ইয়ংহেং ডেং
উন্নয়নশীল দেশগুলোতে তো বটেই, এমনকি অনেক উন্নত দেশেও সরকারি কর্মকর্তাদের ঘুষ খাওয়ার বিষয়টি একটি বিরাট সমস্যা। গবেষণায় বারবার দেখা গেছে, ঘুষ বা উৎকোচ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও উন্নয়নের সামনে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। এ কারণে দুনিয়াজুড়ে সরকারগুলো ঘুষের মূলোৎপাটনে অবিরাম চেষ্টা চালিয়ে যায়।
ঘুষ ও অর্থনৈতিক অনিয়ম ঠেকাতে চীনে দুর্নীতিবিরোধী অভিযানকে বিশেষ অগ্রাধিকার দেওয়া হয়ে থাকে। ২০১৩ সাল থেকে এ পর্যন্ত শত শত উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মকর্তাকে এবং ১০ লাখের বেশি নিম্নপদস্থ কর্মচারীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের অনেককেই বিচারের মাধ্যমে সাজা দেওয়া হয়েছে।
দুর্নীতি ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ায়, অর্থনৈতিক দক্ষতাকে বাধাগ্রস্ত করে এবং সামগ্রিক অর্থনীতি ও সমাজজুড়ে স্বচ্ছতা ও ন্যায্যতাকে হ্রাস করে। ঘুষের লেনদেন সাধারণত টেবিলের তল দিয়ে হয়ে থাকে। ফলে অবৈধ আয়ের পরিমাণ ও ঘুষের সুযোগের পরিসর অনুমান করা খুবই দুরূহ হয়ে পড়ে। এ বিষয় অনুমান করার একটি পথ হলো স্থায়ী আয়ের তত্ত্ব। এই তত্ত্ব দিয়ে কোনো ব্যক্তির পারিবারিক সম্পদ ও তাঁর কেনাকাটার ক্ষমতার একটি তুলনামূলক চিত্র দাঁড় করানো হয়।
ম্যানেজমেন্ট সায়েন্স নামের গবেষণা জার্নালে আমার ও আমার সহযোগীদের একটি গবেষণাপত্র শিগগিরই ছাপা হতে যাচ্ছে। সেখানে আমরা চীনের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ‘উপরি আয়ের’ পরিমাণ বুঝতে এই পদ্ধতি অনুসরণ করেছি।
গবেষণায় ২০০৬ থেকে ২০১৩ সালের মধ্যবর্তী সময়ে চীনের একটি প্রধান শহরের বাসিন্দাদের আনুষ্ঠানিক বা অফিশিয়াল আয় ও তঁাদের বাড়ি কেনার খরচের রেকর্ড নেওয়া হয়েছে। এরপর সরকারি কর্মচারীদের আয় ও তাঁদের বাড়ি কেনা এবং সরকারি চাকরি করেন না, এমন লোকদের আয় ও তাঁদের বাড়ি কেনার তুলনা করেছি।
গবেষণায় আমরা দেখেছি, চীনের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীরা তঁাদের আনুষ্ঠানিক বেতনের ৮৩ শতাংশ ‘উপরি আয়’ করে থাকেন। তবে লক্ষ করার বিষয় হলো, এই উপরি আয়ের অঙ্ক পদ–পদবির সঙ্গে অবিশ্বাস্য দ্রুততায় বৃদ্ধি পায়।
আমরা দেখেছি, একেবারে নিচু স্তরের কর্মচারীরা গড়ে তঁাদের বেতনের ২৭ শতাংশ উপরি আয় করে থাকেন। তার বিপরীতে সরকারি বিভাগীয় প্রধানদের বেলায় (চীনা প্রশাসনিক ভাষায় যাকে ‘ঝেং চু’ বলে) সেই উপরি আয় ১৭২ শতাংশে গিয়ে দাঁড়ায়। আর সরকারি কোনো বিভাগের একজন মহাপরিচালকের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত উপার্জন তাঁর বেতনের ৪২৪ গুণ বেশি হয়ে থাকে।
নীতিগতভাবে দুটি কর্মপরিবেশের মাধ্যমে দুর্নীতির ভারসাম্য হয়ে থাকে। একটি পরিবেশে দেখা যায়, পরিচ্ছন্ন আমলাতন্ত্রের মধ্যে হাতে গোনা কয়েকজন খুবই দুর্নীতিবাজ অবৈধ লেনদেন করে থাকেন। আরেকটি হলো এমন এক পরিবেশ, যেখানে সমগ্র প্রশাসনিক ব্যবস্থাজুড়ে হরেদরে দুর্নীতি ছড়িয়ে থাকে।
এই দুটি অবস্থাই অর্থনীতি ও সমাজকে ভিন্নভাবে প্রভাবিত করে। এর ফলে বিভিন্ন দুর্নীতিবিরোধী কৌশল প্রয়োজনীয় হয়ে পড়ে। অনেকে যুক্তি দেন, সরকারি কর্মকর্তারা ঘুষ খান। কারণ, তাঁরা বেসরকারি চাকরি করলে যা বেতন পেতেন, তার চেয়ে তাঁরা অনেক কম বেতন পেয়ে থাকেন। এই দাবি মূল্যায়ন করার জন্য আমরা তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, কাজের অভিজ্ঞতা, বয়স এবং লিঙ্গের মতো বিষয়গুলো বিবেচনা করেছি। কিন্তু আমরা দেখেছি, তাঁদের শিক্ষাগত যোগ্যতা ও কাজের অভিজ্ঞতা অনুযায়ী সরকারের দেওয়া বেতন কোনো অংশেই বেসরকারি কর্মীদের চেয়ে কম নয়। আমরা গবেষণা থেকেই জানতে পারছি, সরকারি বেতনের অপর্যাপ্ততা চীনা আমলাদের ঘুষ খাওয়ার প্রাথমিক কারণ নয়।
আমরা দেখেছি, চীন সম্প্রতি দুর্নীতিবিরোধী অভিযান জোরদার করার পর থেকে সেখানকার সরকারি কর্মচারীদের মধ্যে অসাধু উপায়ে উপার্জনের প্রবণতা কমে গেছে। প্রচলিত ধারার অভিযানের বাইরেও চীনকে ভাবতে হবে। লাইসেন্স দেওয়া, কর রেয়াত দেওয়ার মতো বিষয়ের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ক্ষমতা কমানোর মতো ব্যবস্থা নিতে হবে।
ইংরেজি থেকে সংক্ষেপিত আকারে অনূদিত, স্বত্ব: প্রজেক্ট সিন্ডিকেট
● ইয়ংহেং ডেং উইসকনসিন-ম্যাডিসন বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল রিয়েল এস্টেট মাস্টার্স প্রোগ্রামের পরিচালক। শ্যাং-জিন ওয়েই এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ