Site icon The Bangladesh Chronicle

গুলশান-বনানীতে হাতবদলে ‘ময়লার মধু’ এখন বিএনপির কাছে

ময়লা

শুধু বাসাবাড়ি ও রেস্তোরাঁর বর্জ্য সংগ্রহের নামে রাজধানীর প্রতিটি ওয়ার্ডে অর্থ লুটপাটের একটি চক্র গড়ে উঠেছিল বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে। এই চক্রে আওয়ামী লীগের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতা–কর্মীরা ছিলেন। বর্জ্য সংগ্রহ বা ময়লা–বাণিজ্য থেকে সবচেয়ে বেশি টাকা উঠত ঢাকা উত্তর সিটির ১৯ নম্বর ওয়ার্ডে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা হিসেবে পরিচিত গুলশান ও বনানী নিয়ে এই ওয়ার্ড।

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন হওয়ার মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যে গুলশান ও বনানী এলাকার ময়লা–বাণিজ্যে হাতবদল হয়েছে। আওয়ামী লীগের নেতাদের জায়গায় এখন ময়লা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিএনপির স্থানীয় নেতারা। আগে সেখানে ওয়ার্ডে ময়লা সংগ্রহের কাজ করা ৩৮টি প্রতিষ্ঠানের ৩১টিরই মালিক ছিলেন আওয়ামী লীগ এবং এর অঙ্গ ও সহযোগী বিভিন্ন সংগঠনের পদধারী নেতারা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তাঁরা আত্মগোপনে আছেন। গুলশান–বনানীর ময়লা–বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণ করে মাসে তাঁরা তুলতেন অন্তত তিন কোটি টাকা।

প্রথম আলোর অনুসন্ধান, সরেজমিন পর্যবেক্ষণ এবং উত্তর সিটি করপোরেশনের বর্জ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গুলশান-বনানীর ময়লা–বাণিজ্যের মূল নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির সাবেক জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল আলীম নকী। তিনি অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ড কমিশনার (কাউন্সিলর) ছিলেন। তাঁর অধীন বনানীতে (১-২৮ নম্বর সড়ক) ময়লা সংগ্রহের কাজের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে ১৯ নম্বর ওয়ার্ড বিএনপির সভাপতি আবদুল মমিনকে। তাঁর সঙ্গে আছেন বনানী থানা যুবদলের আহ্বায়ক শাহজাহান সরকার।

■ গুলশান–বনানী এলাকায় ময়লা সংগ্রহকারী ৩১টি প্রতিষ্ঠানের মালিক ছিলেন আ.লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতারা।

■ সরকারের পতনের পর গুলশান-বনানীর ময়লা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন ঢাকা মহানগর উত্তর বিএনপির কিছু নেতা–কর্মী।

অন্যদিকে গুলশান–১ ও ২ নম্বরের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে যুবদলের স্থানীয় নেতা হিসেবে পরিচিত মোহাম্মদ আনোয়ার ওরফে দাদা আনোয়ারকে। তাঁর সঙ্গে আছেন গুলশান থানা যুবদলের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম আহ্বায়ক আবদুল জলিল। আবার জলিলের সঙ্গে কাজ করছেন যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মোহাম্মদ স্বপন ও লিটন (স্থানীয়ভাবে পান লিটন নামে পরিচিত)।

গুলশান ও বনানীতে আগে ময়লা সংগ্রহের কাজ করত এমন সাতটি প্রতিষ্ঠানের (ময়লা সংগ্রহে ভ্যান সরবরাহ করা) মালিকের সঙ্গে গত সপ্তাহে কথা বলেছে প্রথম আলো। তবে ভয়ে তাঁদের কেউ নাম–পরিচয় উল্লেখ করে কোনো মন্তব্য করতে চাননি। শুধু এটুকু বলেছেন, ৫ আগস্টের পর তাঁদের ভ্যানকর্মীরা বিভিন্ন এলাকা থেকে ময়লা সংগ্রহ করতে গেলে বিএনপির ওই নেতারা বাধা দিয়েছেন। তাঁদের ভ্যানগুলোও ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছে। এসব ভ্যান দিয়েই ময়লা সংগ্রহের কাজ চলছে বিএনপি নেতাদের তত্ত্বাবধানে।

গুলশান–বনানীর ময়লা–বাণিজ্য নিয়ে ২০২১ সালের ২০ মার্চ প্রথম আলোর প্রথম পাতায় ‘ময়লা–বাণিজ্যে এক ওয়ার্ডেই আওয়ামী লীগের ৩১ নেতা’ শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়।

সুপারভাইজারদের হুমকি

সাধারণত মাসের ৪-৫ তারিখ থেকে বাসাবাড়ির ময়লা সংগ্রহের বিল ওঠানো শুরু হয়। তবে ৫ আগস্টের পর ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠানগুলোর সুপারভাইজাররা টাকা তুলতে গেলে তাঁদের মারধর করার অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া কয়েকজন সুপারভাইজারকে ডেকে টাকা তুলতে নিষেধ করা হয়েছে। অনেক এলাকায় বাসাবাড়িতে গিয়ে আগের সুপারভাইজারদের টাকা দিতে মানা করার তথ্যও পাওয়া গেছে।

বনানী থেকে বর্জ্য সংগ্রহের কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক (আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা) নাম না প্রকাশের শর্তে ১৪ আগস্ট প্রথম আলোকে বলেন, সুপারভাইজার বিল তুলতে গিয়েছিলেন। তাঁকে মারধর করে হুমকি দেওয়া হয়েছে, আর যেন বিল তুলতে না যান। এমনকি মামলা করারও হুমকি দেওয়া হয়েছে।

গুলশান-২ নম্বর এলাকায় একই কাজ করা একটি প্রতিষ্ঠানের মালিক বলেন, ‘৭ আগস্ট পর্যন্ত আমার লোকেরা কাজ করেছে। কিন্তু পরের দিন কাজ করতে গেলে বাধা দেওয়া হয়। যাঁরা বাধা দিয়েছেন, তাঁরা বিএনপির নেতা দাদা আনোয়ারের নাম বলে গেছেন। সেদিনের পর থেকে আমার লোকেরা ভয়ে আর কাজ করতে যায় না।’

ময়লা–বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে আবদুল আলীম নকী মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি যখন কাউন্সিলর ছিলাম, তখন যাঁদের অনুমতি দিয়েছিলাম, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পরদিনই তাঁদের পিটিয়ে রক্তাক্ত করে ভ্যানগাড়িসহ কাজ নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। বাস্তবতা হচ্ছে, আওয়ামী লীগের আগে যাঁরা কাজটি করতেন, তাঁরাই এখন দখলে নিয়েছেন। এতে আমার কোনো ভূমিকা নেই। কাউকে জায়গায় দাঁড়িয়ে থেকে দখল করে দিয়েছি, বুঝিয়ে দিয়েছি, এমন কোনো ঘটনা আমি করিনি।’

গুলশান ও বনানীতে ময়লা–বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়েছেন বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত মমিন, শাহজাহান, দাদা আনোয়ার, জলিল, স্বপন ও পান লিটন। তাঁদের সম্পর্কে আবদুল আলীম বলেন, ‘আমি এদের সবাইকে চিনি। অস্বীকার করছি না। এরা থাকতে পারে। করতেও পারে।’

এক ওয়ার্ডেই মাসে ৩ কোটি টাকার বেশি আয়

ঢাকা উত্তর সিটির রাজস্ব বিভাগের হিসাবে, গুলশানে প্রায় ১১ হাজার ১০৭টি হোল্ডিং আর বনানীতে প্রায় ৬ হাজার ৫০টি হোল্ডিং রয়েছে। সব মিলিয়ে ১৭ হাজার ১৫৭টি হোল্ডিং আছে। একেকটি হোল্ডিংয়ে গড়ে ছয়টি ফ্ল্যাট ধরে প্রায় ১ লাখ ২ হাজার ৯৪২টি ফ্ল্যাট আছে। ফ্ল্যাটপ্রতি গড়ে ৩০০ টাকা হিসাবে মাসে ময়লার বিল আসে ৩ কোটি ৮ লাখ ৮২ হাজার ৬০০ টাকা।

যদিও ২০২৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ঢাকা উত্তর সিটি কর্তৃপক্ষ বাসাবাড়িতে ময়লার বিল কত হবে এ–সংক্রান্ত একটি নীতিমালা করেছিল। তখন বলা হয়েছিল, ময়লার বিল হবে বাসাপ্রতি সর্বোচ্চ ১০০ টাকা। এ ছাড়া বাসাবাড়ির বর্জ্য সংগ্রহের (প্রতিটি ওয়ার্ডের জন্য) কাজ পেতে হলে ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠানকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে নিবন্ধিত হওয়ার বিষয়টি ওই নীতিমালায় উল্লেখ ছিল। এতে আরও বলা হয়েছিল, প্রতি ওয়ার্ডে দরপত্রের মাধ্যমে কাজ পাবে একটি প্রতিষ্ঠান। সেই প্রতিষ্ঠানকে বার্ষিক ২০ লাখ টাকা করপোরেশনকে দিতে হবে। কিন্তু পরে এসব নীতিমালার কোনোটিই আর কার্যকর করা যায়নি।

তবে ফ্ল্যাটের ময়লার বিলের চেয়ে রেস্তোরাঁর বিল বহুগুণে বেশি হয়। গুলশান ও বনানীর রেস্তোরাঁমালিকেরা বলছেন, তাঁদের কাছ থেকে চার থেকে আট হাজার টাকা পর্যন্ত ময়লার বিল নেওয়া হয়। বাংলাদেশ হোটেল-রেস্তোরাঁ ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের হিসাবে, গুলশান–বনানীতে শতাধিক রেস্তোরাঁ আছে। গড়ে ৪ হাজার টাকা ধরে ১০০টি রেস্তোরাঁ থেকে মাসে ৪ লাখ টাকা বিল ওঠে।

জানতে চাইলে উত্তর সিটির প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা ক্যাপ্টেন মোহাম্মদ ফিদা হাসান প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি ওয়ার্ডে বর্জ্য সংগ্রহের কাজটি সুষ্ঠুভাবে করার জন্য ভ্যান সার্ভিস প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দিতে নতুনভাবে একটি নীতিমালা বা টার্মস অব রেফারেন্স তৈরি করা হয়েছে। এটি চূড়ান্ত অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।

ঢাকা উত্তর সিটিতে ওয়ার্ড আছে ৫৪টি। গুলশান-বনানীর মতোই ঢাকা উত্তরের অন্য এলাকাতেও ময়লা-বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ হাতবদল হতে শুরু করেছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। একই পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে ঢাকা দক্ষিণ সিটির ৭৫টি ওয়ার্ডেও।

নাম না প্রকাশ করার শর্তে দক্ষিণ সিটির তিনজন কাউন্সিলর প্রথম আলোকে বলেন, বিএনপির লোকজন যোগাযোগ করছেন। তাঁদের কাছে হয়তো কাজ ছেড়ে দিতে হবে।

প্রথম আলো

Exit mobile version