Site icon The Bangladesh Chronicle

ঘুষখোর, ঘুষখোর হিসেবে অভিহিত হোক

logo

অবজ্ঞা শব্দটির সমার্থক বাংলা শব্দ- অমর্যাদা, অশ্রদ্ধা, অসম্মান, অবহেলা, উপেক্ষা প্রভৃতি। অন্য দিকে মর্যাদা শব্দটির সমার্থক বাংলা শব্দ- সম্মান, সম্ভ্রম, ইজ্জত প্রভৃতি। মর্যাদার বিপরীত শব্দ হলো- অবজ্ঞা। মর্যাদার মাধ্যমে একজন ব্যক্তিকে যেমন মূল্যায়ন করা হয়; পাশাপাশি যেকোনো শ্রেণী ও পেশার মানুষের মূল্যায়নে মর্যাদার ওপর সর্বাধিক গুরুত্ব দেয়া হয়। একজন ব্যক্তির সত্তার সাথে অপমানজনক ও হানিকর উক্তি অথবা যেকোনো শ্রেণী বা পেশার মানুষের প্রতি অসম্মানজনক আচরণ সার্বিক বিবেচনায় ব্যক্তি, শ্রেণী ও পেশার প্রতি অবজ্ঞা। আর তাই অবজ্ঞার মাধ্যমে ব্যক্তিমানুষ যেমন অপমানিত, লাঞ্ছিত ও ক্ষতিগ্রস্ত হন, অনুরূপভাবে ব্যক্তি মানুষটি যে শ্রেণী বা পেশার অন্তর্ভুক্ত সে শ্রেণী বা পেশার সম্মান বা ইজ্জতের হানি ঘটে। যেকোনো ব্যক্তি, শ্রেণী বা পেশার প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের মাধ্যমে সামাজিক সাম্য ও সুবিচার নিশ্চিত হয়।

বাংলাদেশের সংবিধানে রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতিতে মানবসত্তার মর্যাদা ও মূল্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নিশ্চিতের ওপর সবিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ গুরুত্বের ফলে দেখা যায়, স্বাধীনতার দীর্ঘ সময় অতিবাহিত হওয়ার পর পদবির সাথে হানিকর প্রজাতন্ত্রের এমন কিছু পদের নাম পরিবর্তন করে পরিবার ও সমাজের কাছে তাদের সম্মানকজনক অবস্থানে আসীনের প্রয়াস নেয়া হয়েছে। ব্রিটিশ কর্তৃক এ দেশে প্রশাসনিক অবকাঠামো ও আদালত প্রতিষ্ঠার পর তাদের শাসনামলে এবং তদপরবর্তী পাকিস্তানের শাসনামল ও বাংলাদেশের শাসনামলের একটি উল্লেখযোগ্য সময় অবধি চাপরাশি, আরদালি, পিয়নের পদবি ছিল এমএলএসএস, ঝাড়–দার ও ক্লিনারের পদবি ছিল সুইপার, নৈশপ্রহরীর পদবি ছিল নাইটগার্ড এবং গাড়ি চালনায় নিয়োজিতদের পদবি ছিল ড্রাইভার। এসব পদবি একজন কর্মচারী ও তার পরিবারের সদস্যদের কাছে তার মর্যাদা ও আত্মসম্মানে হানিকর এ বিবেচনায় পদবিগুলো পরিবর্তন করে যথাক্রমে- অফিস সহায়ক, পরিচ্ছন্নতাকর্মী, নিরাপত্তা প্রহরী ও গাড়িচালক নামকরণ করা হয়।

সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ, দফতর, সংস্থা প্রভৃতিতে কর্মরত সাঁটলিপিকার, উচ্চমান সহকারী, নিম্নমান সহকারী ও মুদ্রাক্ষরিক পদধারীদের পদের ইংরেজি নামকরণ ছিল যথাক্রমে- স্টেনোগ্রাফার, ইউডিএ (আপার ডিভিশন অ্যাসিসটেন্ট), স্টেনোটাইপিস্ট ও এলডিএ (লোয়ার ডিভিশন অ্যাসিসটেন্ট)। এসব পদধারী দীর্ঘ দিন যাবৎ তাদের পদবির নাম পরিবর্তন করে তা পেশার মর্যাদার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করতে দাবি জানিয়ে আসছিলেন। অবশেষে তাদের দাবির প্রতি সম্মান দেখিয়ে উপরোক্ত পদবিগুলোর নাম পরিবর্তন করে যথাক্রমে- সাঁটলিপিকার-কাম-কম্পিউটার অপারেটর বা সিএ (কনফিডেনশিয়াল অ্যাসিসটেন্ট বা গোপনীয় সহকারী) বা পিএ (পার্সোনাল অ্যাসিসটেন্ট বা ব্যক্তিগত সহকারী), উচ্চমান সহকারী ও অফিস সহকারী কাম-কম্পিউটার মুদ্রাক্ষরিক রাখা হয়েছে।

প্রজাতন্ত্রের কর্মের সাথে সংশ্লিষ্টদের পদবির নামকরণ পরিবর্তন করে তাদের যথাযথ মর্যাদা দেয়া হলেও এমন অনেক পেশা রয়েছে সমাজের সর্বত্র যাদের উপস্থিতি বিরাজমান, যেমন- গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত কাজের বুয়া, কৃষিকাজে নিয়োজিত কৃষক বা চাষি, মালামাল তোলা-নামানোর কাজে নিয়োজিত কুলি, দৈনিক মজুরিতে নিয়োজিত কামলা, রিকশা চালনায় নিয়োজিত রিকশাওয়ালা, হাসপাতাল, ক্লিনিক ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ধোয়া-মোছা ও ফুট ফরমায়েশের কাজে নিয়োজিত আয়া, বিয়ে অনুষ্ঠান, জিয়াফত ও মেজবানিতে রান্নার কাজে নিয়োজিত বাবুর্চি, কাপড়-চোপড় ধোলাই ও ইস্ত্রির কাজে নিয়োজিত ধোপা, চুল কাটার কাজে নিয়োজিত নাপিত, জুতা সেলাই ও পলিশের কাজে নিয়োজিত মুচি, গরু, মহিষ, ছাগল, ভেড়া জবাইয়ের পর গোশত বিক্রির কাজে নিয়োজিত কসাই, জাল দিয়ে মাছ ধরায় নিয়োজিত জেলে, মনুষ্য বর্জ্য অপসারণ ও নিষ্কাশনে নিয়োজিত মেথর প্রভৃতি নাম এসব কর্মে নিয়োজিত মানুষের মর্যাদার জন্য হানিকর ও অসম্মানজনক। এসব কর্মে নিয়োজিত ব্যক্তিরা প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিতদের মতো সংগঠিত আকারে তাদের পেশার অমর্যাদাকর নামের পরিবর্তন করে মর্যাদাজনক নামে নামকরণে সংগঠিত হয়ে দাবি পেশের ব্যর্থতায় সমাজের কারোর এসব বিষয়ে তেমন মাথাব্যথা লক্ষণীয় নয়।

গৃহস্থালি কাজে নিয়োজিত কাজের বুয়াদের সম্প্রতি অনেক পরিবারের লোকজন বুয়ার পরিবর্তে খালা নামে সম্বোধন করেন। নামটি তাদের পেশার জন্য মর্যাদাজনক। এদের গৃহকর্মী নামে অভিহিত করা হলেও তা তাদের পেশার জন্য মর্যাদাজনক হবে। গৃহস্থালি কাজে আমাদের দেশ থেকে ইদানীং যারা বিদেশ যাচ্ছেন, তাদের গৃহকর্মী নামে অভিহিত করা হয়।

কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহকারীরা কৃষক বা চাষা নামে অভিহিত হয়ে এলেও আমাদের দেশের একশ্রেণীর তথাকথিত শিক্ষিত কারো সাথে অশোভন আচরণ করার সময় বা কাউকে গালি দেয়ার সময় তাকে চাষা নামে ডেকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রয়াস নেয়। এ ধরনের তথাকথিত শিক্ষিতদের মোটেই ধারণা নেই, এ দেশের অর্থনীতি সচল রাখার পেছনে এবং দেশের জনমানুষের জন্য খাদ্যের জোগান দানে যে শ্রেণীর অনন্য অবদান, তারা আর কেউ নন- এ দেশের কৃষকসমাজ। কৃষক বা চাষি নিজের ভরণপোষণে কৃষি বা চাষের কাজ করেন। কৃষক বা চাষির যেকোনো বাড়তি উৎপাদিত পণ্য তারা বাজারে বিক্রি করে তাদের অপরাপর চাহিদা মিটিয়ে থাকেন। কৃষক বা চাষিরা কৃষিকাজে বা চাষে আধুনিক প্রযুক্তি, উন্নত বীজ, সার, কীটনাশক ও সেচ ব্যবহারে সবধরনের ফসলের উৎপাদন কয়েকগুণ বেড়েছে। কৃষক বা চাষির অবদানে কৃষি উন্নয়নের ধারা অব্যাহত আছে। কৃষক বা চাষির অক্লান্ত পরিশ্রমে কৃষির যে উন্নয়ন ঘটে চলেছে, তার একক কৃতিত্বের দাবিদার একমাত্র কৃষক বা চাষি। আর তাই কৃষক বা চাষিকে নিয়ে এখনো যারা অবহেলা বা অবজ্ঞায় নিচু ভেবে গালি দেয়, তার অবসানে কৃষক বা চাষির পরিবর্তে এদের কৃষি উন্নয়নকর্মী নামে অভিহিত করা হলে অবমাননা বা লাঞ্ছনার যবনিকাপাত ঘটবে বলে আমাদের বিশ্বাস।

কুলি, কামলা, রিকশাওয়ালা, আয়া, মেথর, বাবুর্চি, ধোপা, নাপিত, মুচি, কসাই, জেলে প্রভৃতি খেটেখাওয়া মানুষের পেশা। এসব পেশায় যারা নিয়োজিত এদের সমাজের একশ্রেণীর তথাকথিত ভদ্রলোক অবজ্ঞা ও অবহেলার চোখে দেখে কাউকে মন্দ কিছু বলার সময় এ ধরনের যেকোনো একটি পেশার নাম ধরে এটিকে বিশেষণ হিসেবে ব্যবহার করে নিজেদের খেদ মেটায়। এসব পেশায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা আমাদের সমাজজীবনের অপরিহার্য অংশ। তাদের কারণে সমাজ সচল ও গতিশীল। এরূপ যেকোনো একটি শ্রেণী বা পেশার অনুপস্থিতিতে সমাজ বা জীবনে দুর্ভোগ নেমে আসার উপক্রম ঘটে। আমাদের সমাজ ও জীবন যাদের ছাড়া অচল অথচ নিয়তির কী নির্মম পরিহাস- তাদের আমরা অবজ্ঞা বা অবহেলায় পেশার নাম ধরে গালমন্দ করতে কুণ্ঠিত হই না। এসব শ্রেণিপেশার মানুষ প্রজাতন্ত্রের কর্মে নিয়োজিত পিয়ন, সুইপার, ঝাড়–দার, নাইটগার্ড, ড্রাইভার প্রভৃতির মতো সরকারের বরাবর দাবি পেশ করে তাদের পেশার নামের পরিবর্তনে অক্ষম বিধায় দেশ ও সমাজের সচেতন এবং বিবেকবান মানুষকে তাদের পেশার নামের পরিবর্তনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে হবে। পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনায়, কুলির পরিবর্তে মালামাল পরিবহনকর্মী, কামলার পরিবর্তে দিনকর্মী, রিকশাওয়ালার পরিবর্তে রিকশাচালক, আয়া ও মেথরের পরিবর্তে পরিচ্ছন্নতাকর্মী, বাবুর্চির পরিবর্তে রন্ধনকর্মী, ধোপা, নাপিত ও মুচির পরিবর্তে নির্মলতাকর্মী, কসাইয়ের পরিবর্তে গোশত প্রক্রিয়াকরণকর্মী, জেলের পরিবর্তে মৎস্যজীবী নামকরণ করা হলে এদের নিয়ে উপহাস বা অপবাদের অবসান হবে।

আমাদের দেশে সরকারি-বেসরকারি চাকরি, পাসপোর্ট, জন্মনিবন্ধন, জাতীয় পরিচয়পত্র, স্কুল, মহাবিদ্যালয় ও বিশ্ববিদ্যালয় প্রভৃতির আবেদনের ক্ষেত্রে মা-বাবার পেশার বিবরণ দিতে হয়। পেশার বিবরণ দিতে গিয়ে যখন কেউ বুয়া, কৃষক বা চাষি, কুলি, কামলা, রিকশাওয়ালা, আয়া, মেথর, বাবুর্চি, ধোপা, নাপিত, মুচি, কসাই, জেলে- এর যেকোনোটির উল্লেখ করেন, তখন অনেকে কটাক্ষ করে তাদের অতীত নিয়ে বিরূপ বাক্যবাণে বিব্রতকর পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটান। এসব পেশার নামকরণের পরিবর্তন করা হলে তাদের ভবিষ্যৎ বংশধররা অবমাননাকর ও লাঞ্ছনাকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার হাত থেকে রেহাই পাবেন।

আমাদের দেশে ঘুষের সাথে দেশ ও সমাজের প্রভাবশালীরা অধিক জড়িত। যেসব মানুষ জ্ঞাত আয়বহিভর্‚ত অর্থ দিয়ে জীবন ধারণ করেন তারা হলো ঘুষখোর। এরা নিজেদের ঘুষ গ্রহণ থেকে নিবৃত্ত করলে তাদের অধীনে কর্মরত কেউ ঘুষ গ্রহণে সাহসী হবেন না। ঘুষ গ্রহণ অপরাধ হলেও আমাদের মূল দণ্ড আইন দণ্ডবিধি-১৮৬০-এ ঘুষ শব্দটি ব্যবহার না করে এটিকে ইংরেজিতে গ্র্যাটিফিকেশন নামে অভিহিত করা হয়েছে, যার বাংলা হলো- উৎকোচ। অনুরূপ দুর্নীতি প্রতিরোধ আইন-১৯৪৭-এ ঘুষকে ক্রিমিনাল মিস কন্ডাক্ট নামে অভিহিত করা হয়েছে, যার বাংলা হলো অপরাধমূলক অসদাচরণ। একইভাবে দুর্নীতি দমন কমিশন আইন-২০০৪-এ ঘুষকে দুর্নীতি নামে অভিহিত করা হয়েছে। এ তিন আইনে ঘুষকে ঘুষ হিসেবে নামকরণ করে ঘুষ গ্রহীতাকে ঘুষখোর হিসেবে অভিহিত করা হলে ঘুষের সাথে সম্পৃক্ত ব্যক্তিরা দেশ ও সমাজে হেয় ও নিকৃষ্ট হিসেবে চিহ্নিত হতেন। কিন্তু ঘুষের সাথে সমাজের প্রভাবশালীরা সম্পৃক্ত হওয়ায় দেশের প্রচলিত আইনে দুঃখজনকভাবে ঘুষ শব্দটি অনুপস্থিত। ঘুষখোরদের দেশ ও সমাজের সবাই অবজ্ঞার চোখে দেখা উচিত। তবে দেশ ও সমাজের নিয়ন্ত্রণে এদের প্রাধান্য থাকায় এরা অবজ্ঞার পরিবর্তে মর্যাদার আসনে আসীন।

উৎকোচ অপরাধমূলক অসদাচরণ ও দুর্নীতি ঘুষের সমার্থক। ঘুষের কারণে আজ আমাদের দেশ ও সমাজ অস্থির। কোথাও কোনো নিয়ম-শৃঙ্খলা নেই। ঘুষের রাশ টেনে ধরা না গেলে অচিরে দেশ ও সমাজের সবপর্যায়ে ধস নামবে। সে ধসের ধকল বহনের শক্তি দেশ এবং সমাজের না থাকায় তা দেশ ও সমাজের জন্য বিপর্যয় বয়ে আনবে। আর তাই পদ বা পেশার নামের পরিবর্তন করে যাদের মর্যাদার আসনে আসীন করা প্রয়োজন, তা না করে যদি যারা দেশ ও সমাজের অশেষ ক্ষতি ও অনিষ্ট সাধন করছে, তাদের আইনের মারপ্যাঁচে ঘুষখোর না বলে উৎকোচ গ্রহীতা বা অপরাধী বা দুর্নীতিবাজ নামে অভিহিত করা হয়; তাহলে আমাদের উন্নয়ন, সমৃদ্ধি ও অগ্রযাত্রা এবং শোষণমুক্ত সমাজ বিনির্মাণের স্বপ্ন দূর পরাহত।

লেখক : সাবেক জজ, সংবিধান, রাজনীতি ও অর্থনীতিবিশ্লেষক

E-mail : iktederahmed@yahoo.com

Source: https://dailynayadiganta.com/opinions/sub-editorial/vEK6hKFQAAan

Exit mobile version