- আবুল কালাম মানিক
- ২৯ নভেম্বর ২০২২, ১৯:৫৯
রাজনৈতিক বৈধতার সঙ্কটে জর্জরিত এবং অর্থনৈতিক বিপর্যয়ে মজ্জমান ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার বর্তমানে ঘরে বাইরে প্রচণ্ড চাপের মুখে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় চাপ দিচ্ছে একটি গ্রহণযোগ্য জাতীয় নির্বাচনের জন্য। বিরোধী দলগুলোও চাপ দিচ্ছে অবিলম্বে তত্ত¡াবধায়ক সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের পথ সুগম করার জন্য। সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি আদায়ে আন্দোলনের অংশ হিসেবে প্রধান বিরোধী দল বিএনপি দেশব্যাপী প্রতিবাদ সমাবেশ করছে। বাধা-বিপত্তি উপেক্ষা করে এসব সমাবেশে জনতার ঢল নামছে। সরকারের জনপ্রিয়তা তলানিতে।
আজ থেকে মাত্র চার মাস আগে ভারতের ইংরেজি দৈনিক হিন্দুস্তান টাইমস এক পূর্বাভাসে আশঙ্কা প্রকাশ করেছিল যে, ঘনায়মান চরম অর্থনৈতিক সঙ্কটে শেখ হাসিনার কর্তৃত্ববাদী শাসনের স্থিতিশীলতার প্রলেপ সহসাই খসে পড়বে। সরকারের পায়ের তলা থেকে মাটি সরে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে শেখ হাসিনার ক্ষমতার তাসের ঘরের মতো ধসে পড়ার ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিপর্যয়ের মুখোমুখি হওয়া সত্তে¡ও সরকারের শীর্ষ ব্যক্তিদের সুমতির কোনো লক্ষণ নেই। বিরোধী দলের সাথে সংলাপ-সমঝোতার মাধ্যমে পরিস্থিতি সামাল দেয়ার নীতিতে বিশ্বাসী নয় আওয়ামী লীগ। অন্য দিকে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোরও বিন্দুমাত্র আস্থা নেই সরকারের ওপর। সরকার অতীতের মতোই সংবিধানের দোহাই দিয়ে একতরফা ও প্রহসনের নির্বাচনের পথে হাঁটছে এবং ষড়যন্ত্র ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে পরিস্থিতি মোকাবেলার কৌশল আঁটছে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের অভিমত, দশকব্যাপী সরকারের সাফল্য গাথা ‘সর্বোচ্চ রেকর্ড রিজার্ভ ও সর্বোচ্চ রেকর্ড মাথাপিছু আয়’-এর ফাঁকা বুলি অসার প্রমাণিত হয়েছে। বাস্তবতা অস্বীকার করে নিছক করোনা মহামারী, ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ ও বৈশ্বিক মন্দার ওপর দোষ চাপিয়ে বিরাজমান অর্থনৈতিক সঙ্কটের দায়মুক্তি অন্বেষণ করছে হাসিনা সরকার। এই অপপ্রয়াস জনগণের সামনে সরকারের চরিত্র ভালোভাবেই উন্মোচিত করেছে। জনগণ পরিষ্কার বুঝতে পারছে, অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের জন্য এসব ঘটনা এককভাবে দায়ী নয়। সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাট ও অর্থপাচারই এর মূল কারণ। ভুক্তভোগী মানুষ সামনের নির্বাচনে আবারো প্রতারিত হতে চায় না। কারণ তারা এখন অস্তিত্বসঙ্কটে ভুগছে। তাদের অভাবনীয় দুঃখকষ্টের জন্য বিনা ভোটের সরকারই দায়ী। বাংলাদেশের মানুষ হৃত ভোটাধিকার ফিরে পাওয়ার আশায় রয়েছে। তারা মোটেও বিশ্বাস করে না যে, শেখ হাসিনা সরকারের অধীন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন হবে। তাই তারা রাজনীতিতে তাদের সক্রিয়তার প্রমাণ দিতে চায়। সরকারের অপকৌশল ব্যর্থ করে দিতে বেশ আগেই প্রস্তুতি নিচ্ছে জনগণ। বিরাজমান পরিস্থিতি গণমানুষের ম্রিয়মাণ রাজনৈতিক চেতনাকে শাণিত করছে। তার লক্ষণও ইদানীং ক্রমেই পরিস্ফুটিত হচ্ছে। সরকারের সব বাধা-বিপত্তি ও হুমকি উপেক্ষা করে বিএনপি বিভাগীয় প্রতিবাদ সমাবেশগুলোতে জনতার ঢল নামছে। লাখো মানুষের উপস্থিতিতে ধারাবাহিক সফল গণসমাবেশ বিরোধী দলগুলোর নেতাকর্মীদের অতীতের যেকোনো সময়ের থেকে বেশ উদ্দীপ্ত করেছে।
ওয়ান-ইলেভেনের কুশীলবদের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় ২০০৮ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ অস্বাভাবিক নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হওয়ার পর দেশে সত্যিকারের বিরোধী দলের অপমৃত্যু ঘটেছে। সংসদ অকার্যকর হয়ে পড়েছে। তার পর থেকে একটানা ১৪ বছর রাজনীতিতে আধিপত্য বিস্তার করে দেশ শাসন করে চলেছে শেখ হাসিনা সরকার। প্রধান বিরোধী দল বিএনপির মেরুদণ্ড ভেঙে দিতে নির্বিচার হত্যা, জেল-জুলুম, হামলা ও মামলার আশ্রয় নেয়া হয়েছে। ২০১৪ সালের নির্বাচনের পর এক দলীয় শাসনের কর্তৃত্ব দানবীয় আকার ধারণ করে। গণতন্ত্রের পরিসর মারাত্মকভাবে সঙ্কুচিত হয়ে পড়ে। বলপ্রয়োগের মাধ্যমে সভা-সমাবেশ বন্ধ করে দেয়া হয়। ভিন্নমত প্রকাশের স্বাধীনতা বাধাগ্রস্ত হয়। বিচারবহিভর্‚ত হত্যাকাণ্ড, গুম, মানবাধিকার লঙ্ঘন ও গায়েবি হামলা-গায়েবি মামলা ভয়াবহভাবে বাড়তে থাকে। সরকারের নজরদারির আওতায় চলে যায় নাগরিকের রাজনৈতিক ও সামাজিক কর্মকাণ্ড। ভয়ের সাংস্কৃতিক আবর্তে নিপতিত হয় বাংলাদেশ। দেশের মানুষ দিশেহারা হয়ে পড়ে। তারা মুক্তির অন্বেষায় প্রহর গুনতে থাকে।
বাংলাদেশের মানুষের স্বভাবগত উচ্চ রাজনৈতিক সচেতনতা আওয়ামী লীগ সরকারের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক রাষ্ট্রদূত মার্শা বার্নিকাট বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশের মতো এমন রাজনীতিতে আচ্ছন্ন দেশ আমি আর দেখিনি’। মার্কিন গবেষণা প্রতিষ্ঠান পিউ রিসার্চ সেন্টার ২০১৩ সালে রাজনৈতিক সচেতনতার ওপর এক জরিপ পরিচালনা করে। জরিপে ৩৩টি উন্নয়নশীল দেশের মধ্যে বাংলাদেশের জনগণকে সবচেয়ে বেশি রাজনৈতিক সচেতন বলে শনাক্ত করা হয়। জরিপে প্রাপ্ত তথ্য মতে, বাংলাদেশের ৬৫ ভাগ মানুষ উচ্চমাত্রায় এবং ২৯ ভাগ মানুষ মধ্যম মাত্রায় রাজনীতি সক্রিয়। এতে বোঝা যাচ্ছে যে, বাংলাদেশের শতকরা ৯০ ভাগ মানুষই রাজনীতি সক্রিয়।
বিশ্লেষকদের অনেকেই মনে করেন, এমন উচ্চমাত্রার রাজনৈতিক স্পর্শকাতর দেশে ২০১৪ ও ২০১৮ সালের প্রহসনের সংসদ নির্বাচন মানুষকে মারাত্মকভাবে ক্ষুব্ধ করেছে। প্রকাশ্য দিবালোকে ও রাতের আঁধারে ভোটের অধিকার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার চিত্র তারা অসহায়ভাবে অবলোকন করেছে। স্রেফ জীবন-জীবিকার ঝুঁকির কারণে তারা নীরব দর্শকের খাতায় নাম লেখাতে বাধ্য হয়েছে। তাদের ভোটের অধিকার ছিনতাই হয়ে গেছে। যে ভোট একসময় ছিল আনন্দ-উৎসব এখন তা পর্যবসিত হয়েছে সরকারের অপকৌশলে। বিষয়টি অতীব বেদনা ও হতাশার। এখন ভোট ছাড়াই নির্বাচনে জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। দেশের ভালো-মন্দে তাদের কিছু বলার নেই। কিছু করার তো প্রশ্নই ওঠে না। তারা যেন সবাই প্রবাসী। ভোটকেন্দ্রিক রাজনৈতিক সক্রিয় মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে, আওয়ামী লীগের উন্নয়নের রাজনীতি তাদের ভোটাধিকার হরণ করেই ক্ষান্ত হয়নি বরং দুর্ভিক্ষের মুখোমুখি করেছে। খেয়েপরে বেঁচে থাকাই এখন দায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। আওয়ামী লীগের গণতন্ত্রমুক্ত উন্নয়ন একটি বড় ধরনের ফাঁকি ছাড়া আর কিছুই না।
আওয়ামী লীগ দীর্ঘ দেড় যুগ অবৈধ ক্ষমতা টিকিয়ে রেখেছে গোষ্ঠীতন্ত্র কায়েমের মাধ্যমে। এ গোষ্ঠীশাসনের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে রাজনীতিবিদ-আমলা-ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট। এরা দেশের সম্পদ লুটপাট ও পাচার করছে দেদার। পাশাপাশি উন্নয়নের ফাঁকা বুলি আওড়িয়ে সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্ত ও বলপ্রয়োগের মাধ্যমে প্রতিবাদকারী ও ভিন্নমত দমনের কৌশলও প্রয়োগ করেছে সফলভাবে।
বিরাজমান পরিস্থিতিতে সামনের দিনগুলোকে সরকারের অপকৌশল কাজে লাগবে কি না, যথেষ্ট সন্দেহ দেখা দিয়েছে। আসন্ন দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে অনিশ্চয়তা এবং ২০২৩ সালজুড়ে রাজনৈতিক সঙ্ঘাতের আগাম আলামত লুটেরা গোষ্ঠীশাসকদের মধ্যে চরম অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। লুটপাটের টাকা-পয়সার নিরাপত্তা নিয়ে তাদের দুঃস্বপ্নের শেষ নেই। তাদের সব অবৈধ সম্পদ বিদেশের নিরাপদ ঠিকানায় পাচার করে দিচ্ছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে মারাত্মক রিজার্ভ সঙ্কট ও ডলারের আকাল। চরম অর্থনৈতিক চাপে ও ক্রমবর্ধমান গণ-অসন্তোষে সরকারের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে সমন্বয়হীনতা। মন্ত্রীরা একই ইস্যুতে অসংলগ্ন ও পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দিচ্ছেন। রিজার্ভের টাকা খরচ নিয়ে সরকারের শীর্ষ পর্যায় থেকে খোঁড়া যুক্তি প্রদর্শন করা হচ্ছে। ব্যাংক ব্যবস্থার ওপর আস্থার সঙ্কট সৃষ্টি হওয়ার প্রেক্ষাপটে দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংককে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করতে হচ্ছে। অভাবী মানুষ এখন ভাবতে শুরু করেছে যে, গোষ্ঠীশাসকরা সব খেয়ে ফেলেছে। লুটের টাকা বিদেশে পাচার করে দিয়েছে। বর্তমানে প্রশাসন, জাতীয় সংসদ, বিচারব্যবস্থা, নির্বাচন কমিশন ও পুলিশ সব কিছুই গোষ্ঠীতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দলীয় সরকারের অধীন নির্বাচনের মাধ্যমে লুটেরা গোষ্ঠী শাসকদের কবল থেকে মুক্তি পাওয়ার কোনো উপায় নেই।
বাংলাদেশে দলীয় সরকারের অধীন কোনো জাতীয় নির্বাচনই অবাধ ও সুষ্ঠু হওয়ার নজির নেই। ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কোনোটাই সুষ্ঠু কিংবা গ্রহণযোগ্য হয়নি। দেশের আপামর জনসাধারণ ভোটের দিন অবাধ কারচুপি, অনিয়ম ও সহিংসতা প্রত্যক্ষ করেছে। অনিয়মদুষ্ট নির্বাচনগুলো গ্রহণযোগ্য দাবি করার নৈতিক সাহস আওয়ামী লীগের নেই। দলটির অনুগত অথবা সমর্থক বুদ্ধিজীবীদের কণ্ঠও এ ব্যাপারে সোচ্চার নয়। দেশের নাগরিক সমাজ, গণমাধ্যম ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় নির্বাচন দু’টিকে গ্রহণযোগ্য বলে স্বীকৃতি দেয়নি। সংশ্লিষ্ট সবাইকে হকচকিত করে দিয়ে সম্প্রতি ঢাকায় জাপানের রাষ্ট্রদূত ইতো নাওকি এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, ‘স্বাভাবিকভাবেই আমরা আগামী দিনে তুলনামূলক ভালো নির্বাচন চাই। আশা করি নির্বাচন অবাধ ও সুষ্ঠু হবে। আমি ব্যালট বাক্স ভর্তি করার দৃষ্টান্তের কথা শুনেছি। আগের রাতে (২০১৮ সালের নির্বাচনে) পুলিশের কর্মকর্তারা ব্যালট বাক্স ভর্তি করেছেন। আমি এ দৃষ্টান্তের কথা অন্য দেশে শুনিনি।’ জাপানি রাষ্ট্রদূতের এ মন্তব্যে রাজনৈতিক মহলে তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিনা ভোটে আওয়ামী লীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ ১৫৪ আসনে জয় লাভ করে। ওই নির্বাচনে বিএনপির বর্জন ও সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষার অজুহাত কাজ করলেও পরবর্তী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যুক্তিতর্কের সব সীমা ছাড়িয়ে প্রহসনে পরিণত হয়। নির্বাচনে বিএনপির অংশগ্রহণ কোনো কাজে আসেনি। কারণ দিনের ভোট রাতে অনুষ্ঠানের মাধ্যমে পুরো জাতিকে হতবাক করে দেয় সরকার ও নির্বাচন কমিশন। দু’টি নির্বাচনে ‘সত্যিকারের বিরোধী দল’ নিশ্চিহ্ন করে দেয়ায় সরকারের গ্রহণযোগ্যতা দেশ-বিদেশে মারাত্মক প্রশ্নের সম্মুখীন হয়েছে।
সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত খুব ঘনঘন বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বিশেষ করে বিরাজমান রাজনৈতিক সহিংসতা ও আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে বেশ শক্ত মন্তব্য করেছেন, যা ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। গত ২৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার একটি অনুষ্ঠানে মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র আশা করে, বাংলাদেশের সমৃদ্ধির লক্ষ্যে আগামী জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠু ও অবাধ হবে। যুক্তরাষ্ট্র কোনো নির্দিষ্ট দলকে সমর্থন করে না। দেশের অগ্রগতির জন্য রাজনৈতিক সঙ্ঘাতমুক্ত নির্বাচন গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক সহিংসতা সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানে বড় বাধা। ইদানীং রাজপথে সহিংসতা দেখা যাচ্ছে। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্র্বাচন অনুষ্ঠানে সরকার, রাজনৈতিক দল, সুশীলসমাজসহ সব পক্ষের দায়িত্ব রয়েছে।’ তার ঠিক পরের দিন আরেকটি অনুষ্ঠানে হাস বলেন, ‘রাজনৈতিক সহিংসতার পরিবেশে কোনোভাবেই অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। বিক্ষোভকারী, রাজনৈতিক দল, সরকার ও আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা প্রত্যেকের জন্য আইনের শাসনকে সম্মান করা এবং সহিংসতা, হয়রানি ও ভয় দেখানো থেকে বিরত থাকা গুরুত্বপূর্ণ। যুক্তরাষ্ট্র সুনির্দিষ্টভাবে বিশেষ কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নেয় না। আমরা আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী একটা অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন চাই।’ তা ছাড়া ২৭ সেপ্টেম্বর পিটার হাস ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস ফোরাম অব বাংলাদেশের বার্ষিক সাধারণ সভায় বলেছেন, শুধু অর্থনৈতিক অঞ্চল আর পানি বিদ্যুতের ব্যবস্থা করলেই কাক্সিক্ষত বিদেশী বিনিয়োগ আসবে না। এর জন্য উন্নত পরিবহন ব্যবস্থা, সুশাসন, গণতন্ত্র, রাজনৈতিক ও নির্বাচনী স্থিতিশীলতা থাকতে হবে।’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মন্তব্যগুলোতে এক ধরনের প্রচ্ছন্ন সতর্কীকরণের লক্ষণ আছে।
অতিমাত্রায় প্রশ্নবিদ্ধ ও প্রহসনের দু’টি নির্বাচন করে এবং বিরোধী দলগুলোকে বলপ্রয়োগের মাধ্যমে অকেজো করে দিয়ে আওয়ামী লীগ ভালোভাবেই ক্ষমতা টিকিয়ে রাখলেও হোঁচট খাওয়ার পালা শুরু হয়েছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় নিলে প্রতীয়মান হয় যে, দলটির স্বেচ্ছাচারিতা ও টানা দেড় দশকের দমন-পীড়ন এখন বাধার মুখে পড়ছে। পুলিশ ও দলীয় সমর্থকরা আগের মতো মারমুখী অবস্থান নিতে সাহস পাচ্ছে না। ক্ষমতাসীন দলটি ঘরে-বাইরে চাপের মুখে পড়েছে। দেশের সামষ্টিক অর্থনীতিতে বিপর্যয় দেখা দিয়েছে। প্রবাসী আয়, আমদানি-রফতানি, রিজার্ভ পরিস্থিতি, শিল্প উৎপাদন, দ্রব্যমূল্য, খাদ্য পরিস্থিতি, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কট নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের পূর্বাভাস পাওয়া যাচ্ছে। খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ ব্যাপারে দফায় দফায় হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করছেন। বাংলাদেশের গর্বের অর্থনীতি দেউলিয়াত্বের পথে পা বাড়িয়েছে।
বাংলাদেশের গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যু যুক্তরাষ্ট্রের কড়া নজরদারির মধ্যে রয়েছে। র্যাবের ওপর আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা এবং বাংলাদেশকে গণতন্ত্র সম্মেলনে আমন্ত্রণ না জানানো তারই প্রমাণ বহন করছে। পরিস্থিতি আরো খারাপ হলে নিষেধাজ্ঞার কলেবর বাড়তে পারে। সামনের দিনগুলোতে সরকারকে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বিশেষ করে পশ্চিমা গণতান্ত্রিক দেশের কঠিন চাপ মোকাবেলা করতে হবে। বিরাজমান অস্থিতিশীল পরিস্থিতিতে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির পরস্পরবিরোধী হুমকি-ধমকি, উসকানিমূলক বক্তব্য, থেমে থেমে পুলিশের বাড়াবাড়ি ও বিরোধী দলের কর্মী হত্যা বড় সঙ্কটের পূর্বাভাস। এটি অনাগত দিনে বর্ধিত সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতার ইঙ্গিত বহন করে। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে বিএনপি-আওয়ামী লীগকে সঙ্ঘাতের পথ পরিহার করে অভিন্ন ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে; অন্যথায় দেশ আরো ভয়াবহ বিপর্যয়ের দিকে ধাবিত হবে। এতে সাংবিধানিক শাসনব্যবস্থার অপমৃত্যু ঘটলেও বিস্ময়ের কিছু থাকবে না।