্চিত, চীনবিরোধী শক্তি মজুত ও জোট সম্প্রসারণ করা। শুধু অর্থনৈতিক স্বার্থ নয়; সমগ্র বঙ্গোপসাগরের ওপর আধিপত্য বজায় রাখা তার জন্য কৌশলগতভাবেই গুরুত্বপূর্ণ।

ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য দেশের ওইসব বৃহৎ ধনিক গোষ্ঠী আর বিভিন্ন প্রভাবশালী রাষ্ট্র; তাদের সবাইকে খুশি রাখতেই সরকার সচেষ্ট।

আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ, জাহাঙ্গীরনগর
বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক
এবং সর্বজনকথা পত্রিকার সম্পাদক

Exit mobile version