Site icon The Bangladesh Chronicle

ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত, সরকারি বরাদ্দের বাস্তবায়ন নেই

ঘূর্ণিঝড়ে বেড়িবাঁধ বিধ্বস্ত, সরকারি বরাদ্দের বাস্তবায়ন নেই – ছবি : সংগৃহীত

ঘূর্ণিঝড় আমফানের তাণ্ডবে বাংলাদেশের সাতক্ষীরা, পটুয়াখালী, বরগুনা ভোলাসহ নয়টি জেলার কয়েকশ গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে। এসব জেলার পাশ দিয়ে যে নদীগুলো বয়ে গেছে সেগুলোর বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে যাওয়ায় মুহূর্তেই তলিয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা।

অথচ প্রতিবছর বেড়িবাঁধ নির্মাণ এবং সংস্কার বাবদ বাজেটে মোটা অংকের বরাদ্দ দেয়া হয়। কিন্তু স্থানীয় এলাকাবাসী এবং মাঠ পর্যায়ে যে কর্মীরা কাজ করেন তারা জানিয়েছেন, সেই বরাদ্দের কোনো বাস্তবায়ন তারা দেখেননি। যখন সরকারি কোনো চুক্তি হয় তখন সেটার বরাদ্দকৃত অর্থ অনেকভাবেই ভাগাভাগি হয়ে যায় বলে তারা অভিযোগ করেছেন।

বিদেশি দাতব্য সংস্থার কর্মকর্তা নাজমুন নাহার জানান, ‘বরাদ্দ অর্থগুলোর পুরোটা বাঁধ সংস্কার বাস্তবায়নে কাজে লাগে কিনা আমার সন্দেহ আছে। এমনও হয়েছে যে কাগজে কলমে দেখাচ্ছে যে কাজ হয়ে গেছে। আসলে কাজই হয় নাই।’

প্রকৌশলীরা কাজ হয়ে গেছে বলে রিপোর্ট জমা দিয়ে দিলেও সরেজমিনে দেখা গেছে সেই কাজের কোন অস্তিত্বই নেই, এমন অভিযোগ করেন মিসেস নাহার। অথচ ২০০৯ সালে ঘূর্ণিঝড় আইলার পরে এবারই সবচেয়ে প্রবল শক্তিতে উপকূলে আঘাত হেনেছে ঘূর্ণিঝড় আম্পান।

গ্রামের পর গ্রাম প্লাবিত
দীর্ঘ সময় ধরে ঝড় বয়ে যাওয়ায় লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে সাতক্ষীরার উপকূলীয় গ্রাম। দুমড়ে মুচড়ে গেছে কাঁচা ঘর, দোকানপাট, আধপাকা দালান। উপড়ে পড়েছে গাছপালা, বিদ্যুতের খুঁটি। এমন অবস্থায় গত দুইদিন ধরে সেখানকার বাসিন্দারা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন হয়ে আছে।

স্থানীয়দের প্রায় কারো মোবাইলে চার্জ না থাকায় তাদের সাথে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তবে স্থানীয় সাংবাদিক আহসানুর রহমান সাতক্ষীরার বিধ্বস্ত জনপদের চিত্র তুলে ধরার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দাতিনা খালী গ্রামের চুনকুড়ি নদীর ২০০ ফুটের মতো বাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এ কারণে আশেপাশের ২৫টি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

গাবুরা ইউনিয়নের নাপিতখালী গ্রামের প্রায় ৩০০ ফুটের মতো বেড়িবাঁধ ভেঙে গিয়েছে। এরমধ্যে ২০০ ফুট এলাকার অবস্থা সবচেয়ে খারাপ। ভাটা চলাকালীন, যখন পানির উচ্চতা অনেকখানি নেমে আসে, তখন স্থানীয় বাসিন্দারা স্বেচ্ছাশ্রমের মাধ্যমে বাঁধটি সংস্কার চেষ্টা করেন।

কিন্তু জোয়ার এলেই এই বাঁধ টেকানো সম্ভব হবে কিনা সেটা নিয়ে সরেজমিনে গিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন রহমান। এছাড়া গাবুরা ইউনিয়নের চাদনিমুখা এলাকায় বাঁধ ভেঙ্গে আশেপাশের গ্রামগুলোয় পানি ঢুকতে শুরু করেছে। স্থানীয় চেষ্টা করছেন বালিচাপা দিয়ে সেটি নিয়ন্ত্রণের।

জানা গেছে খোলপেটুয়া নদী, কপোতাক্ষ নদ এবং সীমান্ত ঘেঁষা ইছামতী নদীর ২৩টি পয়েন্টে বাঁধ ভেঙে গিয়ে শুধুমাত্র সাতক্ষীরা জেলার প্রায় দুই শতাধিক গ্রাম প্লাবিত হয়ে গেছে।

লোনা পানিতে তলিয়ে গেছে মৎস্য ঘের, ফসলি জমি এবং সুপেয় পানির উৎস। একই অবস্থা পটুয়াখালী, পিরোজপুর, বরিশাল, বরগুনা, ভোলা, খুলনা, বাগেরহাটসহ আরও ৮ জেলা।

বাংলাদেশের উপকূলীয় সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার বেড়িবাঁধ বড় ধরণের ঘূর্ণিঝড় মোকাবিলার জন্য উপযুক্ত নয় জানিয়েছে পানি সম্পদ মন্ত্রণালয় । বর্তমানে যে বাঁধগুলো রয়েছে সেগুলো নিয়মিত জোয়ার ভাটা প্রতিরোধে সক্ষম।

প্রতি অর্থবছরের বাজেটে বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার বাবদ যে অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয় সেটা প্রয়োজনের দশ ভাগের এক ভাগ বলে জানিয়েছেন মন্ত্রণালয়ের সচিব কবির বিন আনোয়ার। তিনি বলেন, সরকার প্রতিবছর যে বরাদ্দ দেয় সেটা সামগ্রিক ১৭ হাজার কিলোমিটার বাঁধের উন্নয়নের জন্য দেয়া হয়।

অর্থাৎ সাড়ে পাঁচ হাজার কিলোমিটার উপকূলীয় বাঁধ থেকে শুরু করে ৮ হাজার কিলোমিটার অভ্যন্তরীণ নদী তীরবর্তী বাঁধ এবং আড়াই হাজার কিলোমিটার হাওড় অঞ্চলের ডুবন্ত বাঁধ সংস্কারে সরকার এই অর্থ বরাদ্দ দেয়া হয়ে থাকে। যা প্রয়োজন সাপেক্ষে অপ্রতুল বলে তিনি জানান।

বাংলাদেশে উপকূলীয় বাঁধের পরিধি ৫ হাজার ৭৫৭ কিলোমিটার। এরমধ্যে অন্তত পাঁচশ কিলোমিটার জুড়ে পাঁচ থেকে ছয় মিটার উঁচু বাঁধ নির্মাণের পরিকল্পনা হাতে নেয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আনোয়ার যেন শক্তিশালী জলোচ্ছ্বাস প্রতিরোধ করা যায়।

এজন্য কক্সবাজার থেকে সাতক্ষীরা পর্যন্ত বাঁধ নির্মাণে পাঁচটি দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প প্রস্তুত করার কথা জানিয়েছেন তিনি। যেগুলো এখনও অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

এই প্রকল্পগুলোর মধ্যে দুটি সম্পূর্ণ সরকারি অর্থায়নে এবং বাকি তিনটি বিদেশি দাতব্য সংস্থার আংশিক সহায়তার ভিত্তিতে বাস্তবায়ন করা হবে বলে জানা গেছে।

পুরনো বাঁধ নষ্ট
প্রকল্প পাস হলে চলতি বছরের শেষ নাগাদ কাজ শুরু হতে পারে এবং সম্পূর্ণ কাজ শেষ হতে তিন বছর পর্যন্ত সময় লাগতে পারে বলে তিনি জানিয়েছেন। ‘গত ১০-১২ বছরে বাংলাদেশের উপকূলে বড় বড় ঘূর্ণিঝড় আঘাত হেনেছে, যা প্রতিবছর চলতে থাকবে। এজন্য আমাদের বড় উন্নয়ন প্রকল্প হাতে নিয়েছি। যেটা ধাপে ধাপে সম্পন্ন করা হবে। এজন্য সময় লাগবে।’

পুরনো বাঁধগুলোর বেশিরভাগ নষ্ট হয়ে গেছে। এছাড়া এখানে প্রায় নয় হাজার অবকাঠামো রয়েছে যেমন: রেগুলেটর, স্লুইসগেট ইত্যাদি, যেগুলো সংস্কার করা প্রয়োজন।

এগুলো এখনও ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে চলছে। যা অটোমেশন অর্থাৎ মটোরাইজড পদ্ধতিতে আনতে হবে। যার জন্য প্রয়োজন প্রচুর সময়, জনবল এবং বাজেটের। এখন মূলত চলছে সংস্কার কাজ। আবার এই সংস্কার কাজে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে সেটা আগের মতো নেই বলে জোর দাবি করেছেন আনোয়ার।

তিনি বলেন, ‘গত বছর আমরা ৭০০টি মেরামত কাজ করেছি যার ৪০% উপকূলীয় অঞ্চলে। এবার সেই জায়গাগুলো ভাঙ্গে না। অন্য দুর্বল জায়গাগুলো ভেঙ্গেছে। এজন্য বাঁধের পুনর্নির্মাণ প্রয়োজন।’

‘দুর্নীতি ৮০ ভাগ কমে গেছে’
এছাড়া দুর্নীতি প্রতিহত করতে বিভিন্ন প্রযুক্তি যেমন: ওয়েবক্যাম, নজরদারি ক্যামেরা, লোকেশন ট্র্যাকের ব্যবস্থা রাখা হয়েছে এবং এসব মনিটর করতে সরকারের ৪০টি টিম কাজ করছে বলে তিনি জানান।

দুর্নীতি প্রসঙ্গে আনোয়ার বলেন, “বরাদ্দ হয়েছে কিন্তু কাজ হয়নি, এটা এখন সম্ভব না। কারণ এই প্রকল্পগুলো যেন প্রকৌশলী ও ঠিকাদারদের কাগজে কলমে না থাকে সেজন্য প্রতিটি জিও ব্যাগ এখন সরকারের মনিটরিং টিম এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সামনে গুনে গুনে ফেলা হয়। আমি জোর গলায় বলতে পারে এখন দুর্নীতি ৮০ ভাগ কমে গেছে।’

সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ জুড়ে রয়েছে দেশের দুর্যোগ প্রবণ উপকূলীয় এলাকার বাঁধ নির্মাণ ও সংস্কার করা। কিন্তু প্রকল্প পরিকল্পনা, আবেদন, অনুমোদন সবশেষে বাস্তবায়নের দীর্ঘসূত্রিতার কারণে বাধ সংস্কার প্রকল্পগুলো ফলপ্রসূ হচ্ছেনা বলে মনে করছেন উন্নয়নকর্মীরা।

সূত্র : বিবিসি

Exit mobile version