wasimahin 25 July 2022
ঐতিহাসিকভাবে রুবল অনেক পুরাতন মুদ্রা যার প্রচলন ১৩’শ শতক থেকেই চলে আসছে। কিন্তু তেল বাণিজ্যের উপর গড়ে উঠা মার্কিন ডলার বিশ্বের নতুন কারেন্সিগুলির একটি। ১৮৬১ সালে আমেরিকান সিভিল ওয়ার এর অর্থ যোগাতে নোট হিসাবে মার্কিন ডলারের সূচনা। শুরুতে নোট গুলি সবুজ রং এর ছিল বিধায় একে গ্রিনব্যাক ও ডাকা হয়।
মার্কিন আধিপত্য সূচনা হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর। বলা হয়ে থাকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সবথেকে লাভবান পক্ষ হল আমেরিকা। অন্য সব দেশ যখন যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতি পোষাতে ও অর্থনীতি পুনরুদ্ধারে ব্যাস্ত, তখন যুক্তরাষ্ট্রকে এর কিছুই করতে হয়নি। তাদের অর্থনীতি তখন দ্রুত বড় হচ্ছিল। এরপর ব্রেটন উড চুক্তির মাধ্যমে আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে মার্কিন ডলারের ভীত রচনা হয়। বিশ্বের সব দেশের মুদ্রাকে ডলারের প্রেক্ষিতে মূল্যায়ন শুরু হয়। তবে নিক্সন শকের আগ পর্যন্ত ডলারের বিপরীতে গোল্ড সংরক্ষন করার নীতি বহাল ছিল। অর্থাৎ ডলারে আন্তর্জাতিক বাণিজ্য হলেও যেকোন মুহুর্তে ডলারের বিপরীতে সমমূল্যের গোল্ডে রুপান্তর করার সুযোগ ছিল। এরপর এল ১৯৭১। বিখ্যাত নিক্সন শক। হুট করেই আমেরিকার প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের সময় Fiat Currency এর সূচনা হয়। ডলারের বিপরীতে সমমূল্যের গোল্ড রাখার বাধ্যবাধকতা থেকে আমেরিকা বেরিয়ে আসে। সেই থেকে ডলারকে লিগাল টেন্ডার হিসাবে বিবেচনার বিপরীতে শুধুমাত্র সরকারি প্রমিজ/ঘোষনা ব্যাতিত কোন কমোডিটি রাখা হয়নি। শুরু হল ফিয়াট কারেন্সির যাত্রা। সেই সাথে ফ্লোটিং মার্কেট রেট।
আর এই ব্যাবস্থার মাধ্যমে আমেরিকা বিশ্বের একচ্ছত্র অধিপতি হয়ে উঠে। আন্তর্জাতিক বাণিজ্যে সবাইকে ডলারে লেনদেন করতে হয়। শুধুমাত্র আমেরিকা এখানে বিশেষ সুবিধা পায়। কেমন সেটা? ধরুন বাংলাদেশের টাকা দিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে কোন পণ্য কেনা হবে। সেক্ষেত্রে টাকাকে ডলারে রুপান্তর করতে হয়। এক্ষেত্রে এক্সচেঞ্জ গেইন/ কনভারসন চার্জ এর মত বাড়তি খরচ হয়। কিন্তু আমেরিকার কারেন্সি যেহেতু ডলার তাই ব্যাবসায়ে তাদের এরকম চার্জ দেয়া লাগে না।
আরেকটি ভয়ঙ্কর তথ্য দেয়া যেতে পারে। অনেকেই দেখেছেন যুক্তরাষ্ট্রের জিডিপি থেকেও ঋন বেশি। কিন্তু তাদের এর জন্য তেমন ক্ষতিকর পরিস্থিতির মুখোমুখি হতে হয়না। ফেব্রুয়ারি, ২০২২ এ প্রথমবারের মত যুক্তরাষ্ট্রের ঋন $৩০ ট্রিলিয়ন (৩০,০০০ বিলিয়ন) ডলার ছাড়িয়েছে। ২০২১ সালে দেশটির জিডিপির ১৩৭.২০% ছিল তাদের ঋন। অনেকের প্রশ্ন আসতে পারে দেশের জিডিপি থেকে ঋন এত বেশি হল কিভাবে? যেখানে ৮০%-৯০% ঋন নিয়েই পাকিস্তান শ্রীলংকার মত দেশকে চরমভাবে ভুগতে হচ্ছে?
উত্তরটা খুব সহজে দেয়ার চেষ্টা করি। বাংলাদেশের রিজার্ভ প্রায় $৪৬ বিলিয়ন ডলার। এর ভেতর অতি অল্প পরিমানে গোল্ড, কিছু ইউরো আর বাকি প্রায় সবটুকুই মার্কিন ডলারে রয়েছে। এই রিজার্ভের খুব নগণ্য অংশ বাংলাদেশে রয়েছে। পুরটায় আমেরিকার ফেডারেল রিজার্ভ সিস্টেমে জমা। আর ডলারের সবটুকু অংশ ফেলে না রেখে সল্প সুদে ইউএস ট্রেজারি বন্ড এবং অন্যান্য সল্প মেয়াদি স্কিমে রাখা হয়। এতে জমাকৃত ডলারের বিপরীতে কিছু লাভ ও পাওয়া যায়। শুধু বাংলাদেশ না। বিশ্বের প্রায় সব দেশ এভাবেই রাখে। এতে আমেরিকার ডলারের সংকট হয়না। বিভিন্ন বন্ড ইস্যু করে খুব সল্প সুদেই এখান থেকে ঋন নিতে পারে তারা। ২০২০ সালের শেষ নাগাদ আমেরিকার ঋনের প্রায় ৩৭% ছিল বিদেশিদের। এটা একটা ভয়াবহ ক্ষমতা।
ভারতের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ও সাবেক কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গভর্নর ফিয়াট কারেন্সির ডলারের আধিপত্য কে আখ্যা দিয়েছিলেন সত্যিকারের ওয়েপন অব ম্যাস ডেসট্রাকশন।
এর বাস্তব প্রমাণ হিসাবে হাজির হয়েছে রাশিয়ার উপর রিজার্ভের নিষেধাজ্ঞা যার কারনে মুহুর্তেই রাশিয়ার $৬৩০ বিলিয়ন ডলার ‘নাই’ হয়ে গেছে। তবে মজার বিষয় হল ডলারের এরকম পলিটিকাল হাতিয়ার হিসাবে (ওয়েপন হিসাবে) এভাবে ব্যাবহার করার নজির বিরল। রাশিয়াকে শায়েস্তা করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার ফলে সারাবিশ্বের কাছে একটা ভয়ঙ্কর বার্তা গেছে সেটি হল ‘রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ডলার আর নিরাপদ নয়’। একি সাথে সুইফট এর নিষেধাজ্ঞাও সারাবিশ্বে সুইফট এর প্রতিযোগীতাহীন আধিপত্য কে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। আর এই দুইটি স্পর্শকাতর ইস্যু হতে পারে ডলারের আধিপত্যের সমাপনী ঘন্টা।
এবার কিছু লক্ষণ নিয়ে আলোচনা করা যাক। ডলারের আধিপত্যের অন্যতম কারনগুলির একটি হল ডলারে তেল কেনা বেচা। এর থেকেই পেট্রোডলারের উৎপত্তি। তেলের লেনদেন ডলারে হবার ফলে সারা বিশ্বেই ডলারের অপরিহার্যতা ছড়িয়ে পড়ে। কিন্তু বর্তমানে ডলারের উপর আস্থার ঘাটতি তৈরি হওয়ায় একটা বড় পরিবর্তন এসেছে যখন সৌদি আরব চীনের ইউয়ানে তেল বিক্রির লেনদেনের জন্য আলোচনা করে।
অন্যদিকে রাশিয়ার রুবলে গ্যাস বিক্রির সিদ্ধান্ত রাশিয়ার উপর জ্বালানির ক্ষেত্রে নির্ভরশীল ইউরোপকে হয়ত বাধ্য করবে রুবলে পেমেন্ট করতে। আর এটা হলে ডলারের আধিপত্যের উপর চরম আঘাত আসবে। তবে যদি বিষয়টি এমন হয় যে রাশিয়া ইউয়ান এ পেমেন্ট গ্রহন করে তবে বিশ্ব একটি নতুন মাইন্ড গেম দেখতে যাচ্ছে।
বর্তমানে বিশ্বের মোট $১২.৮ ট্রিলিয়ন ডলার রিজার্ভের ৬০% ডলারে সংরক্ষিত। বিগত দুই দশক যাবত ডলারের এই হার ক্রমহ্রাসমান। গোল্ডম্যান স্যাকস এর মত অনেক প্রতিষ্ঠান মনে করছে ডলারের উপর আস্থা হারানো ডলারকে ব্রিটিশ পাউন্ডের মত দুর্বল কারেন্সিতে রুপান্তর করতে পারে। রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নিষেধাজ্ঞার ফলে ডলারের রিজার্ভ সংরক্ষনের হার আরো দ্রুত কমবে।
ইতোমধ্যে ডলারের তুলনায় ইউরোতে রিজার্ভ রাখার পরিমান বাড়তেছে। বৈশ্বিক লেনদেনেও ইউরো এখন ডলারকে প্রায় ছুয়ে ফেলার পর্যায়ে। অন্যদিকে অতি সম্প্রতি নিরবে উত্থান হয়েছে চাইনিজ ইউয়ান এর (রেমিনবি)।
দক্ষিণ আমেরিকার সর্ববৃহৎ অর্থনীতি ব্রাজিলের কেন্দ্রীয় ব্যাংক ফরেন রিজার্ভ হিসাবে ইউয়ানের পরিমান চার গুন বাড়িয়েছে।
২০১৮ সালেও সেদেশে ইউয়ানের কোন রিজার্ভ ছিলনা। ২০২০ সালে ব্রাজিলের রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ইউয়ান ছিল মাত্র ১.২১% যা বর্তমানে ৪.৯৯% এ ঠেকেছে। একি সময়ে দেশটিতে ডলারের রিজার্ভ ৮৬.০৩% থেকে কমে ৮০.৩৪% এ দাঁড়ায়।
বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রেও ডলারের ব্যাবহার ক্রমহ্রাসমান। মাত্র অল্প কয়েক বছরেই বিশ্বের মোট বৈদেশিক লেনদেনের ক্ষেত্রে ইউয়ান এর ব্যাবহার ৩% এ গিয়ে ঠেকেছে যেখানে ডলারের ব্যাবহার কমতে কমতে ৪০% এ দাড়িয়েছে। ইউরো কারেন্সিতে লেনদেন ৩৭% এর কাছাকাছি যা ডলারের ঘাড়ে ইতোমধ্যে শ্বাস ফেলছে। বর্তমান বিশ্ব পরিস্থিতিতে একটি বিষয় ভুললে চলবে না যে, চীন এখন প্রায় বিশ্বের অধিকাংশ দেশের প্রধান ট্রেড পার্টনার। এমনকি আমেরিকার ও। আর চীন ২০১৮ এর পর থেকে ধীরে ধীরে ইউয়ান কে সারা বিশ্বে গ্রহণযোগ্য ও আস্থার কারেন্সিতে রুপান্তরের কাজ করছে।
বাংলাদেশ ২০১৮ তেই ইউয়ান এ লেনদেনের অনুমোদন করলেও, এতদিন বাংলাদেশি ব্যাংকগুলির চীনের ব্যাংকে হিসাব খোলার ব্যাপারে আগ্রহ ছিলনা। কিন্তু বর্তমানে পরিস্থিতি পরিবর্তন হয়েছে। এখন চীনের ব্যাংগুলিও বাংলাদেশের ব্যাংক গুলির হিসাব খুলতে আগ্রহী। হয়ত খুব বেশি সময় লাগবে না যখন বাংলাদেশের রিজার্ভ কারেন্সির একটি অংশ ইউয়ান এ রাখবে। ইতোমধ্যে স্টিল ট্রেডে ইউয়ান এর শক্ত অবস্থান নিশ্চিত হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের বৃহৎ বাণিজ্যিক পার্টনার ও চীন। সেক্ষেত্রে ঝুকি কমাতে এবং রিজার্ভ মিক্স বাড়াতে ইউয়ান ভাল সুযোগ হতে পারে।
মোটকথা, রাশিয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের উপর নিষেধাজ্ঞা ও সুইফট এর নিউট্রাল অবস্থান থেকে সরে আসা ডলার ও সুইফট এর আধিপত্যে আঘাত হেনেছে। আর এই পরিস্থিতির সবথেকে লাভবান পক্ষ রাশিয়া বা আমেরিকা নয়। দেশটি চীন। তারা সুইফট এর চাইনিজ বিকল্পকে দাড় করানোর দুর্দান্ত সুযোগ পেল, আবার একি সাথে রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে ইউয়ানকে আরো যৌক্তিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত করবার সুযোগ পেল।
বেশি নয়, মাত্র দুই চার বছরের ভেতরেই বিশ্ব অর্থব্যবস্থা হয়ত বড় পরিবর্তন দেখবে।
আপডেট হল, ডেভেলপিং -৮ বা D-8 ইতোমধ্যে কারেন্সি সোয়াপ এগ্রিমেন্ট নিয়ে ভাবছে। বাংলাদেশ, তুরস্ক, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ইরান, মিশর, নাইজেরিয়া, পাকিস্তান মিলিয়ে প্রায় ৫ ট্রিলিয়নের অর্থনীতি যে ডলারের বিকল্প ভাবছে সেটা সত্য হয়েছে। রাশিয়া সুইফট এর বিকল্পে বাংলাদেশের সাথে ট্রেড করতে চাইছে। ভারত ও চাইছে রুপিতে ট্রেড বাড়াতে, বিশ্বের অধিকাংশ দেশ এখন ডলারের বিকল্প নিয়ে ভাবছে। ডলার স্টাবল কারেন্সি হিসাবে আগের ধারনার প্রতি সন্দেহ জাগিয়েছে কারন অধিকাংশ দেশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ডলারের অস্বাভাবিক মূল্য বৃদ্ধি এবং অধিকাংশ দেশের ডলার রিজার্ভ কমে যাওয়া ডলারের প্রভাব চুড়ান্তভাবে কমাবে। চীন ও চাইছে ইউয়ানকে প্রতিষ্ঠা করতে। ইম্প্যাক্ট শুরু হয়েছে। অধিকাংশ দেশের রিজার্ভ ব্যাংক এখন চাইবে রিজার্ভ পোর্টফলিওতে পরিবর্তন আনতে এবং সেটা ডলারে রিজার্ভ কমিয়ে অন্য কারেন্সির মাধ্যমেই করবে। এমনকি ইজরাইল এখন ইউয়ান কে রিজার্ভ কারেন্সি হিসাবে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। পরিবর্তন আসছে। ডলার রাজনৈতিক ভাবে নিরপেক্ষতা হারিয়েছে, আস্থাও হারিয়েছে। সুইফট ও অবরোধের মাধ্যম হিসাবে ব্যাবহার করায় গ্রহণযোগ্যতা আংশিক হারিয়েছে। যারা ভাবছেন যে ডলারের মূল্য বৃদ্ধি ডলারের ক্ষমতার প্রকাশ, তাদের হয়ত হতাশ হতে হবে। দেখি আগামী দিনগুলিতে কি ঘটে।
#wasimahin
লেখা: এপ্রিল ৫, ২০২২
শেষ প্যারাটি নতুন যুক্ত করা হয়েছে।
Find my writings here–