Site icon The Bangladesh Chronicle

চীন- ভারত ভারসাম্য: শেখ হাসিনা সরকারের ঝুঁকি

চীন- ভারত ভারসাম্য: শেখ হাসিনা সরকারের ঝুঁকি 

সাম্প্রতিক দশকগুলোতে, দক্ষিণ এশিয়ায় প্রায় পরাশক্তি চীন ও উদীয়মান শক্তি ভারতের মধ্যকার বৈরিতা ক্রমশই প্রকট হয়ে উঠেছে। চীন, তার উচ্চাভিলাষী বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) প্রকল্পের আওতায় দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর অবকাঠামো বিশেষ করে সমুদ্র, সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্প্রসারণের মাধ্যমে এই অঞ্চলে চীনা উপস্থিতিকে দৃঢ় করেছে। চীনের এই নয়া কৌশলকে প্রায়ই ‘অবকাঠামোগত কূটনীতি’ হিসেবে অবহিত করা হয়। ভুটান ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের সব প্রতিবেশী চীনের বিআরআই প্রকল্পের অধীনে বিনিয়োগ গ্রহণ করছে। ২০১৬ সাল থেকে চীন বাংলাদেশ, মালদ্বীপ, মায়ানমার, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা এবং আফগানিস্তানসহ বেশ কয়েকটি দক্ষিণ এশিয়ার দেশে ১৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বিনিয়োগ করেছে শুধুমাত্র অবকাঠামো খাতে।

এশিয়া প্যাসিফিক অঞ্চলে ড্রাগন অর্থনীতির দেশ চীনের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভাবা হয় ‘মালাক্কা ডিলেমা’কে, কিন্তু চীন যেভাবে দক্ষিণ এশিয়ায় কৌশলগতভাবে নিজেদের উপস্থিতি দিয়ে ‘মুক্তার মালা’ তৈরি করছে তা ভারতের জন্য একই রকম একটি ‘ডিলেমা’ তৈরি করছে। ভারতের উত্তর-পূর্ব অঞ্চল ভৌগোলিকভাবে মূল ভূখণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন, শুধুমাত্র সংকীর্ণ শিলিগুড়ি করিডোরের মাধ্যমে সংযুক্ত। শিলিগুড়ি করিডর বাংলাদেশ, নেপাল এবং ভুটানের সীমান্তবর্তী একটি ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলে অবস্থিত। করিডরটির অদূরে ভুটানের ডোকলামে চীনের উপস্থিতি তাই ভারতকে উদ্বিগ্ন রাখছে। ঠিক একই কারণে  চীন-বাংলাদেশ, চীন-নেপাল সম্পর্কের দিকে ভারতের গভীর পর্যবেক্ষণ রয়েছে।

অতি সম্প্রতি  লাদাখে ভারতের সঙ্গে চীনের সীমান্ত উত্তেজনা এবং ভারতের অরুণাচল প্রদেশকে জুড়ে চীনের মানচিত্র প্রকাশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীন-ভারতের বৈরিতায় নতুন মাত্রা দিয়েছে। ফলে  চীন-ভারতের বৈরিতা দক্ষিণ এশিয়ার আরও তীব্র থেকে তীব্রতর হবে তা কোন সন্দেহ নেই।

মালদ্বীপ, নেপাল ও শ্রীলঙ্কায় যখন চীন ও ভারত মুখোমুখি তখন বাংলাদেশে চীন ও ভারত উভয়েই বিতর্কিত নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় আসা শেখ হাসিনার সরকারের সাথে কাজ করতে অতি উৎসাহ দেখাচ্ছে। কীভাবে শেখ হাসিনার সরকার চীন ও ভারতের মাঝখানে এই জটিল ভারসাম্য করছে তা নিয়ে আগ্রহ রয়েছে ভূ-রাজনীতি বিশ্লেষকদের। এই ভারসাম্য কতদিন ঠিকবে তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।

দেশ-বিদেশে নানা বিতর্কের মধ্যে নতুন সরকার গঠনের পর শেখ হাসিনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসাবে বেছে নিয়েছেন হাসান মাহমুদকে। তিনি রাজনৈতিক অঙ্গনে ভারত ঘনিষ্ট বলে পরিচিত। হাসান মাহমুদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী হওয়ার পর প্রথম বিদেশে সফরে ভারত সফর করেছেন। নয়াদিল্লিতে প্রভাবশালী থিংক ট্যাংক বিবেকানন্দ ফাউন্ডেশনের একটি অনুষ্ঠানে তিনি বলেছেন, ‘ ভারত- বাংলাদেশ সম্পর্ককে অন্য কোন সম্পর্কের সাথে মেলানো টিক হবে না। চীনের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক অর্থনৈতিক ভারতের সাথে সম্পর্ক রক্তের।’

কিন্তু চীনের সাথে সম্পর্ক আদতে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধ নেই। সে সম্পর্ক সামরিক, কৌশলগত ও নিরাপত্তাজনিত সম্পর্কে পৌঁছেছে। বাংলাদেশ ও বঙ্গোপসাগর এখন চীনের তৈরী অস্ত্রে ঝনঝন করছে। ফলে হাসান মাহমুদের এই আশ্বাসে ভারত কতটা বুঝলো সেটা বলা মুশকিল। কারণ সে অনুষ্ঠানে মন্ত্রীকে প্রশ্ন করা হয়েছে বাংলাদেশ-চীন সামরিক সম্পর্ক নিয়ে। মন্ত্রী ভারত থেকে কিছু সামরিক সরঞ্জাম কেনার কথা বলেছেন। কিন্তু মন্ত্রীকে যেভাবে ভারতকে সন্তুষ্ট করার একটা চাপে থাকতে হচ্ছে ঠিক একই রকম চাপ চীন থেকেও এই সরকারের কাছে আসছে এবং আসবে। কারণ সরকারের ‘অগণতান্ত্রিক’ পথচলায় যখন পশ্চিমা বিশ্ব সোচ্চার তখন চীন ছিল সবচেয়ে উঁচু স্বর যে সরকারকে ‘ন্যায় সঙ্গত’ বলে দাবি করে আসছে।

বাংলাদেশের চীন-ভারত ভারসাম্য কোন পথে!: ২০১৬ সালে, যখন বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ (বিআরআই) চুক্তি স্বাক্ষর করে তখন বিআরআই-এর অধীনে ৪০টি প্রকল্পে প্রায় ৩৮ বিলিয়ন ডলারের বিনিয়োগের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল চীন, যা বাংলাদেশে এখন দৃশ্যমান। সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ (সিপিডি)-এর তথ্য মতে, ২০০৯ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত চীন বাংলাদেশে বিভিন্ন অবকাঠামো প্রকল্পে ৯.৭৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করেছে। বাংলাদেশের সামরিক বাজারেও চীন ও ভারতের নজর রয়েছে। স্টকহোম ইন্টারন্যাশনাল পিস রিসার্চ ইনস্টিটিউট (এসআইপিআরআই)-এর একটি প্রতিবেদন অনুসারে, চীন ২০১৫ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত তার মোট অস্ত্র রপ্তানির ২০ শতাংশই বাংলাদেশে রপ্তানি করেছে। পাকিস্তানের পর বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের বৃহত্তম অস্ত্র আমদানিকারক দেশ।

বাংলাদেশের সামরিকায়নের উল্লেখযোগ্য মাইলফলক হলো চীনের তৈরি দুই জোড়া সাবমেরিন। বিশ্বের মাত্র ৪২টি দেশের সাবমেরিন রয়েছে, বর্তমানে বাংলাদেশ তার মধ্যে একটি। বর্তমানে ১.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের চীনা তহবিল ও কারিগরি সহায়তায় কক্সবাজারের পেকুয়ায় শেখ হাসিনা সাবমেরিন ঘাঁটি নির্মিত হচ্ছে। এই ঘাঁটি বাংলাদেশকে সামরিকভাবে শক্তিশালী করার পাশাপাশি বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে চীনের কৌশলগত অবস্থানকেও নিশ্চিত করতে পারে। এই সামরিক ঘাঁটি যুক্তরাষ্ট্র ও ভারত উভয়কেই দুশ্চিন্তায় ফেলছে।

বাংলাদেশের সামরিক উচ্চাভিলাষ ও চীনমুখী সামরিক সরঞ্জামে ভাগ বসাতে নয়াদিল্লি ইতিমধ্যে নজর দিয়েছে। গত বছর ভারতে শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফরের সময়, বাংলাদেশ ও ভারত ৫০০ মিলিয়ন ডলারের লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি)-এর অধীনে প্রথম প্রতিরক্ষা চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তিতে পাঁচটি ব্রিজ লেয়ার ট্যাঙ্ক সাতটি পোর্টেবল স্টিল ব্রিজ এবং টাটা গ্রুপ থেকে ১১টি মাইন প্রোটেক্টিভ যানবাহন ক্রয় করার বিষয়ে সমঝোতা হয়। একই সঙ্গে বাংলাদেশ নৌবাহিনী একটি লজিস্টিক জাহাজ, ভাসমান ডক, তেল ট্যাংকার এবং একটি সমুদ্রগামী টাগবোট সংগ্রহের প্রস্তাব করেছিল। বাংলাদেশ ও ভারতের এই প্রতিরক্ষা চুক্তিকে একদিকে ভারতের পক্ষ থেকে চীনকে কাউন্টার হিসেবে এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ভারতের সঙ্গে ভারসাম্য করার কৌশল হিসেবে দেখা যেতে পারে।

বাংলাদেশের সবচেয়ে আলোচিত প্রকল্প পদ্মা সেতু নির্মাণে চীন কারিগরি নির্মাণ সহায়তা দিয়েছে, তাছাড়া সেতুতে যুক্ত রেল সংযোগ চীনের বিআরআইয়ের অংশ। চীন বাংলাদেশে ইতিমধ্যে চীনের দানে ৮টি চীন-বাংলাদেশ মৈত্রী সেতু তৈরি করেছে আরও দুটি মৈত্রী সেতু আলোচনাধীন। বাংলাদেশের মতো নদীমাতৃক দেশে সেতু কানেক্টিভিটি তৈরি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। চীন আরেকটি নদীভিত্তিক প্রকল্প ‘তিস্তা নদী প্রকল্পের’ ব্যাপারেও আগ্রহ প্রকাশ করেছে। এই প্রকল্প ভারতের খুব সীমান্তের পাশ দিয়ে নির্মিত হবে। এছাড়া এই প্রকল্প বাস্তবায়ন তিস্তা চুক্তি বাস্তবায়নের প্রয়োজনীয়তা হারাবে, যা বাংলাদেশের ভারত নির্ভরতার বিকল্প হিসাবে উদাহরণ তৈরী করবে। ফলে এই চীনা চাপে সরকার এই প্রকল্পে গেলে সেক্ষেত্রে ভারত কতটা স্বস্তিবোধ করে তা প্রশ্নসাপেক্ষ।

নির্বাচনের আগে সরকারের মধ্যে চীন ও ভারতের অর্থায়িত্ প্রকল্পগুলো উদ্বোধনের একটি তাড়না দেখা যায়। এই উদ্বোধনে সরকার এক ধরনের ভারসাম্যও করেছে।

শেখ হাসিনা নির্বাচনের আগে ৭৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের চীনা ফান্ড নির্মিত  কর্ণফুলী নদীর তলদেশের দক্ষিণ এশিয়ার প্রথম আন্ডার ওয়াটার টানেল উদ্বোধন করেন। এর কিছুদিন পর  প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি যৌথভাবে ভারতের লাইন অফ ক্রেডিট (এলওসি) অর্থায়িত তিনটি উল্লেখযোগ্য প্রকল্পের উদ্বোধন করেন। এই প্রকল্পগুলো হলো আখাউড়া (বাংলাদেশ)-আগরতলা (ভারত) ডুয়েল গেজ রেল প্রকল্প, খুলনা-মংলা বন্দর রেলওয়ে নির্মাণ প্রকল্প এবং বাগেরহাটের রামপাল মৈত্রী সুপার থার্মাল পাওয়ার প্লান্টের দ্বিতীয় ইউনিট।

নির্বাচনের পর এই দুই শক্তির সাথে ভারসাম্য করা খুব কঠিন হয়ে উঠবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী যখন দিল্লিতে ভারতকে আশ্বস্ত করতে চাচ্ছেন তখন নৌপরিবহন প্রতিমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ মানবিক রাষ্ট্র বলেই ভারতকে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার ও দেশটির অন্যান্য রাজ্যে পণ্য পরিবহনের সুযোগ দেয়া হয়েছে। ভারতের সঙ্গে চুক্তি অনুসারে তাদের দেশের জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দর ব‍্যবহার করতে পারবে এবং সেখান থেকে সড়ক পথে ভারতের অন‍্যান‍্য রাজ‍্যে মালামাল যেতে পারবে।’

বিভিন্ন সূত্র বলছে, বর্তমান সরকার ভারতকে আশ্বস্ত করেছে জাপান-ভারত-বাংলাদেশ ত্রিপক্ষীয় চুক্তির আওতায় মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দর থেকে ত্রিপুরা সংযোগ তৈরীর ব্যাপারে সরকার খুবই আন্তরিক থাকবে। অন্যদিকে চীনের সাথে ভারতের জন্য ‘উদ্বেগজনক’ প্রকল্পে যুক্ত হবে না। প্রথমটি হয়ত চীন আপত্তি করবে না। কিন্তু দ্বিতীয়টিতে  চীন একেবারে নির্বিকার থাকবে তা বলা যায় না। বর্তমান সরকারের প্রতি চীনের একচেটিয়া সমর্থনের প্রতিদান যদি চীন দাবি করে সে ক্ষেত্রে সরকার বেকায়দায় পড়বে।

সরকার ইতিমধ্যে যে অর্থনৈতিক সংকট, মুদ্রাস্ফীতি ও ডলার সংকটে ভুগছে। সে সাথে যুক্ত হয়েছে পশ্চিমা বিশ্বে সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সংকট। অর্থনৈতিক সংকট ও রিজার্ভ সংকটে পশ্চিমা বিশ্বের বাইরে একটি দেশ বর্তমান সরকারকে সাহায্য করতে পারে সেটা হলো চীন। চীন একেবারে সলিড ব্যবসায়ী। ইন্টারেস্ট ছাড়া কোথাও ইনভেস্ট করে না। সরকার সংকট কাটাতে একদিকে চীনের উপর ঝুঁকে পড়বে অন্যদিকে ভারতকে বলবে, ‘আছি আছি’, এটা করে বেশীদিন টিকে থাকা যাবে না।

নয়াদিল্লির নীতিনির্ধারক মহলে শেখ হাসিনার বিশ্বস্ত লোক রয়েছে।  সাউথ ব্লকও  শেখ হাসিনার প্রতি আস্থাশীল। কিন্তু ভারতীয় তরুণ নীতি নির্ধারকরা ভাবছে বাংলাদেশে ‘হু ইজ দ্যা নেক্সট আফটার শেখ হাসিনা ফর ইন্ডিয়া’। শেখ হাসিনা ছাড়া বাংলাদেশে দ্বিতীয় বিকল্প বন্ধু তৈরী করতে ব্যর্থ। সে একক বন্ধুর ডান হাত এখন চীনা খাঁচায় বন্দি। ফলে ভারত যে খুব একটা স্বস্তিতে নেই সেটা বুঝায় যায়।

মিয়ানমার ইস্যুতে দক্ষিণ এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে টানটান উত্তেজনা বিরাজ করছে। বাংলাদেশ ‘মানবিক’ হয়ে ভারতকে বন্দর ব্যবহার করতে দিলেও ভারত ‘মানবিক’ হয়ে রোহিঙ্গা সংকটে বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ায়নি। বর্তমান সরকারের ‘কমপ্রোমাইজ’ পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে রোহিঙ্গা সংকট সমাধান সম্ভব না।

সার্বিক পরিস্থিতি বাংলাদেশের ভবিষ্যত যেমন জটিলতায় পড়ছে তেমনি নানা বিতর্কের মধ্য দিয়ে আসা সরকারও চীন- ভারত ভারসাম্য করে বেশীদিন টিকতে পারবে বলে মনে হয়। ইতিমধ্যে নতুন সরকার নিয়ে  উভয় মহলে (চীন-ভারত) যে উদ্বেগ, অস্বস্তি তৈরী হয়েছে তা আগামী ১-২ বছরের মধ্যে স্পষ্ট হয়ে উঠবে।

বাংলা আউটলুক

Exit mobile version