চিন এবং আমরা

১. চিন এবং আমরা


নিজের ঠিক নাই কিন্তু চিন ও ভারত নিয়ে আমাদের দুশ্চিন্তার অবধি নাই। সম্প্রতি ভারত ও চিনের মধ্যে সীমান্ত নিয়ে বিবাদ বাংলাদেশে খুবই হাস্যকর কিছু তর্ক তৈরি করেছে। যেমন, আমরা কার পক্ষে থাকব? বালখিল্য জোকারে দেশ ভর্তি বলেই এই ধরণের প্রশ্ন তোলা হয়। কেন বললাম? কারন আপনি কার পক্ষে থাকবেন কি থাকবেন না সেটা কেউই বাংলাদেশকে জিজ্ঞাসা করে নি, করবেও না। ঘুড়ির সুতা অনেক আগেই ছিঁড়ে গিয়েছে। ভূ-রাজনীতির হিশাব নিকাশ এখন বাংলাদেশের নাগালের বাইরে।

দশক দেড়েক আগেও ভূ-রাজনৈতিক কারণে পরাশক্তিগুলো কিছুটা হলেও বাংলাদেশকে গুরুত্ব দিত। সেসময় চিন, ভারত ও আমেরিকার মধ্যে বঙ্গোপসাগরীয় দেশ বাংলাদেশকে পক্ষে রাখা না রাখার প্রতিযোগিতা ছিল। সেই প্রতিযোগিতার সুবিধা বাংলাদেশ নিতে পারে নি। ভূ-রাজনৈতিক সুবিধাজনক পরিস্থিতি বাষ্পের মতোই দ্রুত শুকিয়ে গিয়েছে।

দুই হাজার সাত সালে বাংলাদেশে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার কায়েম হয়। দুই বছর পর সেই সরকার চলে যাবার মধ্য দিয়ে ফ্যাসিস্ট ও চরম দুর্নীতিবাজ সরকার ক্ষমতারোহন করে। বাংলাদেশে বিভেদ ও বিভাজনের রাজনীতি প্রকট হয়। বাংলাদেশের সামষ্টিক স্বার্থ নিয়ে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দেন দরবার লড়াই-সংগ্রামের শক্তি বাংলাদেশ হারিয়ে ফেলে, দেনদরবার করবার জায়গাও দ্রুত সংকুচিত হয়ে পড়ে। বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

ভারতের কাছে বাংলাদেশের কোন গুরুত্ব নাই, ভারতের অধিপতি শ্রেণী ও শাসকদের চোখে বাংলাদেশ মূলত দিল্লীর অধীন একটি ভূ-খণ্ড, যার নিজের স্বাধীন ভাবে কিছু করবার কোন ক্ষমতা নাই। ভারতের নিরাপত্তা, কিম্বা অর্থনৈতিক স্বার্থ বাংলাদেশ স্বেচ্ছায় পালন করছে। ফলে বাড়তি গুরুত্ব দেওয়া অনর্থক। দ্বিতীয়ত ভারতের শাসক শ্রেণী মনে করে বাংলাদেশের স্বাধীনতাও ভারত এনে দিয়েছে।

চিনের দিক থেকে বাংলাদেশের থাকা না থাকা কোন ব্যাপার না। পাশ্চাত্য দেশগুলোর মতো চিন সাম্রাজ্যবাদী কিম্বা আধিপত্যকামী দেশ না। তাছাড়া বিস্ময়কর অর্থনৈতিক সাফল্য চিনে এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে বাংলাদেশ নিয়ে তার এখন না ভাবলেও কোন ক্ষতিবৃদ্ধি নাই। চিনের শক্তিশালী আবির্ভাব ইতিমধ্যেই নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার ইঙ্গিত দিতে শুরু করেছে। বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ বা সামুদ্রিক ও সড়ক সংযোগ প্রকল্পের মধ্য দিয়ে চিন যে ইউরেশীয় ভূখণ্ড ও সমুদ্র ঘিরে বিপুল অবকাঠামোগত বিনিয়োগ শুরু করেছে তা কার্যত বিশ্বব্যবস্থার নতুন বিন্যাসের শুরু। বিশ্ব ব্যবস্থার ভরকেন্দ্র দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হাত থেকে সরে গিয়ে ক্রমে ক্রমে চিনের দিকে ঝুঁকে পড়ছে। চিন জানে তার মহা উদ্যোগের আপন গতিতে বাংলাদেশ আপনা আপনি অন্তর্ভূক্ত হয়ে পড়বে, বাড়তি মনোযোগের দরকার নাই। তাই বাংলাদেশ কার পক্ষে গেল বা না গেল তাতে চিন বা ভারতের কিছুই আসে যায় না। নতুন বাস্তবতায় আমাদেরকেই নতুন ভাবেই সব কিছু ভাবতে হবে, পর্যালোচনা করতে হবে এবং শিখতে হবে।

চিন সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ কীসে?

অতএব চিন সম্পর্কে আমাদের আগ্রহ একদমই ভিন্ন। আমাদের শুরুর আগ্রহ একদমই বাস্তবোচিত। প্রাকটিকাল। সেটা বোঝাবার জন্য ছোট একটা তথ্য দিয়ে শুরু করছি। বাংলাদেশের ১৯৮০ সালের অর্থনৈতিক অবস্থার সঙ্গে আমরা তিনটি দেশের তুলনা করব। দেশ তিনটি হচ্ছে চিন, মালাওয়ি এবং শাদ। উনিশ শ আশি সালে যদি আমরা যদি মাথাপিছু জিডিপির হিশাব করি তাহলে দেখা যায় চিন বাকি তিনটি দেশের চেয়েও নীচে। চিনের মাথাপিছু জিডিপি যেখানে ১.৯৩ ডলার সেখানে বাংলাদেশের মাথাপিছু জিডিপি হচ্ছে ২.২৩ ডলার। তুলনায় মালাওয়ি ২.০১ ডলার আর শাদ ২.২৯ ডলার। আমাদের একটু ঠাণ্ডা মাথায় ভাবতে হবে। তিনটি দেশের অর্থনৈতিক অবস্থার অনেক নীচে ছিল চিন। কিন্তু মাত্র চল্লিশ বছরের মধ্যে চিন অর্থনৈতিক শক্তি শুধু নয়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, রাশিয়া এবং ইউরোপের বিপরীতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্র হয়ে উঠেছে। কিভাবে এই বিস্ময়কর উল্লম্ফন সম্ভব? রীতিমতো আলাউদ্দিনের চেরাগের মতো ঘটনা মনে হচ্ছে। অবিশ্বাস্য! অথচ বাস্তব।

এই উদাহরণ কেন দিচ্ছি? প্রথমত আমাদের নিজেদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে আনার জন্য। এটাই সবার আগে জরুরি। একটা বিশাল গহ্বরে বাংলাদেশ পড়ে গিয়েছে। ভীতিকর দিক হচ্ছে যে এই বোধ অধিকাংশের মনে চেপে বসছে যে এই অন্ধকার গহ্বর থেকে আমরা আর দাঁড়াতে পারব না। সেটা ঠিক না। ওপরের পরিসংখ্যানে স্পষ্ট চীনের অবস্থা আমাদের চেয়েও খারাপ ছিল। তাই আমাদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসা হবে, চিনের বিস্ময়কর সাফল্যের চাবিকাঠি কি? কিভাবে এতো দ্রুত গতিতে চিন বিশাল অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটিয়ে দিল? এই জিজ্ঞাসার উত্তর খুঁজতে গিয়েই আমরা ফাঁকে ফাঁকে দরকারি তাত্ত্বিক ও ব্যবহারিক প্রশ্ন তুলব। চেষ্টা করব আমাদের অভিজ্ঞতার সম্পর্কিত করে চিনকে বুঝতে। যাতে আলোচনা আমাদের কাজে লাগে। বিমূর্ত কায়দায় আমরা কোন প্রশ্ন তুলতে চাইছি না। বাস্তবের আলোচনার মধ্য দিয়েই তত্ত্বজিজ্ঞাসা সামনে চলে আসবে।

চিনা সাফল্যের উত্তর দিতে হলে সবার আগে মনে রাখতে হবে চিনে মাওজে দং-এর নেতৃত্বে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে। ভারতের সঙ্গে এখানে গোড়াতেই চিনের ঐতিহাসিক পার্থক্য বিকট। ভারতের স্বাধীনতা সাম্রাজ্যবাদী ইংরেজদের সঙ্গে আপোষ রফার ফল। ভারতের স্বাধীনতা এবং ধর্মের ভিত্তিতে দেশভাগ জনগণের সশস্ত্র গণঅভ্যূত্থান কিম্বা দীর্ঘস্থায়ী জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের পরিণতি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের উত্থান এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ না হলে ইংরেজ এই আপোষ আদৌ করত কিনা সন্দেহ। আপোষে স্বাধীনতার ফলে ভারতবর্ষের মানচিত্র মূলত তৈরি করেছে ইংরেজ। বিভিন্ন দেশ বা রাজ্যের সীমানাও এই দেশের জনগণ নির্ধারণ করে নি, সেটাও ঠিক করে দিয়ে গিয়েছে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ। আপোষে স্বাধীনতা অর্জনের কারণে উপমহাদেশের রাজনীত আইন, প্রশাসন, বিচারব্যবস্থা, ভাবনাচিন্তাসহ প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রেই ঔপনিবেশিক ধারাবাহিকতা রয়ে গিয়েছে। সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদের সঙ্গে কোন চূড়ান্ত বিচ্ছেদ ঘটে নি। রাজনৈতিক বিপ্লব – অর্থাৎ নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের যা কাজ। আপোষে ঔপনিবেশিক মনিবের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাবার কারনে পুরানা ঔপনিবেশিক সম্পর্ক ও ধ্যানধারণা বহাল তবিয়তে রয়ে গিয়েছে। এমনকি ঔপনিবেশিক আমলে ‘মোহামেডান’দের বিপরীতে গড়ে ওঠা ‘হিন্দু’ পরিচয় এবং ওরিয়েন্টালিস্টদের ঋষি ও তপোবনের কেচ্ছার ওপর ভিত্তি করে যে একাট্টা হিন্দু ধর্ম ও হিন্দু জাতির ধারণা নির্মাণ করা হয়েছে, সেটাই পরবর্তীতে আরও পুষ্ট হয়েছে। এখন তা আরএসএস ও নরেন্দ্র মোদীর হিন্দুত্ববাদ হয়ে ভারত শাসন করছে।

উপমহাদেশে ‘হিন্দু’ নামে কোন ধর্ম ছিল না। ভাষা, সংস্কৃতি ও জীবনাচারের দিক থেকে বিভিন্ন ধর্ম এবং ধর্মাচারের চর্চা হোত। সিন্ধু নদীর অববাহিকায় যারাই বাস করে তারা সকলে ‘হিন্দু’। কিন্তু কলোনিয়াল হিন্দু ‘ভারত’কে ‘হিন্দুস্তান’ বলতে রাজি না, কারন তা মুসলমানদের দেওয়া নাম, মুঘলদের সাম্রাজ্য। প্রহসন হচ্ছে ‘হিন্দুস্তান’ নামের মধ্যে মুসলমান অন্তর্ভূত।  কিন্তু ‘ভারত’ নাম তা ধারণ করে না। সেখানে মুসলমান ‘অপর’, ভারতের বাইরে থেকে আসা আপদ। যদি ধর্মের ভিত্তিতেই দেশভাগ হয়ে থাকে তাহলে ভারত শুরু থেকেই একটি হিন্দু ধর্মরাষ্ট্র, যে রাষ্ট্রে মুসলমানের স্থান নাই। এ বিষয়ে এতদিন আমরা গুজগুজ ফিসফাস শুনতাম, ভারতের ধর্ম নিরপেক্ষতার দাবির আবরণে এই সত্য ঢাকা পড়ে থাকত। কিন্তু ভারতীয় জনতা পার্টির মধ্য দিয়ে হিন্দু জাতিবাদীদের উত্থানের পর এ ব্যাপারে কোন সন্দেহ থাকা উচিত নয়। আরএসএস ও হিন্দুত্ববাদীদের ‘হিন্দু, হিন্দি হিন্দুস্থান’ শ্লোগানে বিভ্রান্ত হবার কারণ নাই। ‘হিন্দুস্তান ‘ আর সাভারকারের ‘হিন্দুস্থান’ এক না। ‘হিন্দু’র সঙ্গে সংস্কৃত ‘স্থান’ যুক্ত করে তাকে জাতিবাদী হিন্দুর জন্য পবিত্র করে নেওয়া হয়েছে (Chopra, 2017)।

নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব

নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের দুটো স্তর রয়েছে। প্রথম স্তরের কাজ হচ্ছে সাম্রাজ্যবাদ এবং সামন্তবাদের বিরুদ্ধে শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে ব্যাপক সংখ্যক সাধারণ জনগণকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে সাম্রাজ্যবাদী ও সামন্তবাদী সকল শ্রেণী ও শক্তি উপড়ে ফেলা বা উৎখাত করা। তা না হলে উৎপাদন শক্তির দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশ সম্ভব না, সমাজতন্ত্রের আর্থ-বৈষয়িক শর্ত তৈরিও অসম্ভব। দ্বিতীয় পর্যায় হচ্ছে সমাজতন্ত্র নির্মাণের পর্ব। দ্বিতীয় পর্বে কমিউনিস্ট পরীক্ষা-নিরীক্ষা নিয়ে বিস্তর তর্ক বিতর্ক আছে, লেনিন কিম্বা মাও জে দং দুইয়ের কেউই সেই তর্কে সমালোচনার উর্ধে নন। তর্কের কয়েকটি মূল বিষয়ের মধ্যে রয়েছে ওপর থেকে বল প্রয়োগের মধ্য দিয়ে সমাজতন্ত্র আদৌ কায়েম সম্ভব কিনা, দ্বিতীয়ত সমাজতন্ত্রের বৈষয়িক শর্ত তৈরির জন্য উৎপাদন শক্তি বিকাশের নীতি ও কৌশল কি হবে? উৎপাদনের সম্পর্ক কি হবে? সমাজতান্ত্রিক? নাকি পুঁজিতান্ত্রিক? এই দুইটি জিজ্ঞাসা মূলত কমিউনিস্ট নেতৃত্বের অধীনে দ্রুত ও ত্বরান্বিত উৎপাদন শক্তির বিকাশের জন্য পুঁজিতন্ত্রের ভূমিকা নিয়ে তর্ক। কমিউনিস্ট শাসনের ব্যর্থতার প্রধান কারণ এই তর্কের মীমাংসা না হওয়া। চিনের অভিজ্ঞতা এই প্রথম এই তর্কের একটা ব্যবহারিক মীমাংসা হাজির করেছে। তাই চিনের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিস্তর আলোচনা-পর্যালোচনা তর্কবিতর্কের সুযোগ আছে, যা আগামি দিনে সমাজতান্ত্রিক রূপান্তরের ক্ষেত্রে ক্রিটিকাল কিন্তু ইতিবাচক ভূমিকা রাখবে। এটা মনে রাখা দরকার মাও জে দং-এর ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’ কেন্দ্র করে এই তর্কগুলোই বিপুল রক্তক্ষয় ঘটায়। ‘সাংস্কৃতিক বিপ্লব’-এর মূল বিতর্ক ছিল বিপ্লবোত্তর চিনে অর্থনৈতিক সম্পর্কের ধরণ নিয়ে। এটা পরিষ্কার কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে যারা উৎপাদন শক্তির বিকাশের জন্য বাজার ব্যবস্থার ভূমিকা স্বীকার করেছেন তারাই শেষাবধি জয়ী হয়েছেন। তাহলে চিন থেকে শিক্ষা নিতে হলে সবার আগে চিনের নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব এবং তারপর বিপ্লবোত্তর চিনের ‘চিনা বৈশিষ্ট্যের পুঁজিতন্ত্র’ কেন্দ্র করে যে সকল তর্ক বিতর্ক চলেছে সেইসব আমাদের নজরের সম্মুখে আনতে হবে। এই কাজ খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

গণতান্ত্রিক বিপ্লবের পরে চিনের সমাজতন্ত্র কেমন হবে তা নিয়ে বিপুল তর্কবিতর্ক বিভিন্ন দিকে শাখা প্রশাখা নিয়ে গড়িয়েছে। কিন্তু মাও জে দং-এর একটি কথা একসময় খুবই জনপ্রিয় হয়েছিল। তিনি বলেছিলেন চিনের সমাজতন্ত্র চিনের মতোই হবে। তর্কের সার কথা ছিল উৎপাদন শক্তির দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশের জন্য চিন আদৌ বাজার ব্যবস্থা গড়ে উঠতে দেবে কিনা, যার অর্থ পুঁজিতন্ত্রের পথে যাওয়া।  পুঁজিতন্ত্র থেকে সমাজতন্ত্র এবং সমাজতন্ত্র থেকে কমিউনিজমে উত্তরণের তর্ক এখনও কমিউনিস্ট রাজনীতির অতিশয় গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু অমীমাংসিত তর্ক। এই তর্কের মীমাংসা হয় নি।

মনে রাখুন, যুদ্ধোত্তর বাংলাদেশে শেখ মুজিবর রহমানকে অর্থনৈতিক পুনর্গঠনের কাজ করতে দেওয়া হয় নি।– অর্থাৎ দ্রুত ও ত্বরান্বিত জাতীয় আর্থ-সামাজিক ভিত্তি গড়ে তোলার কাজ করবার রাজনৈতিক গুরুত্ব বাংলাদেশ বোঝে নি। আর্থ-সামাজিক উন্নতি কিম্বা সমৃদ্ধ জাতীয় অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য কি ধরণের উৎপাদন সম্পর্ক উপযোগী সেই তর্কে বাংলাদেশও অতিশয় দুর্বল। সমাজতন্ত্র বনাম পুঁজিতন্ত্রের বাইনারির মধ্যে খাবি খেয়ে এই অতি গুরুত্বপূর্ণ জিজ্ঞাসা হারিয়ে গিয়েছে। এই দুইয়ের মাঝখানে পুঁজিতন্ত্রের বহু প্রকারভেদ আছে সেই তর্ক আমরা করি নি। কমিউনিস্ট সাহিত্যে তার মীমাংসা হয়েছে সেটা দাবি করা যাবে না। কিন্তু চিন পুরানা তর্ক নতুন ভাবে করবার তাগিদ তৈরি করেছে।

পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের কাজে মুজিব সন্তানেরাই সমাজতন্ত্রের নামে ঘোরতর বিরোধিতা করেছিল। শেখ মুজিবর রহমানের ছাত্র লীগই ‘জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল’ (জাসদ) ও ‘গণবাহিনী’ গঠন করে। তাদের পণ তারা ‘বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র’ কায়েম করবে। পুঁজি কিম্বা পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের প্রতি এদের দৃষ্টিভঙ্গী চরম প্রতিক্রিয়াশীল। এটা শুধু ছাত্রলীগের ব্যাপার নয়, আওয়ামী পন্থী এবং রুশ-ভারত অক্ষ শক্তির পক্ষপাতী সোভিয়েত সমর্থক কমিউনিস্টদের ধ্যানধারণাও তাই। স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম হবার পর থেকে পেটি বুর্জোয়া শ্রেণী এবং তাদের চরম প্রতিক্রিয়াশীল ধ্যান ধারণাই বাংলাদেশের রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে আধিপত্য বিস্তার করে রেখেছে। এই দিকটি আরো ভালভাবে বুঝতে হলে বাংলাদেশের পেটি-বুর্জোয়া শ্রেণীর মনোজগত ও বুদ্ধিবৃত্তিক পরিমণ্ডল নিয়ে প্রচুর গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

ছাত্রলীগ এবং জাসদ ধরণের পেটি বুর্জোয়া সমাজতন্ত্রীরা বিপ্লবী মাওবাদী ধারাকে মোকাবিলা ও নস্যাৎ করবার ভূমিকাও পালন করে। এই দিকটির সম্যক উপলব্ধির জন্য বাংলাদেশের সেই সময়ের রাজনৈতিক তর্ক বিতর্ক গুরুত্বপূর্ণ। যেমন সামন্ততন্ত্র নাকি আধা-সামন্ততন্ত্র বাংলাদেশের প্রধান দ্বন্দ্ব? নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লবের অর্থনৈতিক মর্ম কী? বাংলাদেশে কি পুঁজিতন্ত্র এসে গিয়েছে? যদি এসে থাকে তাহলে কর্তব্য কি সমাজতন্ত্র কায়েম? এই তর্কগুলোকে আমরা এখন আর গুরুত্বপূর্ণ মনে করি না। অথচ এই জিজ্ঞাসা এখনও পুরানা হয় নি, এখনও প্রাসঙ্গিক ও অতীব গুরুত্বপূর্ণ। চিন নিজেদের মধ্যে রক্তক্ষয়ী লড়াই সংগ্রামের মধ্য দিয়ে এই সকল তর্কের মীমাংসা করেই আজ বিশ্বশক্তি হয়ে উঠেছে। চিন সম্পর্কে জানবার পাশাপাশি এই তর্কগুলোই আমাদের আবার ধীরে ধীরে সামনে আনতে হবে। আনতে হবে সহজ ভাবে, সাধারণ মানুষ যেন বোঝে, ভাবে এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে। আমরা চিনের পক্ষে যাব, নাকি ভারতের – এই ধরণের মেরুদণ্ডহীন অনর্থক তর্ক আমাদের কোথাও নেবে না।

তাহলে উৎপাদন শক্তির দ্রুত বিকাশের জন্য কমিউনিস্টদের নেতৃত্বে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ একালে কর্তব্য কিনা সেটা চিন খুবই গুরুত্বপূর্ণ তর্কে পরিণত করেছে। তাত্ত্বিক এবং ব্যবহারিক উভয় দিক থেকে। এই তর্ক যে প্রবল রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব সংঘাত ঘটিয়েছিল সেই তুফান পার করেই আজ চিন বিশ্বের দরবারে হাজির হয়েছে। অনেক আত্মত্যাগের মধ্য দিয়ে চিন আজ বর্তমান ইতিহাসের সামনের কাতারে উঠে এসেছে। যারা রাজনৈতিক-দার্শনিক তর্ক বিতর্ককে স্রেফ তাত্ত্বিক ব্যাপার মনে করেন এবং ধরে নেন গুরুত্বপূর্ণ তর্কের মীমাংসা ছাড়াই একটি দেশে বৈপ্লবিক রূপান্তর ঘটানো সম্ভব, তারা চরম মূর্খ ছাড়া কিছুই নন।

বাংলাদেশের জন্য এই ক্ষেত্রে শিক্ষণীয় কি? প্রথম শিক্ষা হোল, যদি আমরা বৈপ্লবিক কায়দায় দ্রুত চিনের মতো বাংলাদেশকে সমৃদ্ধশালী করতে চাই, তাহলে বৈপ্লবিক রূপান্তর সংক্রান্ত গোড়ার রাজনৈতিক তর্ক অমীমাংসিত রাখলে হবে না। সাহসের সঙ্গে মোকাবিলা করতে হবে। মীমাংসা করা না গেলে সমাজ এগোয় না। অতএব তর্কের মীমাংসা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। চিনের বাস্তব ইতিহাস কিভাবে কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে উৎপাদন শক্তির বিকাশের তর্ক মীমাংসা করেছে তার হদিস নিতে হবে। চিনের অভিজ্ঞতা পর্যালোচনা করে আমাদের মতো দেশে কি সম্ভব আর কি সম্ভব নয় তার হদিস সন্ধানের কাজ সহজ হতে পারে। একটি বিপ্লবী কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ এবং বিস্ময়কর অর্থনৈতিক উল্লম্ফন কিভাবে সম্ভব? আপাত দৃষ্টিতে যতোই স্ব-বিরোধী মনে হোক না কেন, চিনের অভিজ্ঞতা আমাদের এই জিজ্ঞাসার মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।

এর সঙ্গে আরেকটি আদর্শিক তর্ক জড়িত। সমাজতন্ত্র কি আদতে একটি নৈতিক আদর্শ নাকি একটি ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া যার বৈষয়িক ভিত্তি পুঁজি তৈরি করে দেয়?  মার্কসের গোথা কর্মসূচী এই জিজ্ঞাসার কিছুটা উত্তর দেয়। বৈষয়িক বাস্তবতা সমাজতন্ত্রের পক্ষে না থাকলে সমাজতন্ত্র গায়ের জোরে কায়েম করা যায় না। চিনের অভিজ্ঞতা প্রমান করেছে সমাজতন্ত্র স্রেফ গরিব, হতদরিদ্র ও খেটে খাওয়া জনগণের প্রতি দয়া, মায়া বা নৈতিক পক্ষপাত নয়। এটি একটি বৈষয়িক ঐতিহাসিক প্রক্রিয়া, যা আপনা আপনি ঘটে না। ঘটাবার জন্য কর্তাশক্তির দরকার হয়।

তত্ত্বগত প্রস্তুতি: মার্কসের ‘পুঁজি’

তাই চিনকে বুঝতে হলে আমাদের কিছু তত্ত্বগত প্রস্তুতি দরকার। প্রথমত এটা মনে রাখতে হবে বিশ্ব ব্যবস্থার বাইরে ‘চিন’ নামক আলাদা কোন অর্থনৈতিক পরিমণ্ডল নাই। শুধু চিন কেন, ভারত, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ, জাপান, আফ্রিকা ও ল্যাটিন আমেরিকার দেশ কেউই এই ব্যবস্থার বাইরে নয়। চিন বহু আগেই বুঝতে পেরেছে পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্বব্যবস্থায় কোন দেশই পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়নের বাইরে থাকতে পারে না। থাকা অসম্ভব। পুঁজি প্রতিনিয়তই এই ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস ঘটিয়ে চলেছে। এই শতাব্দির শুরু থেকে এই পরিবর্তনের গতি আরো দ্রুত হয়েছে, বৈশ্বিক উৎপাদন কাঠামো কিম্বা আন্তর্জাতিক শ্রম বিভাগও ক্রমাগত পুনর্বিন্যস্ত হচ্ছে। বিশ্ব ব্যবস্থায় চিনের উত্থান আরো দৃশ্যমান হয়েছে। পাশাপাশি এটা পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে যে বিশ্ব ব্যবস্থার কেন্দ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইংলণ্ড কিম্বা ইউরোপ থেকে ক্রমেই এশিয়ায় স্থানান্তরিত হচ্ছে। এই ক্ষেত্রে যুদ্ধ বিগ্রহ, বাণিজ্য, বিজ্ঞান ও কৃৎকৌশলে বিপ্লব ইত্যাদি নানান ফ্যাক্টর এবং বিভিন্ন দেশের মধ্যে প্রতিযোগিতা ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা থাকলেও  নৈর্ব্যক্তিক শক্তি হিশাবে ‘পুঁজি’ কিভাবে এই পুনর্বিন্যাসের গতি ও চরিত্র দান করে চলেছে তা ভালভাবে বোঝা খুবই জরুরি।

কমিউনিজমের নামে বিশ্ব বাজার বা বিশ্ব ব্যবস্থা থেকে নিজেকে গুটিয়ে আলাদা না রেখে ১৯৭৮ সালে চিন এই ব্যবস্থার মধ্যে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করবার সিদ্ধান্ত যখন নিয়েছিল, সেটা শুধু বিশ্ব বাজারে যুক্ত হবার তাগিদে নয়। চিনের আভ্যন্তরীণ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলার জন্য আভ্যন্তরীন সংকটের চাপ মেটানো খুবই জরুরি ছিল। আন্তর্জাতিক বাণিজ্য সংস্থার সদস্য হবার জন্য চিনের বিশেষ চেষ্টা ও তৎপরতাও সেই কারনেই আমরা দেখেছি।


Mao


তাহলে তত্ত্বগত প্রস্তুতির জন্য আমাদের প্রথম কাজ হচ্ছে, মানুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার তোয়াক্কা না করে নৈর্ব্যক্তিক শক্তি (objective) হিশাবে পুঁজি বিশ্বব্যাপী যে পরিবর্তন ঘটায় সেই লজিক বোঝা। দ্বিতীয়ত পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরের ইতিবাচক ফলগুলোর দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশ নিশ্চিত করবার জন্য পুঁজির ওপর চিন রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ কিভাবে জারি রেখেছে সেটাও বোঝা। ঘনিষ্ঠ ভাবে চিনের বাস্তব পরীক্ষানিরীক্ষা পরখ করে বিচার করতে শেখা। কোন পেটি বুর্জোয়া নৈতিকতা বা নীতিবাগীশতা দ্বারা না। যেমন পুঁজিতন্ত্র খারাপ, অতএব চিন যতোই সফল হোক সেটা মন্দ। এই উন্নাসিকতা বাস্তব অবস্থার বাস্তব বিশ্লেষণ কোন কাজে আসে না। তৃতীয়ত পুঁজিতন্ত্রের স্ববিরোধিতা, সংকট এবং বিপদ সম্পর্কে কার্ল মার্কস যা বলে গিয়েছেন তার সবই চিনের পুঁজিতান্ত্রিক উন্নতির কুফল হিশাবে যারপর নাই বিদ্যমান। তাকেও নজরে রাখতে হবে। ‘এন্ড অব হিস্টরি’ বা মানবেতিহাসের পরিসমাপ্তি পুঁজিতান্ত্রিক বিশ্ব ব্যবস্থায় নয়, বরং গুণগত ভাবে নতুন বিশ্ব ব্যবস্থার বৈষয়িক ভিত্তি আমাদের চোখের সামনেই তৈরি হয়ে চলেছে। এই পরিপ্রেক্ষিতে চিনের রাজনীতি, কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা, পার্টির আভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব ও সংগ্রাম কিম্বা চিনের রাষ্ট্র ক্ষমতার চরিত্র কোন মনগড়া কিম্বা আগাম কোন অনুমান মাথায় রাখলে বোঝা যাবে না।

চিনকে বোঝার ক্ষেত্রে সবচেয়ে বড় বাধা হচ্ছে আমরা পাশ্চাত্যের ইতিহাস দিয়ে চিনকে বোঝার চেষ্টা করি। পাশ্চাত্য সমাজ ও ইতিহাস বিশ্লেষণের যে পদ্ধতি ও মানদণ্ড খাড়া করেছে তা দিয়েই চিনের বাস্তবতা পরিমাপ করি। পাশ্চাত্য উন্নয়ন মডেল, এংলো-স্যাক্সেন গণতন্ত্র এবং একালের নিউ লিবারেলিজম দিয়ে চিন বোঝা যাবে না। পাশ্চাত্য চিনকে এই জন্যই বুঝতে ভুল করেছে। ক্ষমতায় থেকে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ থেকে যা আদায় করে নেওয়া সম্ভব চিনের কমিউনিস্ট পার্টি সেটা কিভাবে আদায় করে নিল, সেটাই আমাদের সবার আগে বুঝতে হবে। অর্থাৎ দ্রুত ও বিপুল গতিতে উন্নতির তরিকা চিনের কাছ থেকে শেখাটা আমাদের এখনকার প্রধান একটি কাজ। ভারত এটা আমাদের শেখাতে পারবে না। পাশ্চত্যের কোন মডেলও এই ক্ষেত্রে কাজ করবে না। চিনের অভিজ্ঞতা সম্পূর্ণ নতুন ধরণের অভিজ্ঞতা।

কিন্তু সেই বোঝাবুঝির জগতে প্রবেশ করতে হলে ‘পুঁজি’ সম্পর্কে আমাদের প্রথাগত বদ্ধমূল চিন্তা থেকে মুক্ত হতে হবে। আমরা যখন ‘পুঁজি’ কথাটা ব্যবহার করি,  সেটা ‘পুঁজি’ সম্পর্কে প্রচলিত ধারনা। নিউ ক্লাসিকাল, কিম্বা কীনসিয়ান অর্থনীতির অনুমান ও বর্গও এখানে খাটে না। এই ক্ষেত্রে কার্ল মার্কস আমাদের কাজে লাগে। মার্কস ‘পুঁজি’কে যে অর্থে বিশ্ব-ঐতিহাসিক বলেছেন এবং পুঁজির উত্থান অনিবার্য ভাবেই বিশ্বকে তার চরিত্রের নিয়ম অনুযায়ী বিন্যস্ত করবে সেই ভবিষ্যদ্বাণীও করেছেন। এসবের মানে আমাদের নতুন করে পর্যালোচনা করতে হবে। আমরা কার্ল মার্কস না পড়ে ‘পুঁজি’ বুঝতে চাই। সেভাবে বুঝলে চিন বোঝা যাবে না। বর্তমান বিশ্ব ব্যবস্থাও না।  মার্কস যেভাবে পুঁজি বুঝেছেন সেই ভাবেই বুঝতে হবে। বলে রাখি, চিন্তা পাঠচক্রের সভায় আমরা অনেকবারই দাবি করেছিলাম ‘পুঁজি’কে নৈর্ব্যক্তিক প্রক্রিয়া হিশাবে বুঝবার যে পদ্ধতি মার্কস আমাদের শিখিয়ে গিয়েছিলেন সেটা নিষ্ঠার সঙ্গে আবার পাঠ করলে আমরা হয়তো চিনের অতি দ্রুত পুঁজিতান্ত্রিক রূপান্তরের শক্তি বা ‘রহস্যময়’ জায়গাটা ধরতে পারব। একই সাথে বাংলাদেশে আমাদের কর্তব্যের জায়গাগুলোও অনায়াসে বুঝব। এ কথা মনে রেখেই আমরা মার্কসের ‘পুঁজি’ আবার পড়তে তরুণদের উৎসাহিত করি।

তবে যেটা পরিষ্কার সেটা হোল, শুধু নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব করেই চিনের এগিয়ে যাওয়া নিশ্চিত হয় নি। পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের ওপর রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ জারি রাখার পথও চিনের কমিউনিস্ট পার্টিকে আবিষ্কার করতে হয়েছে। তার জন্য নিজেদের মধ্যে চিনের রাজনৈতিক ধারা উপধারার মধ্যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামও হয়েছে। তার পক্ষে বিপক্ষে বক্তব্য আছে। কোন কিছুই আপসে আপ ঘটে নি। সেই সংগ্রামের ইতিহাসও আমাদের জানতে হবে। দ্রুত সেই তর্কে প্রবেশ করতে চাইলে রাজনৈতিক-দার্শনিক পর্যায়ের প্রাথমিক তর্কগুলোর হদিসও আমাদের নিতে হবে। আমরা চেষ্টা করব উপযুক্ত জায়গায় সেই তর্ক ধরিয়ে দেবার। তবে আগ্রহীরা প্রাথমিক পর্যায়ে চিনের তিনটি প্রধান দার্শনিক তর্কবিতর্ক পড়ে রাখতে পারেন (Group, 1973)। এ নিয়ে আমরা আলাদা আলোচনা করব, যাতে সারমর্মে দার্শনিক জায়গা থেকে চিনের উন্নতির তর্ক এবং তার রাজনীতি আমরা বুঝতে পারি। তবে কাজ হচ্ছে তত্ত্ববাগীশগিরি করা না। বাস্তবোচিত ভাবে চিনের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা ও নীতি ঘনিষ্ঠ ভাবে পর্যালোচনা করা। তাহলেই তর্কগুলোর মর্ম ধরা পড়তে শুরু করবে। আমাদের মতো গরিব, অনুন্নত ও কাণ্ডজ্ঞানবর্জিত দেশের জন্য এই তর্কগুলোর দিকেই হয়তো সবার আগে মনোযোগ দেওয়া দরকার। তর্কগুলো আমাদের জন্য খুবই প্রাসঙ্গিক এবং চিনের অভিজ্ঞতা থেকে শেখার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। নইলে আমরা কি চিনের দিকে যাব, নাকি ভারতের দিকে – ইত্যাদি যারপরনাই বালখিল্য তর্ক করে আমরা সবার কাছে হাস্যকর হয়ে উঠব। চিন বা ভারত কেউই বাংলাদেশের তোয়াক্কা করে না। কিন্তু জনগণ কিভাবে ইতিহাস সৃষ্টি করে এবং বিশ্বসভায় মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়ায় সেটা বোঝার ওপর আমাদের নিজেদেরও মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াবার হিম্মত গড়ে উঠতে পারে। হয়তো বা আমরাও দাঁড়াতে শিখব।

কয়েকটি দিক নির্দেশক মন্তব্য

চিন ও ভারতকে সামনে রেখে কোন তুলনামূলক আলোচনা যদি আমরা করি এবং দুই দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিখতে চাই তাহলে দেখা যাচ্ছে গোড়াতেই কয়েকটি পয়েন্ট সামনে চলে আসে।

এক: অনেক আগেই মাও জেদং-এর নেতৃত্বে ১৯৪৯ সালে নয়া গণতান্ত্রিক বিপ্লব সম্পন্ন করার মধ্য দিয়ে চিন তার বর্তমান ঐতিহাসিক উল্লম্ফনের শর্ত সম্পন্ন করে এসেছে, বিশেষত ভূমি থেকে সামন্ত ব্যবস্থার বৈপ্লবিক উচ্ছেদের মধ্য দিয়ে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশের শর্ত আগে থেকেই তৈরি হয়ে রয়েছে। কিন্তু ভারতে সেটা ঘটে নি। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে চিনে পুজিতান্ত্রিক বিকাশ দ্রুত ও ত্বরান্বিত কেন হোল তার ব্যাখ্যা এই গোড়ায় – অর্থাৎ গণতান্ত্রিক বিপ্লবের মধ্যে সন্ধান করতে হবে। চিনকে বুঝতে হলে চিনা বিপ্লব সম্পর্কে ধারণা থাকতে হবে।

দুই: স্টালিনের নেতৃত্বে সোভিয়েত রাশিয়া জোর করে ওপর থেকে সমাজতন্ত্র আরোপের যে ভুল পথ প্রয়োগ করে ব্যর্থ হয়েছিল বিপ্লবোত্তর চিনেও সেই ভুলের পুনরাবৃত্তি ঘটেছিল। দেখা যাচ্ছে  চিন সেই ভুল এড়াতে পেরেছে। ওপর থেকে সমাজতন্ত্র চাপিয়ে দেবার নীতি থেকে চিন সরে এসেছে। কিন্তু চিনের বৈশিষ্ট্যসূচক দিক হচ্ছে পুঁজিতন্ত্রকে কমিউনিস্ট পার্টিও অবাধ বা কাছাখোলা করে নি এবং কমিউনিস্ট পার্টির নিয়ন্ত্রণ শিথিল হতে দেয় নি। এখানে চিনের পুঁজিতন্ত্রের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক-আইএমএফ-ডব্লিওটিও নির্দেশিত কাছাখোলা পুঁজিবাদের পার্থক্য। চিনের আভ্যন্তরীণ শ্রেণী সংগ্রামে যারা জয়ী হয়ে এসেছেন তাদের বিজয় বর্তমান চিনের পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ নিশ্চিত করেছে, তারা চিনের বাস্তব অবস্থা পর্যালোচনা করে বাস্তব পদক্ষেপ নিয়েছেন, বাইরের – অর্থাৎ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির প্রেস্ক্রিপশান মোতাবেক দেশ চালান নি।

তিন: তুলনায় ভারত সাম্রাজ্যবাদী সম্পর্কেরই ধারাবাহিকতা মাত্র। ভারতের শাসক শ্রেণী ঔপনিবেশিক এংলো-ইন্ডিয়ান চিন্তার বাইরে ভাবতে অক্ষম। ভারতে জাতপাত প্রথা ও পুরনা সামন্ততান্ত্রিক সম্পর্ক ইংরেজ ঔপনিবেশিক শাসনের জন্য টিকিয়ে রাখা হয়েছিল,, ভারতের এংলো-ইন্ডিয়ান শাসক শ্রেণীও টিকিয়ে রাখার ধারাবাহিকতাই অক্ষুণ্ন রেখেছে। বৈপ্লবিক কায়দায় পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশের প্রতিবন্ধক হিশাবে গণ্য জাতপাত বা বর্ণশ্রম প্রথা এবং পুরানা সামন্ত সম্পর্ক আজও  উপড়ে ফেলে নি। ফলে নিউ-লিবারাল কালপর্বে পুঁজি ভারতে জাতপাত এবং সামন্ত সম্পর্ক সহ পুরানা সম্পর্কগুলোকেই সমাজের নানান স্তরে আরও পোক্ত করেছে। এমনকি পুরানা সম্পর্ককে একটা আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও রাষ্ট্রীয় চরিত্র দান করেছে, মোদীর ‘হিন্দুত্ববাদ’ সেই চরিত্রেরই রাজনৈতিক ও মতাদর্শিক অভিপ্রকাশ। বিপরীতে কোন ‘চিনাবাদ’ নাই। অথচ চিন অতি প্রাচীন এবং বিশাল সভ্যতা, চিন ইউরোপীয় আদলে ‘জাতিরাষ্ট্র’ নয়। চিন নিজেকে ইউরোপীয় মডেলের জাতি রাষ্ট্র হিশাবে গড়ে তোলে নি। ইউরোপীয় জাতি রাষ্ট্রের আদলে তাই চিনকে চেনা কঠিন।

চার: চিনের উত্থানের অর্থ হচ্ছে এংলো-ইউরোপীয় জাতি রাষ্ট্র এবং আধুনিক জাতিরাষ্ট্রবাদী ধ্যানধারণার পতন। যে পাশ্চাত্য সভ্যতার পাটাতনে তারা গড়ে উঠেছিল তার সর্বগ্রাসী আধিপত্যেরও ক্ষয়। জাতি-রাষ্ট্র, ক্ষমতা এবং প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সংক্রান্ত ঔপনিবেশিক ধ্যান ধারণারও ক্ষয়। অর্থাৎ এতোকাল জাতি, রাষ্ট্র, ক্ষমতা, প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে যেসকল ধ্যান ধারনাকে সার্বজনীন মনে করা হোত, এখন পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে সেইসব একান্তই ঔপনিবেশিক। ইউরোপীয়। এমনকি বোঝা যাচ্ছে পাশ্চাত্য ‘গণতন্ত্র’ বলতে যা বোঝে, চিন তা বোঝে না। পাশ্চাত্য তাই চিনকে বুঝতেও পারে না। চিন প্রমাণ করে দিচ্ছে ইউরোপের বাইরেও জগত আছে, সভ্যতা আছে। ইউরোপই সভ্যতার একমাত্র দাবিদার হতে পারে না।

পাঁচ: চিন নেহেরুর সমাজতন্ত্র কিম্বা গান্ধীর চরকা কাটা গ্রামোন্নয়নের অবাস্তব চিন্তায় নিজেদের পিছিয়ে রাখে নি। পাতিবুর্জোয়া নৈতিক অপরাধ বোধে তাড়িত হয়ে পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্ক শোষণমূলক বলে পুঁজিতান্ত্রিক বিকাশ রুদ্ধ করে নি, বরং ত্বরান্বিত করেছে। বিপরীতে ভারত প্রাচীন জাতপাত, বর্ণাশ্রম ও সামন্তীয় সম্পর্কগুলো দীর্ঘস্থায়ী ও পোক্ত করেছে। চিন পুরানা সম্পর্কগুলো উপড়ে ফেলেছে। চিন মার্কসের কাছ থেকে শিক্ষা নিয়ে বুঝেছে পুঁজি একটি ‘বিশ্ব-ঐতিহাসিক ঘটনা’।

চিনের মতো হিন্দুস্তানও একটি সভ্যতা। কিন্তু চিন ভারতের মতো মনে করে না পুঁজির আগের আর্থ-সামাজিক অবস্থা –  অরিয়েন্টালিস্টদের রচনার গুণে যতোই তপোবন ঋষি ও বুদ্ধের গল্পে ভরপুর থাকুক —  ফিরে যাওয়া যাবে না। কিন্তু সভ্যতার স্মৃতি ও ইতিহাস ভুলে যাওয়া যাবে না। আর সেটা ঔপনিবেশিক শক্তি বা ওরিয়েন্টালিস্টদের বানানো কেচ্ছা হবে না। চিনাদের নিজেদের লেখা ইতিহাস হবে। তার জন্য কাজ হচ্ছে বৈষয়িক অবস্থার বদল ঘটানো; লেনিনের ভাষায় সমাজতন্ত্রের বৈষয়িক শর্ত তৈরির জন্য ‘পুঁজিতান্ত্রিক সম্পর্কের দ্রুত ও ত্বরান্বিত বিকাশ’। হতদরিদ্র, গরিব ও অর্থনৈতিক দিক থেকে পিছিয়ে পড়া কোটি কোটি জনগণকে অর্থনৈতিক দুর্দশার গহ্বর থেকে টেনে তোলার কাজ সবার আগে। চিন বকোয়াজগিরি না করে সেই কাজটাই করেছে। সেটা করতে গিয়ে বৈষয়িক উন্নতির আর্থ- সামাজিক উপায় ও নীতির ক্ষেত্রে বহু নতুন চিন্তা ও পদ্ধতি আবিষ্কার করেছে। পাশাপাশি বিস্তর সমস্যাও তৈরি করেছে কিম্বা তৈরি হয়েছে যা আগে বোঝা যায় নি। তাই বাংলাদেশে আমাদের কাজ হচ্ছে চিন থেকে শেখা। নেহেরুর পাতি-বুর্জোয়া সমাজতন্ত্র, পুঁজি ও আধুনিক নগরায়নের বিপরীতে গান্ধীর গ্রামোন্নয়নের খোয়াব , কিম্বা মনোমোহন সিং-এর এংলো-স্যাক্সন নিউ-লিবারাল পলিসি ইত্যাদি আমাদের কিছুই দেবে না। সেসব নিয়ে বুদ্ধিবৃত্তিক তর্ক বিতর্ক  শিক্ষণীয় হতে পারে। কিন্তু চিনকে বুঝতে হলে বাস্তবের চিনকেই বুঝতে হবে।

তাই বাচ্চা ছেলে তালিয়া বাজাও টাইপ হাফপ্যান্ট পরা বুদ্ধি নিয়ে যদি আমরা বলি, ভারতের চেয়ে চিন ভালো, ভারতের সঙ্গে আমাদের কোন কিছু মীমাংসার দরকার নাই, এখন ধরো তক্তা মার পেরেক ভাব নিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে যেতে হবে —এই প্রকার ভারত বিরোধিতা হবে চরম উজবুকি। চিন শুধু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক শক্তি হিশাবে উঠে আসছে না, একই সঙ্গে একটি প্রাচীন সভ্যতাও পাশ্চাত্যের বিপরীতে  বিপুল বেগে উঠে আসছে। চিনের উত্থানের পরিপ্রেক্ষতে আমাদের মনে রাখা দরকার দক্ষিণ এশিয়াও একটি স্বতন্ত্র সভ্যতা। তারও বৈশিষ্ট্যসূচক দিক রয়েছে, যা আমরা এড়িয়ে যেতে বা লাফ দিয়ে পার হয়ে যেতে পারি না। সেই কারণে চিনের উত্থানের বিপরীতে আমাদের বরং ভারত অর্থাৎ ‘হিন্দুস্তান’ নিয়ে ভাবনাচিন্তা অধিক জোরদার করা দরকার। দক্ষিণ এশিয়া বা ‘হিন্দুস্তান’ কোথায় তার বৈচিত্র্য ও ভিন্নতাসহ এক ও অনন্য সেই ঐক্যের ক্ষেত্রগুলো আমাদের পর্যালোচনা করতে হবে। উপমহাদেশীয় ঐক্যের ক্ষেত্র পরিচ্ছন্ন হলে চিন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া, জাপান, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া সহ বিশাল ‘এশিয়া’র মধ্যে আমরা আমাদের অবস্থান বুঝতে পারব।

আমরা চিন হবোনা, কারণ আমরা চিনা নই। চিন হতে পারব না, কারণ হাজার হাজার বছরের সেই অতীত ইতিহাসের আমরা কেউ না, কিন্তু সিন্ধু নদীর অববাহিকায় বেড়ে ওঠা জনগণের হাজার হাজার বছরের ইতিহাস আছে। সেই ইতিহাস আমাদের নতুন করে বুঝতে হবে। উপমহাদেশকে নতুন করে গঠন করতে হলে নতুন করে ইতিহাস পাঠের বিকল্প নাই। উপমহাদেশ পুনর্গঠনের জায়গা থেকেই আমাদের বাংলাদেশ নিয়ে ভাবতে হবে।

তাই আমাদের সমস্যা যেমন চিন বনাম ভারত  নয়, তেমনি পাশ্চাত্য বনাম চিনও নয়। বরং ইউরোপ নিয়েও আমাদের ভাবতে হতে পারে। যখন বড় পরিসরে আমরা ভাবতে শিখব, তখন অনায়াসেই দেখব চিন বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভের মধ্য দিয়ে শুধু নতুন ইউরেশীয় ভূগোলের আবির্ভাব অনিবার্য করে তুলেছে তা না, সারা দুনিয়াকেও নতুন ভৌগলিক-রাজনৈতিক বিন্যাসে বিন্যস্ত করতে চাইছে। একটি নতুন বিশ্ব ব্যবস্থায় আমরা প্রবেশ করেছি, আমাদের অজান্তেই। উপমহাদেশ আমাদের লড়াই-সংগ্রামকেও সেই আলোকেই সাজাতে হবে। বাংলাদেশকে পিছিয়ে থাকলে হবে না। বাংলাদেশের মুক্তির লড়াই বাংলাদেশের ভূগোল বা রাজনৈতিক সীমানার অন্তর্গত লড়াই না,  এ লড়াই বহু আগেই ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতার অন্তর্ভূক্ত হয়ে রয়েছে। আমাদের রাজনৈতিক লড়াই সংগ্রামের রণনীতি ও রণকৌশল নির্ণয়ের জন্য নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতা নিষ্ঠা ও আন্তরিকতার সঙ্গে পর্যালোচনার দরকার আছে।

চিন সংক্রান্ত আমাদের এই বিশ্লেষণ দেশ কাল পাত্র বিবেচনা বাদ দিয়ে চিনের পথকে বৈপ্লবিক রূপান্তরের একমাত্র ছহি পথ দাবি করে না। চিনের বাস্তব অভিজ্ঞতার হদিস নেওয়াই আমাদের প্রধান উদ্দেশ্য। তবে, আমরাও বাংলাদেশকে আমূল বদলাতে চাই। আলবৎ। কিন্তু বিপ্লবের আগাম কোন নকশা বানিয়ে ছকে ছকে তা কায়েম করা যায় না, আমাদের কর্মকাণ্ডে বাংলাদেশের ইতিহাসেরই ই ছাপ থাকবে।  চিন আমাদের সেই শিক্ষাই দিচ্ছে। এই শিক্ষা আমাদের কাজে লাগে।

বিপ্লব ইঞ্জিনিয়ারিংগিরি নয়, এর কারবার মানুষ নিয়ে। মানুষের পক্ষে কিছুই অসম্ভব নয়, সেই আশাটুকু আমরা সবার আগে জ্বালিয়ে রাখতে চাই। কোন চিরায়ত বিশুদ্ধ আদর্শ প্রতিষ্ঠাও আমাদের অভিপ্রায় নয়। কিন্তু বৈপ্লবিক রূপান্তরের বাস্তব এবং তাত্ত্বিক তর্কবিতর্কের মীমাংসা না করে আমরা যদি মনে করি, স্রোতে গা ভাসিয়ে আমরা অগ্রসর হতে পারব, তাহলে সেটা হবে চরম বোকামি। তাই বাংলাদেশের জন্য যেসব তর্ক ও তত্ত্ব প্রাসঙ্গিক সেগুলো সামনে আনাই আমাদের চিন নিয়ে আলোচনার উদ্দেশ্য।

চিনের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি গুরুতর অভিযোগ রয়েছে। তার মধ্যে রয়েছে, এক. পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার অনিবার্য ফল আর্থ-সামাজিক অসাম্য এবং পরিবেশ ও প্রকৃতির বিপর্যয়। দুই. সংখ্যালঘু উইঘুর মুসলিম সম্প্রদায় ও অন্যান্য ক্ষুদ্র জাতি সত্তার ওপর নির্যাতন। তিন. চিনা ঋণের কঠিন শৃংখল এবং চিনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে শোধ না করার পরিণতি, ইত্যাদি। পুঁজিতান্ত্রিক অর্থনীতির মন্দ ফল সবই চীনের অর্থনৈতিক বিকাশে হাজির। এই দিকগুলো অবশ্যই আমলে নিতে হবে। কিন্তু এটা সম্ভবত পরিষ্কার যে ইউরোপীয় উবনিবেশ পর্ব এবং মার্কিন নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদী পর্বের ক্ষয়ের মধ্য দিয়ে আমরা চিনা ধাঁচের সাম্রাজ্যবাদ দেখব না,  বরং বৈশ্বিক পুঁজিতান্ত্রিক ব্যবস্থার ভিন্ন রূপ দেখব।  চিনা নেতৃত্বে নতুন পুঁজিতান্ত্রিক গোলকায়ন আমাদের বিকাশের জন্য বাধা হবে কিনা সেটা নির্ভর করবে বাংলাদেশের ক্ষমতাসীন শক্তির সঙ্গে বাংলাদেশের জনগণের মোকাবিলার ধরণ এবং তার পরিণতির ওপর।

চিনের অভিজ্ঞতা আশান্বিত করে, এটা নগদ লাভ।

(চলবে)

১৫ শ্রাবণ, ১৪২৭। ৩০ জুলাই ২০২০।

গ্রন্থসূত্র

Chopra, S. (2017, May 24). Why ‘Bharat’, ‘India’ And ‘Hindustan’ Evoke Different Emotions. Retrieved from Youth Ki Awaz: https://www.youthkiawaaz.com/2017/05/india-bharat-and-hindustan-meanings-and-connotations/

Group, R. M. (1973). Three Major Struggles on China’s Philosophical Front. Peking: Foreign Language Press.