- নয়া দিগন্ত অনলাইন
- ৩০ জুন ২০২৩, ১৯:৩৭
চলতি বছর দেশে কোরবানির চামড়ার দাম নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেলেও দাম গতবছরের তুলনায় খুব একটা বেড়েছে বলে খবর পাওয়া যায়নি। যার কারণে মাদরাসা ও এতিমখানার মতো প্রতিষ্ঠান যাদের আয়ের একটি অন্যতম উৎস কোরবানির পশুর চামড়া, তারা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলে জানা যাচ্ছে।
এতিমখানা সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এবার তারা গতবারের তুলনায় কিছুটা কম চামড়া সংগ্রহ করেছেন। আর দামও ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭৫০ টাকার মধ্যেই উঠানামা করেছে। যার কারণে খুব একটা আয়ের মুখ তারা দেখতে পারেননি।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের জনসংযোগ কর্মকর্তা ইফতেখার হোসেন এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানিয়েছেন, এ বছর সারা দেশে ঈদুল আজহা উপলক্ষে ১ কোটি ৪১ হাজার ৮১২টি পশু কোরবানি হয়েছে। এরমধ্যে ৪৫ লাখ ৮১ হাজার ৬০টি গরু। বাকি পশুদের মধ্যে মহিষ, ছাগল ও ভেড়া উল্লেখযোগ্য।
গত বছরের তুলনায় এবার ৯১ হাজারের বেশি পশু কোরবানি করা হয়েছে। সবচেয়ে বেশি পশু কোরবানি হয়েছে ঢাকা বিভাগে।
প্রতিটি গরুর চামড়া গড়ে ৬০০ টাকা করে হিসাব করলেও দেশে এবার শুধু গরুর চামড়ার বাজারের আকার ২৭৪ কোটি ৮৬ লাখ টাকার বেশি।
সরকার এবছর লবণযুক্ত চামড়ার দাম ঢাকায় প্রতি বর্গফুট ৫০-৫৫ টাকা নির্ধারণ করে দিলেও বাস্তবে বিক্রি করতে গিয়ে এর চেয়ে কম দাম পেয়েছেন বলে অভিযোগ করেছেন অনেকে।
রাজধানী ঢাকার তেজতুরী বাজার এলাকায় অবস্থিত রহমতে আল ইসলাম মিশন এতিমখানার সুপারিনটেনডেন্ট মোহাম্মদ নজরুল ইসলাম বলেন, তাদের প্রতিষ্ঠানে ১৩০০’র মতো ছেলে-মেয়ে আবাসিকভাবে পড়াশোনা করে। এদের কারো কাছ থেকেই বেতন বা থাকা-খাওয়ার খরচ নেন না তারা।
এই শিক্ষার্থীদের মধ্যে প্রায় আট শতাধিক শিক্ষার্থী এতিম।
পুরো প্রতিষ্ঠানটির অর্থের বড় যোগান আসে সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সার্বিক সহযোগিতা এবং সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ক্যাপিটেশন গ্র্যান্ট থেকে। খরচের কিছু অংশ আসে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির অর্থ থেকে, যদিও এর পরিমাণ বর্তমানে খুবই কম।
নজরুল ইসলাম বলেন, এবছর ৯৫৮টি চামড়া শহরের বিভিন্ন এলাকা থেকে সংগ্রহ করেছেন তারা। এসব চামড়া প্রতিটি ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে ৭৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করছেন তারা।
‘এবছর আমরা হয়তো সাত-সাড়ে সাত লাখ টাকা পাবো আরকি। এবছর তেমন একটা আয় হয়নি,’ বলেন তিনি। এই আয় এই প্রতিষ্ঠানটির মোট বার্ষিক খরচের তুলনায় খুবই নগণ্য বলে জানান তিনি।
গত বছর অর্থাৎ ২০২২ সালের কোরবানির ঈদে তাদের সংগ্রহে ছিল ১০১২টি চামড়া। তবে সেবছরও দাম অনেকটা একই রকম গেছে বলে জানিয়েছেন তিনি।
কত বছর আগে চামড়ার দাম ভালো পেয়েছেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, চার-পাঁচ বছর আগে তারা চামড়ার বেশ ভালো দাম পেয়েছেন। সেসময় প্রতিটা চামড়া তারা ২০০০ টাকা থেকে শুরু করে ২৩০০-২৪০০ করে বিক্রি করেছেন।
‘ওই সময় যা হইতো (টাকা) এখন তো তার অর্ধেকও পাওয়া যায় না,’ বলেন তিনি।
তিনি আরো বলেন, ‘এসময় (কোরবানির সময়) আমরা ১৮ লাখ, ১৬ লাখ, এই রকম; বেশিও পাইতাম আরো। এখন তো কয়েকটা বছর ধইরা এতো দাম কম, একেবারেই কম। দাম তো বেশি যাইতেছে না।’
রাজধানীর আজিমপুরে অবস্থিত স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম এতিমখানা। এই প্রতিষ্ঠানটির ভারপ্রাপ্ত তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ মাহমাদুল এহসান বলেন, বর্তমানে তাদের অধীনে ১৪০ জনের মতো ছেলে-মেয়ে রয়েছে।
এবছর তারা একেবারেই চামড়া সংগ্রহ করতে পারেননি। যেখান থেকে খবর পেয়েছেন সেখান গিয়ে নিয়ে এসেছেন চামড়া। তবে সেটাও হাতেগোনা কিছু। তাদের সংগ্রহ করা চামড়ার পুরোটাই গরুর চামড়া।
মাহমাদুল এহসান জানান, যে চামড়া তারা সংগ্রহ করেছিলেন সেগুলো বিক্রিও করেছেন খুব কম দামে।
‘খুব বেশি দামে বিক্রি করতে পেরেছি এমন না। ৪০০, ৪৫০- এমন দামে চামড়া বিক্রি হয়েছে (প্রতিটি গরুর চামড়া)।’
তিনি জানান, বর্তমানে চামড়া সংগ্রহ কমে যাওয়ার নানা রকম কারণ রয়েছে। এছাড়া মাদরাসা ও এতিমখানা শহরের বিভিন্ন এলাকায় গড়ে ওঠার কারণে একই এলাকায় কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে চামড়া ভাগ হয়ে যাচ্ছে। ফলে কমে যাচ্ছে পরিমাণ।
আর এর সাথে পাল্লা দিয়ে কমেছে চামড়ার দামও।
তিনি আরো বলেন, চার-পাঁচ বছর আগেও তারা বেশ চড়া দামে চামড়া বিক্রি করেছেন। চামড়া থেকে লাখ টাকা আয় হলেও সেটি কমে এখন হাজারে নেমে এসেছে।
‘চামড়া থেকে আমাদের তেমন টাকা আসতেছে না। খুব সামান্য আসতেছে,’ বলেন তিনি।
এতিমখানা পরিচালনায় যে ঘাটতি দেখা দিয়েছে সেটি পূরণ করতে এই মাদরাসার কিছু নিজস্ব সম্পত্তি ও দোকানপাট ভাড়া দেয়া হয়েছে, যেটি থেকে কিছুটা আয় আসে। এছাড়া দান থেকে এতিমখানা পরিচালনার কিছু অর্থ আসে, যার উপর নির্ভর করতে হয় বলে জানিয়েছেন তিনি।
মুহাম্মদিয়া জামিয়া শরিফ মাদরাসা ইয়াতিমখানা ও লিল্লাহ বোর্ডিং- প্রতিষ্ঠানটি রাজারবাগ দরবার শরীফের অধীনে পরিচালিত হয়।
এই দরবার শরীফের মুখপাত্র মোহাম্মদ মাহবুব আলম বলেন, কোরবানির চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণে মাদরাসা ও এতিমখানার বরাদ্দ কমে যায় অনেক ক্ষেত্রে।
উদাহরণ হিসেবে তিনি বলেন, কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকাটা ব্যবহার করা হয় মূলত এতিমখানার শিশু ও দুস্থ শিক্ষার্থীদের বিনাবেতনে পড়াশোনার খরচ চালানোর জন্য।
কোরবানির চামড়া বিক্রির টাকা বেশি হলে এসব খাতে বরাদ্দ বাড়ে। ফলে বেশি পরিমাণে দুস্থ ও এতিম শিক্ষার্থী ভর্তি হওয়ার সুযোগ পায়। আর এই আয় কমে গেলে এই খাতে বরাদ্দ কমে যায়।
তিনি আরো বলেন, গ্রামাঞ্চলে যে ছোট ছোট মাদরাসা ও হেফজখানা থাকে, সেসব প্রতিষ্ঠানেরও আয়ের একটি বড় অংশ আসে কোরবানির পশুর চামড়া বিক্রির টাকা থেকে। কিন্তু চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণে এধরনের প্রতিষ্ঠানের আয় কমে গিয়ে সেগুলোর অনেকগুলো বন্ধ হয়ে গেছে বলেও তারা জানতে পেরেছেন।
এদিকে কোরবানির পশুর চামড়ার দাম কমে যাওয়ার কারণ হিসেবে খাত সংশ্লিষ্টরা চাহিদার তুলনায় বিপুল পরিমাণ চামড়া উৎপাদন হওয়াকে দায়ী করছেন। একই সাথে চামড়ার দাম পড়ে যাওয়ার পেছনে রফতানি কমে যাওয়া বড় কারণ বলে মনে করছেন অনেকে।
বাংলাদেশ হাইড অ্যান্ড স্কিন মার্চেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক টিপু সুলতান গত বুধবার বিবিসি বাংলাকে বলেছিলেন, রফতানি কমে যাওয়া প্রভাব পড়েছে স্থানীয় বাজারে। যার কারণে কমে গেছে দাম।
চামড়াজাত পণ্যের সবচেয়ে বড় বাজার ইউরোপ হলেও সেখানে রফতানির জন্য ইন্টারন্যাশনাল স্ট্যান্ডার্ড অর্গানাইজেশনের সনদ এবং লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের পরিবেশ স্বীকৃতি সনদের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাংলাদেশের ট্যানারি শিল্পের সামগ্রিক উৎপাদন প্রক্রিয়াটি পরিবেশগত সমস্যা থেকে মুক্ত হতে না পারায় এর কোনোটিই নেই বাংলাদেশের। এ কারণে ওই সব দেশে বাংলাদেশের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য ঢুকতে পারছে না।
রফতানি কমার পেছনে সরকারকে দোষারোপ করে বাংলাদেশ ট্যানার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান শাহিন আহমেদ বলেন, ২০১৬ সালে সরকার অপরিকল্পিতভাবে ট্যানারিগুলো সাভারে স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত নেয়। সেখানে পরিবেশবান্ধব পরিবেশে চামড়া প্রক্রিয়াজাত করার ব্যবস্থা থাকবে বলে আশ্বাস দিলেও সেটা শেষমেশ হয়নি। এছাড়া খুব বেশি ট্যানারি সেখানে গিয়ে স্থায়ী হতে পারেনি।
সরকার অবশ্য এর আগে বলেছিল যে চামড়ার দাম কমে যাওয়ার বিষয়টি মাথায় রেখে গত বছরের তুলনায় এবার দাম কিছুটা বাড়িয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি