চীনের সাথে বিরোধ নিস্পত্তি চায় ভুটান, উদ্বেগে ভারত

 

ইনকিলাব ডেস্ক

২৭ এপ্রিল ২০২৩, ০৫:০৩ পিএম | আপডেট: ৩০ এপ্রিল ২০২৩, ০৪:০১ পিএম

27Partages

হিমালয় পর্বতমালার পাদদেশে অবস্থিত ভুটান এশিয়ার দুই বৃহত্তম শক্তি ভারত এবং চীনের মাঝে। কিন্তু ভুটানের এই অনন্য ভৌগোলিক অবস্থান তাদের জন্য খুব একটা সুখকর নয়। যে দুটি দেশের সাথে চীনের এখনো সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি হয়নি তাদের মধ্যে ভুটান অন্যতম। অন্য দেশটি হচ্ছে ভারত, যাদের সাথে দীর্ঘ সময় হিমালয় সীমান্তে চীনের বিরোধ রয়েছে।

বিশ্বজুড়ে চীনের উত্থানের কারণে ভুটানের উপর চাপ তৈরি হচ্ছে যাতে তারা চীনের সাথে একটি সমঝোতা পৌঁছায়। কিন্তু চীনের সাথে যে কোন ধরণের সমঝোতায় পৌঁছাতে হলে ভারতের অনুমোদন লাগবে। থিম্পু এবং দিল্লির মধ্যে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক আছে এবং ভারত মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার অর্থনৈতিক এবং সামরিক সহায়তা দিচ্ছে ভুটানকে। হিমালয়ের উত্তর এবং পশ্চিম দিকে ভুটান ও চীনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিরোধ আছে।

যেসব জায়গা নিয়ে বিরোধ আছে সেগুলোর মধ্যে কৌশলগত গুরুত্বপূর্ণ অঞ্চল ডোকলাম মালভূমি রয়েছে। এ ডোকলাম উপত্যকা ভারত, ভুটান এবং চীনের সংযোগস্থলে অবস্থিত। ভুটান এবং চীন – উভয়ই ডোকলাম মালভূমি নিজেদের বলে দাবি করছে এবং ভারত এক্ষেত্রে ভুটানকে সমর্থন দিচ্ছে। ভুটানকে সমর্থন দেবার পেছনে ভারতের নিজস্ব কারণ রয়েছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ডোকলাম মালভূমি নিরাপত্তার দিক থেকে ভারতের জন্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেখানে যদি চীনের আধিপত্য তৈরি হয় তাহলে তাহলে বিষয়টি ভারতের শিলিগুড়ি করিডোরের জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।

বাইশ কিলোমিটার দীর্ঘ এ জায়গাটি ভারতের মূল ভূখণ্ডের সাথে দেশটির উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলোর সংযোগ তৈরি করেছে। সম্প্রতি বেলজিয়ামের লা লিবরা সংবাদপত্রকে দেয়া সাক্ষাৎকারে ভুটানের প্রধানমন্ত্রী লোটে শেরিং বিষয়টি নিয়ে ভুটানের সীমাবদ্ধতার কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন। ‘এই সমস্যা ভুটান একা সমাধান করতে পারবে না। আমরা এখানে তিনটি পক্ষ। এখানে বড় কিংবা ছোট দেশ বলে কিছু নেই, এখানে তিনটি দেশই সমভাবে আছে। আমরা তৈরি আছি। অন্য দুটি পক্ষ যখন তৈরি হবে তখন আমরা আলোচনা করতে পারি,’ বেলজিয়ামের সংবাদপত্রকে বলেন শেরিং।

শেরিং আশা প্রকাশ করেন, দুই-একটি বৈঠকের মাধ্যমে ভুটান এবং চীন তাদের কিছু সীমান্ত চিহ্নিত করতে সক্ষম হবে। উভয় দেশ ১৯৮৪ সাল থেকে সীমান্ত সমস্যা নিয়ে আলোচনা করছে। ভুটানের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তাদের সীমান্তে চীন প্রবেশ করেনি। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য ভারতে সতর্ক ঘণ্টা বাজিয়েছে, বিশেষ করে গণমাধ্যমে। অনেক বিশ্লেষক উদ্বেগ প্রকাশ করছেন, ভুটান হয়তো চীনের সাথে ডোকলাম উপত্যকা নিয়ে একটি বিনিময় চুক্তি করতে পারে। অনেক বলছেন, ডোকলাম উপত্যকা নিয়ে ভুটান তাদের দাবি জোরালো-ভাবে তুলে ধরছে না।

ভারতের উদ্বেগ হচ্ছে, তাদের হেনস্তা করার জন্য চীন সীমান্ত বিরোধ নিষ্পত্তি করতে ভুটানের উপর চাপ চাপ প্রয়োগ করছে, ভারতের সাবেক সিনিয়র কূটনীতিক পি স্টবডান। ভারতীয় গণমাধ্যমে এনিয়ে শোরগোল শুরুর পর ভুটানের প্রধানমন্ত্রী শেরিং গত মাসে তার বক্তব্যের ব্যাখ্যা দিয়েছেন। “আমি নতুন কিছু বলিনি এবং ভুটানের অবস্থানে কোন পরিবর্তন হয়নি,” সাপ্তাহিক দ্য ভুটানিজকে বলেছেন শেরিং।

ভুটানের প্রধানমন্ত্রী মন্তব্যের জের ধরে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম যে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে তাতে ভুটানের মানুষ অবাক হয়েছে। চীনের দৃষ্টিভঙ্গি হচ্ছে, ভারতের সমর্থন ছাড়া চীনের সাথে সমঝোতায় পৌঁছানোর ক্ষেত্রে ভুটানকে বেশ বেগ পেতে হবে। “ভারত এখানে প্রতিবন্ধক। চীন এবং ভুটান মিলে যদি সমস্যার সমাধান করে, তাহলে ভারত বাদ রয়ে যাবে। আমি মনে করি না ভারত এটা হতে দেবে,” বিবিসিকে বলেন সাংহাই ইন্সটিটিউট অব ইন্টারন্যাশনাল স্টাডিজের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো লিউ যংগিই। তিনি বলেন, ১৯৯৬ সালে চীন এবং ভুটান চূড়ান্ত চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিল, কিন্তু ভারতের হস্তক্ষেপের কারণে সেটি ব্যর্থ হয়ে যায়।

চীনের সাথে ভুটানের সীমান্ত বিরোধের বিষয়টি কয়েক দশকের পুরনোর ভারত-চীন সীমান্ত বিরোধের সাথে সম্পর্কিত। চীন এবং ভারতের মধ্যকার সীমান্ত পুরোপুরি চিহ্নিত নয়। উভয় দেশ পরস্পরের কাছে জমি দাবি করছে। ভারত বলছে তাদের প্রায় সাড়ে তিন হাজার কিলোমিটার সীমান্ত চীনের ভেতরে ঢুকে গেছে। অন্যদিকে চীন দাবি করছে তাদের প্রায় দুই হাজার কিলোমিটার সীমান্ত ভারতের ভেতরে রয়েছে। দুই দেশের সীমান্ত কার্যত শুরু হয়েছে ভারতের উত্তরাঞ্চলীয় লাদাখ থেকে শুরু করে পূর্বে অরুণাচল প্রদেশ পর্যন্ত, চীন যেটিকে দক্ষিণ তিব্বত বলে।

চীনের ক্রমবর্ধমান সামরিক এবং অর্থনৈতিক অগ্রগতির বিষয়টি ভুটানের মানুষ পর্যবেক্ষণ করছে। তারা মনে করে চীনের সাথে একটি সমঝোতা করলে ভুটানের জন্য লাভজনক হবে। “চীন একটি বাস্তবতা। চীনের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক না রাখার কোন বিকল্প কি ভুটানের আছে? আমি মনে করি এটা কোন কাঙ্ক্ষিত বিষয় নয়,” না প্রকাশে অনিচ্ছুক ভুটানের একজন পর্যবেক্ষক বলেন।

ভারত এবং ভুটান ১৯৪৯ সালে একটি বিশেষ শান্তি চুক্তি করে, যেখানে দিল্লির নিরাপত্তা উদ্বেগের বিষয়গুলো বিবেচনায় নেয়া হয়েছিল। কিন্তু ২০০৭ সালে সে চুক্তি যখন নবায়ন করা হয় তখন বৈদেশিক নীতি এবং সামরিক সরঞ্জাম ক্রয়ের ক্ষেত্রে ভুটানকে আরো বেশি স্বাধীনতা দেয়া হয়েছিল। ভুটানের ভেতরে শতশত ভারতীয় সৈন্য রয়েছে এবং তারা ভুটানের সৈন্যদের প্রশিক্ষণ দেয়। ডোকলাম থেকে মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে তাদের হেডকোয়ার্টার অবস্থিত।

ভুটানের বিশ্লেষক ওয়াংচা সাঙ্গি মনে করেন, সীমান্ত নিয়ে চীনের সাথে ভুটান একটি সমঝোতায় পৌঁছাতে পারে, যদি ডোকলাম ভুটানের কাছে ফিরিয়ে আনার জন্য ভারত চাপাচাপি না করে। ‘আমরা কিভাবে ডোকলাম দাবি করতে পারি? ডোকলামের অংশ হিসেবে আমাদের কাছে যা আছে সেটা এখনো আমাদের অংশ। যেটা আমাদের কাছে নেই, সেটা আমরা চীনের কাছ থেকে নিতে পারি না,’ বলেন সাঙ্গি। সাঙ্গির মতো বিশ্লেষকরা বলছেন, ভুটান বর্তমানে তার নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্যের আমদানির জন্য ভারতের উপর নির্ভরশীল, বিশেষ করে জ্বালানী তেল।

প্রতিবেশী চীনের সাথেও একটি বিকল্প সরবরাহ ব্যবস্থা গড়ে তোলা প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। ভুটানের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের বিষয়ে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সতর্ক প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। “ভারত এবং ভুটানের মধ্যে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ আছে। উভয় দেশের জাতীয় এবং নিরাপত্তা স্বার্থ নিয়ে আমাদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ সমন্বয় আছে,” ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি ভিনয় মোহান কাওয়াত্রা এপ্রিল মাসের প্রথম দিকে সাংবাদিকদের বলেন।

ডোকলাম উপত্যকার কৌশলগত গুরুত্বের কারণে এনিয়ে ভারত কোন পরিবর্তন চায় না। অন্যদিকে ডোকলামের উপর দাবি ছেড়ে দেবার জন্য চীনের উপর চাপ প্রয়োগ করা ভুটানের মতো একটি পক্ষে খুবই কঠিন। বিশ্বজুড়ে মানুষ যখন ‘এশিয়ান সেঞ্চুরি’ বা ‘এশিয়ার শতাব্দীর’ কথা বলছে, তখন চীন এবং ভারতের মতো দুটো বৃহৎ দেশের সাথে সীমান্ত ভুটানের জন্য একটি ভালো অবস্থান তৈরি করতে পারে। কিন্তু ভারত এবং চীনের মধ্যে যে উত্তেজনা বিরাজমান, তাতে ভুটান জন্য বিষয়টি নাজুক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। সূত্র: বিবিসি।