নগরবাসীকে নিরাপদ ও সুপেয় পানি সরবরাহের বিধিবদ্ধ সংস্থার নাম ওয়াসা। তারা নদী ও গভীর নলকূপ থেকে আহরণ করা পানি যথাযোগ্য উপায়ে পরিশোধনের পর সরাসরি খাওয়ার উপযোগী করে নগরবাসীর কাছে পৌঁছে দেবে, এটা তাদের দায়িত্ব। কিন্তু এই ওয়াসার পানি কেউ সরাসরি পান করে না। যারা করে, তারা বাধ্য হয়ে করে, বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় করে। আগারগাঁও বস্তির বাসিন্দা সেলিম ও তাঁর স্ত্রী রোকেয়া কীভাবে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে খাবেন? তাঁদের ছয় পরিবারের জন্য রান্নার চুলা তো দুটি। ফুটিয়ে পান করার মতো ‘বিলাসিতা’ ও সময় তাঁদের কোথায়? সেলিম-রোকেয়াদের মতো হাজারো মানুষ এ শহরে আছে, সরাসরি ওয়াসার পানি খেয়ে পেটের পীড়া যাদের নিত্যসহচর।
জ্বালানিসংকটের এই বুভুক্ষু সময়ে ঢাকার বেশির ভাগ পরিবারেই চড়া মূল্য দিয়ে কেনা গ্যাস পুড়িয়ে ওয়াসার পানি ফুটিয়ে তারপর পান করা হয়। কেউ কেউ আছেন, যাঁরা ফুটানো পানি পুনরায় ফিল্টার করে নেন। প্রশ্ন হলো, কেন সরকারি সেবা সংস্থার সরবরাহ করা পানি সরাসরি পান করা যাবে না? কেন এ জন্য আবার গ্যাস পোড়াতে হবে? বিষয়টি একেবারেই মালুম হয় না।
পরিসংখ্যান হাজির করা যাক। ঢাকা ওয়াসার অনিয়ম-দুর্নীতি ও গ্রাহকসেবার বিভিন্ন ঘাটতির দিক নিয়ে ২০১৯ সালে ‘ঢাকা ওয়াসা: সুশাসনের চ্যালেঞ্জ ও উত্তরণের উপায়’ শীর্ষক এক প্রতিবেদন প্রকাশ করে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি)। তাতে বলা হয়, ঢাকা ওয়াসা পাইপলাইনের মাধ্যমে সুপেয় পানি সরবরাহে ব্যর্থ। ৯১ শতাংশ গ্রাহক পানি ফুটিয়ে পান করেন। পানি ফুটিয়ে পানের উপযোগী করতে বছরে ৩২২ কোটি টাকার গ্যাস খরচ হয়। অর্থাৎ ওয়াসা যদি পানের উপযোগী পানি সরবরাহ করত, তাহলে এত বিপুল অর্থের গ্যাস সাশ্রয় হতে পারত।
ইতিমধ্যে ভোক্তাপর্যায়ে গ্যাসের দাম গড়ে ২২ দশমিক ৭৮ শতাংশ বাড়ানো হয়েছে। বাসার রান্নায় ব্যবহৃত দুই চুলায় মাসে ১ হাজার ৮০ টাকা ও এক চুলায় দিতে হচ্ছে ৯৯০ টাকা। আর প্রিপেইড মিটারের গ্রাহক প্রতি ইউনিটে (ঘনমিটার) দিচ্ছেন ১৮ টাকা, তাঁদের খরচ বেড়েছে ৪৩ শতাংশ। জুন মাস থেকে নতুন এ দাম কার্যকর হয়েছে। শোনা যাচ্ছে, গ্যাসের দাম নাকি আরও বাড়বে। জ্বালানি তেলের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির পর গ্যাস আর বাদ থাকে কেন! এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, ওয়াসার পানি ফোটানো বাবদ জনগণের পকেট থেকে বেরিয়ে যাবে আরও বিপুল অঙ্কের টাকা, পুড়বে আরও বিপুল পরিমাণ গ্যাসসম্পদ।
ঢাকা ওয়াসার ক্ষমতাধর এমডি, যিনি ২০০৯ সাল থেকেই এই পদে নটআউট আছেন, একবার দাবি করেছিলেন, তাঁদের সরবরাহ করা পানি সরাসরি পানযোগ্য। এরপর ঢাকার জুরাইন থেকে সমাজকর্মী মিজানুর রহমান ওয়াসার পানি নিয়ে গিয়েছিলেন কারওয়ান বাজারে প্রতিষ্ঠানটির কার্যালয়ে এমডিকে শরবত বানিতে খাওয়াতে। কিন্তু অনেকক্ষণ অপেক্ষার পরও মেহমানকে নিজের ঘরে ডেকে নেননি মান্যবর এমডি; বরং দূর দূর করে তাড়িয়ে দেন। ঘটনাটি ওই সময় নগরবাসীকে নাড়া দিয়েছিল; যদিও তাতে কোনো ফল হয়নি। অবশ্য গত ৫ এপ্রিল জাতীয় প্রেসক্লাবে ‘নগরবাসীর চাহিদা-ঢাকা ওয়াসার সক্ষমতা’ শীর্ষক এক সংলাপে এমডি ভুল স্বীকার করে নেন। তিনি কবুল করেন, তাঁর বাসার পানিতেও দুর্গন্ধ থাকে।
প্রকৃতপক্ষে ওয়াসার এমডির ভুল স্বীকার-অস্বীকারের মধ্যে সাধারণ জনগণের কিছু এসে-যায় না। কারণ, তিনি নিজ প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা পানি পান করেন বলে মনে হয় না। ধারণা করা যায়, নীতা আম্বানির মতো না হলেও তাঁর জন্য কোনো প্রতিষ্ঠানের সরবরাহ করা কাকচক্ষু পানি বরাদ্দ থাকে। প্রশ্ন হলো, এত বড় একটি গুরুত্বপূর্ণ ও জরুরি সেবা সংস্থার প্রধান হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার পর গত ১৩ বছরে তিনি কী কাজটা করলেন, কেবল বছর বছর পানির দাম বাড়ানো ছাড়া। পানির মান বাড়াতে কি পদক্ষেপ তিনি নিলেন? প্রকৃতপক্ষে, তাঁর কোনো পদক্ষেপই দৃশ্যমান নয়। স্বয়ং ওয়াসার নথি বলছে, পানিসংকটের কথা, পানিতে দুর্গন্ধের কথা। গত ২০ এপ্রিল প্রথম আলোয় শামসুর রহমানের এক প্রতিবেদনে কল্যাণপুরের বাসিন্দা সাদিয়া শারমিন বলছেন, পানি এমন ময়লা ও দুর্গন্ধযুক্ত যে রীতিমতো ফেনা ওঠে। ওয়াসার হেল্পলাইনে একাধিকবার কল করেছেন। প্রতিবারই উত্তর পেয়েছেন ঠিক হয়ে যাবে, কিন্তু ঠিক আর হয় না। এ রকম অভিযোগ আছে হাজারে হাজারে।
হঠাৎ হঠাৎ এই নগরে ডায়রিয়ার প্রকোপ বেড়ে যায়। আর এ জন্য যে ওয়াসার পানিই প্রধান ভূমিকা রাখে, তা বলতে কোনো চিকিৎসকের রেফারেন্স না দিলেও চলে। একে তো পানির দাম বেশি নিচ্ছে, এর ওপর সাধারণ মানুষকে পেটের পীড়ায় আক্রান্ত করে ওষুধ কেনার জন্য আরও খরচ বাড়ানোর বন্দোবস্ত করেছে ঢাকা ওয়াসা।
আমাদের স্পষ্ট মনে আছে, ২০১০ সালে মান্যবর এমডি ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘ঘুরে দাঁড়াও ওয়াসা’ নামে একটি কর্মসূচি নিয়েছিলেন। এক যুগ পরে এসে দেখা যাচ্ছে, ওয়াসার সেবা প্রত্যাশা অনুযায়ী বাড়েনি। কথা ছিল ভূগর্ভস্থ উৎস থেকে আহরণ কমিয়ে ভূ-উপরিভাগের উৎসে জোর দেওয়া হবে। কারণ, গভীর নলকূপ বসিয়ে পানি তোলায় দিন দিন নেমে যাচ্ছে পানির স্তর। আর দিনকে দিন বাড়ছে উত্তোলনের খরচ। ১০ বছর আগে একটি গভীর নলকূপ বসাতে খরচ হতো ৪০ থেকে ৫০ লাখ টাকা। এখন খরচ হয় ১ কোটি ২০ লাখের বেশি। বাড়তি খরচ মেটানো হচ্ছে জনগণের পকেট কেটে। আর প্রকৃতি ও পরিবেশের বড় ঝুঁকির বিষয় তো আজকাল কেউ গোনায় ধরে না।
পত্রপত্রিকার খবর বলছে, নদীর পানি শোধনে নেওয়া ওয়াসার প্রকল্পগুলোর অগ্রগতি খুবই ধীর। এসব প্রকল্প বাস্তবায়নে ঢাকা ওয়াসা ঋণ নিয়েছে ২১ হাজার কোটি টাকা, আর চট্টগ্রাম ওয়াসা নিয়েছে ৬ হাজার ২৮৮ কোটি টাকা। স্বয়ং ওয়াসার কর্মকর্তারাই গণমাধ্যমে বলেছেন, সামনে এগোনোর বদলে অনেক ক্ষেত্রে ওয়াসা পিছিয়েছে। গত ১২ বছরে ঢাকায় নতুন কোনো পয়োনিষ্কাশন লাইন তৈরি হয়নি; বরং আগের পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা পুরো ভেঙে পড়েছে। আগেই বলেছি, আইন অনুযায়ী, ঢাকা ওয়াসার মূল দায়িত্ব নিরবচ্ছিন্ন পানি সরবরাহ নিশ্চিত ও পয়োনিষ্কাশনের ব্যবস্থা করা।
এ-ই যখন অবস্থা, অর্থাৎ নগরবাসীকে সুপেয় পানির ব্যবস্থা নিশ্চিত না করেই আরেক দফা পানির দাম বাড়াতে যাচ্ছে ঢাকা ওয়াসা। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই আবাসিক ও বাণিজ্যিক পর্যায়ে পানির দাম ৫ শতাংশ বাড়ানোর সিদ্ধান্ত হয়েছে। আগামী ১ সেপ্টেম্বর থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর হবে। বর্তমানে আবাসিক গ্রাহকদের ক্ষেত্রে ১ হাজার লিটার পানির দাম ১৫ টাকা ১৮ পয়সা। আর বাণিজ্যিক সংযোগের ক্ষেত্রে ১ হাজার লিটার পানির দাম বর্তমানে ৪২ টাকা। সেপ্টেম্বর থেকে এই দামের সঙ্গে ৫ শতাংশ অতিরিক্ত যুক্ত হবে।
অথচ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞরা বলে আসছেন, দিনে ঢাকা ওয়াসা যত পানি উৎপাদন করে, তার ২০ ভাগ গ্রাহক পর্যন্ত পৌঁছায় না, যা ‘সিস্টেম লস’ (কারিগরি অপচয়) হিসেবে পরিচিত। বর্তমানে ঢাকায় পানির দৈনিক চাহিদা কমবেশি ২৫০ কোটি লিটার। এর বিপরীতে ঢাকা ওয়াসা দৈনিক ২৬০ কোটি লিটার পানি উৎপাদন করার দাবি করে। ওয়াসার তথ্য অনুযায়ী, সিস্টেম লস ২০ শতাংশ বাদ দিলে প্রতিদিন ৫২ কোটি লিটার পানি গ্রাহক পর্যন্ত যায় না। গ্রাহক পান ২০৮ কোটি লিটার। শুধু এ অপচয় কমাতে পারলেই বছর বছর ওয়াসাকে পানির দাম বাড়াতে হতো না। সোয়া ছয় লাখ টাকা বেতনের এমডি আর কবে বিষয়টি বুঝবেন।
২.
নগর উন্নয়নবিশেষজ্ঞ অধ্যাপক নজরুল ইসলামের লেখায় পড়েছি, দেউলিয়া হতে যাওয়া দেশ শ্রীলঙ্কায়ও দিনে তিনবার সরকারিভাবে পানি পরীক্ষা করা হয়। তাই সেবা সংস্থার পানি সরাসরি পান করতে কোনো মুসিবত হওয়ার কথা নয়। ওয়াসার পানি পুরোপুরি পানযোগ্য করতে কী পদক্ষেপ নিতে হবে, তা ওয়াসার এমডি বা এর কর্তৃপক্ষ জানে না, তা নয়। পানিবিশেষজ্ঞ আইনুন নিশাতসহ অনেকেই এ ব্যাপারে বলেছেন। প্রথমে ওয়াসার পাইপলাইনগুলোর সংস্কারকাজ শেষ করতে হবে। কারণ, কিছু লাইন অনেক পুরোনো, ৫০ বছরের ওপরে। দ্বিতীয়ত, পাইপলাইনে উচ্চচাপ বজায় রাখতে হবে। চাহিদার চেয়ে সরবরাহ কম হওয়ায় ঢাকা ওয়াসার পাইপলাইনে পানির চাপ সব সময় থাকে না। উচ্চচাপ না থাকায় পানি মাঝপথে বিষাক্ত হয়ে উঠতে পারে।
আবার অনেকের বাড়ির রিজার্ভ ট্যাংক নিয়মিত পরিষ্কার না করার কারণেও পানি দূষিত হতে পারে, হয়ে থাকে। কিন্তু বাড়ির মালিকদের ওপরে দায় চাপিয়ে ওয়াসা পার পাবে না, কারণ ঢাকার কোন এলাকার পানি কতটা বিশুদ্ধ, নাকি বিশুদ্ধ নয়, তা নিয়মিত পরীক্ষা করার দায়িত্ব ওয়াসার। বিভিন্ন কারণে পানির মান নষ্ট হতে পারে, কিন্তু সে বিষয়ে সচেতনতামূলক প্রচার চালানোও ওয়াসার দায়িত্ব, যা তাদের করতে দেখা যায় না। আর বাড়িওয়ালারা রিজার্ভ ট্যাংক পরিষ্কার না করলে ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তাদের জরিমানা করার দায়িত্বও ওয়াসাকে নিতে হবে। কেউ যদি পানি চুরি করতে ওয়াসার লাইন ফুটো করে দেয়, তা দেখভালও ওয়াসার দায়িত্ব।
বাংলাদেশের গ্যাসসম্পদ সীমিত। সম্ভাবনা থাকার পরেও গ্যাস অনুসন্ধানে জোর নেই। দেশে গ্যাসের মোট মজুত ২৮ টিসিএফ। এর মধ্যে প্রায় ১৯ টিসিএফ উত্তোলন করা হয়েছে। মজুত বাকি আছে আর ৯ টিসিএফ। বছরে প্রায় ১ টিসিএফের মতো উৎপাদন করা হচ্ছে। নতুন গ্যাস যুক্ত না হলে ২০২৫ সালের পর থেকে উৎপাদন অনেক কমে যাবে। তাই অনুসন্ধানের পাশাপাশি সাশ্রয়ী হওয়ার দিকেও মনোযোগ দেওয়া এখন সময়ের দাবি। দেশের অতি জরুরি সম্পদগ্যাস পুড়িয়ে ওয়াসার পানি বিশুদ্ধ করার কোনো মানে থাকতে পারে না।
গতকাল মঙ্গলবার রাতে বিষয়টি নিয়ে কথা হচ্ছিল কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এস এম নাজের হোসাইনের সঙ্গে। তিনিও একমত হলেন যে নাগরিকেরা অর্থ পরিশোধ করে ওয়াসার পানি কিনছে। এ ক্ষেত্রে ওয়াসা নগরবাসীকে পানযোগ্য পানি সরবরাহ করতে বাধ্য। কিন্তু দুঃখজনক হলো, আমাদের দেশে নাগরিকদের অধিকারের বিষয়গুলোয় খুব অবজ্ঞা করা হয়। ওয়াসার পানির ক্ষেত্রেও তা-ই হচ্ছে। নাগরিকদের সচেতনতা ও চাপ সৃষ্টির মাধ্যমেই নিরাপদ ও পানযোগ্য পানি সরবরাহে ওয়াসাকে বাধ্য করতে হবে।
- কাজী আলিম-উজ-জামান প্রথম আলোর উপবার্তা সম্পাদক
ই-মেইল: alim.zaman@prothomalo.com