অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগের অর্থবছরের বকেয়াসহ চলতি অর্থবছরের নভেম্বর পর্যন্ত বিদ্যুতে ভর্তুকি বাবদ বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ৪৩ হাজার কোটি টাকা। এর বিপরীতে দেওয়া হয়েছে ১৫ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাজেট থেকে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডকে দেওয়া হয় ৬ হাজার কোটি টাকা। বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎ উদ্যোক্তাদের ঋণের বিপরীতে ২৪টি ব্যাংককে দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৫৬৫ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড।
চলতি অর্থবছরের অক্টোবর পর্যন্ত সারের ভর্তুকি বাবদ পাওনা দাঁড়িয়েছে প্রায় ১৮ হাজার কোটি টাকা। এর মধ্যে বাজেট থেকে কৃষি মন্ত্রণালয়কে দেওয়া হয়েছে ৫ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা এবং ব্যাংকগুলোকে দেওয়া হয়েছে ৯ হাজার ৩৯৫ কোটি টাকার বিশেষ বন্ড। বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন, বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনসহ বেসরকারি কিছু প্রতিষ্ঠানের ঋণ
বাবদ ১৩টি ব্যাংক পেয়েছে এসব বন্ড। রপ্তানির বিপরীতে নগদ প্রণোদনা বাবদ বকেয়া ২ হাজার কোটি টাকা। রেমিট্যান্সে প্রণোদনার বিপরীতে বাকেয়া দাঁড়িয়েছে আরও ২ হাজার কোটি টাকা।
জানা গেছে, সব মিলিয়ে গত নভেম্বর পর্যন্ত চার খাতে সরকারের কাছে পাওনা প্রায় ৬৭ হাজার কোটি টাকার মধ্যে গত সপ্তাহ পর্যন্ত ৩২ হাজার কোটি টাকা দেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে সরকার চলতি অর্থবছরের বাজেট থেকে দিয়েছে ১৩ হাজার ১৩৫ টাকা। বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে দেওয়া হয়েছে ১৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকা। আর বকেয়া রয়েছে প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, বিদ্যুৎ ও সারে ভর্তুকি কমিয়ে আনতে কয়েক দফা দামও বাড়ানো হয়। এ কারণে আশা করা হয়েছিল, চলতি অর্থবছরে ভর্তুকি চাহিদা কমবে। চলতি অর্থবছরের বাড়তি বরাদ্দ থেকে গত অর্থবছরের দায়ও পরিশোধ করা যাবে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটে শুধু বিদ্যুতের ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয় ৩৬ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছর এ খাতে বরাদ্দ ছিল ২৩ হাজার কোটি টাকা। চলতি অর্থবছর সারে ভর্তুকি বাবদ বরাদ্দ রাখা হয় ১৭ হাজার কোটি টাকা। গত অর্থবছর যা ছিল ১৬ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু ভর্তুকি চাহিদা কমেনি। পাশাপাশি নগদ অর্থের সংকট তৈরি হয়েছে।
ভর্তুকির দায় পরিশোধে পরবর্তী পরিকল্পনা বিষয়ে অর্থ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তার আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে নাম প্রকাশ না করার অনুরোধ জানিয়ে ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা সমকালকে বলেন, চলতি অর্থবছরের মধ্যেই বকেয়াসহ সব ভর্তুকি পরিশোধ করার লক্ষ্য ছিল সরকারের। কিন্তু পর্যাপ্ত অর্থের সংস্থান না থাকায় অর্থবছরের সাত মাস পার হয়ে গেলেও চার খাতে ভর্তুকি ও প্রণোদনা বাবদ মাত্র ১৩ হাজার ১৩৫ কোটি টাকা দেওয়া সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে অন্তত ২২ হাজার কোটি টাকার বিশেষ বন্ড ইস্যু করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর আলোকে ইতোমধ্যে ১৮ হাজার ৮৫০ কোটি টাকার বন্ড ইস্যু করা হয়েছে।
ওই কর্মকর্তা আরও বলেন, বিশেষ বন্ডের মাধ্যমে দায় পরিশোধে আগ্রহী নয় ব্যাংকগুলো। তারপরও সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থা বিবেচনায় রাজি করানো সম্ভব হয়েছে। একই সঙ্গে তিনি বলেন, পরে আর্থিক পরিস্থিতির উন্নতি হলে বাজেট থেকেই এসব বকেয়া পরিশোধ করা হবে।
বিদ্যুতের মূল্য বাবদ পাওনা পরিশোধের অনুরোধ জানিয়ে কয়েক দফা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় বেসরকারি বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্রের উদ্যোক্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ ইনডিপেনডেন্ট পাওয়ার প্রোডিউসার্স অ্যাসোসিয়েশন (বিআইপিপিএ)। গত নভেম্বর দেওয়া এক চিঠিতে সংগঠনটি উল্লেখ করে, সরকারের কাছে তাদের পাওনা প্রায় ২৩ হাজার কোটি টাকা। বর্তমানে তাদের অবস্থা জানতে চাইলে বিআইপিপিএর সভাপতি ফয়সাল খান সমকালকে বলেন, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী বিল জমা দেওয়ার এক মাসের মধ্যে বিদ্যুৎ কেন্দ্রগুলোকে পাওনা বুঝিয়ে দেওয়ার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। কিন্তু তাদের সংগঠনের কিছু প্রতিষ্ঠান গত বছরের জানুয়ারি পর্যন্ত বিল পেয়েছে। ক্ষেত্রবিশেষ বিল আটকে আছে এক বছরেরও বেশি সময়।
মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান সমকালকে বলেন, ব্যাংকগুলো রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ তাৎক্ষণিকভাবে গ্রাহকদের পরিশোধ করে। অথচ সরকারের কাছ থেকে পেতে ছয় মাস এমনকি তার বেশি সময়ও লেগে যাচ্ছে। এক বছর আগেও রেমিট্যান্সের প্রণোদনার অর্থ এক থেকে দুই মাসের মধ্যেই পাওয়া যেত। সরকার দ্রুততম সময়ের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের ভর্তুকি ও প্রণোদনার বকেয়া অর্থ পরিশোধ করলে ব্যাংকে তারল্য পরিস্থিতির উন্নতি হতো বলে তিনি মনে করেন।
রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা বাবদ ৪ হাজার কোটি টাকা ছাড়ের অনুরোধ জানিয়ে গত নভেম্বরে অর্থ মন্ত্রণালয়ে চিঠি দেয় নিটওয়্যার শিল্পের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বিকেএমইএ। সংগঠনটি জানায়, ৪ হাজার কোটি টাকারও বেশি নগদ সহায়তা বাবদ অর্থ যথাসময়ে না পাওয়ায় এ খাতকে চরম আর্থিক সংকটে ফেলে দিয়েছে। বিকেএমইএর নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম সমকালকে বলেন, চিঠি দেওয়ার পর দুই দফায় ২ হাজার কোটি টাকা ছাড় করা হয়েছে। তবে এখনও ২ হাজার কোটি টাকার বেশি বকেয়া রয়ে গেছে। প্রণোদনার টাকা হিসাবনিকাশ করেই সুতা কেনা থেকে রপ্তানি মূল্য সবকিছুই নির্ধারণ করা হয়। বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে রপ্তানি খাত বেশ কিছুদিন থেকে ভুগছে। এ অবস্থায় যথাসময়ে প্রণোদনা না পাওয়ায় বস্ত্র ও পোশাক খাত সংকটে আছে।
জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব আহরণের লক্ষ্যমাত্রা থেকে তারা পিছিয়ে রয়েছে ২৩ হাজার কোটি টাকার বেশি। গবেষণা সংস্থা পিআরআইর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর সমকালকে বলেন, এ অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে রাজস্ব বাড়ানো এবং ভর্তুকির পরিমাণ কমিয়ে আনা। ঢালাওভাবে ভর্তুকি দিলে সামষ্টিক অর্থনীতিতেও এর নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।