Site icon The Bangladesh Chronicle

‘গুজরাটের গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদীর আগমন রুখে দাঁড়াও’। ফরহাদ মজহার

‘গুজরাটের গণহত্যাকারী ফ্যাসিস্ট নরেন্দ্র মোদীর আগমন রুখে দাঁড়াও’। আলবৎ। আমি অবশ্যই সমর্থন করি। ‘প্রগতিশীল’ হোক বা না হোক ভারতীয় আগ্রাসন এবং ফ্যাসিবাদ রুখে দেবার জন্য যারাই লড়ছেন তাঁদের প্রতি পূর্ণ সংহতি।
কিন্তু যে প্রসঙ্গ তুলতে চাইছি সেটা হোল ফ্যাসিবাদ এবং ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে লড়তে হলে প্রথম কাজ হচ্ছে যথাসম্ভব সকল ফ্যাসিবাদ বিরোধী সংগঠন ও শক্তির সন্নিবেশ ঘটানো।
দর্শন এবং রাজনৈতিক চিন্তাচেতনার দিক থেকে আমরা এমন একটা কাল পর্বে প্রবেশ করেছি যেখানে আধুনিক/অনাধুনিক, প্রগতিশীল/পশ্চাতপদ ইত্যাদি বাইনারি নির্ভর থার্ডক্লাস প্রাচীন চিন্তা অজ্ঞতা ও রাজনৈতিক অসচেতনতার লক্ষণ হিশাবে বিবেচিত। পুরানা বামপন্থী ও বাতিল চিন্তার ধারাবাহিকতা। তাছাড়া ইউরোপের বাইরে আর সকল দেশকে হতে হবে ইউরোপের মতো, ইতিহাস হবে খ্রিস্টিয় ইউরোপের আর ইউরোপের সঙ্গে না মিললে প্রতিক্রিয়াশীল — এইসব বাজে কলোনিয়াল ও সাম্রাজ্যবাদী চিন্তা। অতিশয় অলস মন ও মানসিকতারও লক্ষণ, যারা আলস্যবশত সম্প্রতিকালে বিপ্লবী চিন্তা বা তর্কবিতর্কের খোঁজ রাখে না। খোঁজখবর নেয় না।
এই দুর্বলতা তরুণদের কাটিয়ে উঠতে হবে। কারন আজ যারা মাঠে এই শ্লোগান দিচ্ছে, আগামি দিনে তারাই এই দেশের হাল ধরবে।
এখনকার লড়াই যারা স্বঘোষিত ‘প্রগতিশীল’ শুধু তাদের লড়াই না, বরং বাংলাদেশের জনগণের বাঁচামরার লড়াই। তাই ভবিষ্যতের রাজনীতির যারা নেতা তারা বাংলাদেশের ‘প্রগতিশীল’ জনগণের হয়ে নয়, বরং সকলের হয়ে কথা বলতে হবে। এতোকাল যাদের ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ ট্যাগ মেরে রাজনৈতিক পরিসর থেকে বাইরে রাখা হয়েছে, তাদের বাদ দিলে চলবে না। ফ্যাসিস্ট ছাড়া এখন সবার পক্ষে কথা বলতে শিখতে হবে।
না। নিজের মতাদর্শ বাদ দেবার কথা বলছি না, সেটা নীতির প্রশ্ন। কিন্তু নিজের মতাদর্শ যদি সকলের মুক্তির কথা বলতে ব্যর্থ হয়, তাহলে মতাদর্শিক ঝাণ্ডা যে বিভক্তি তৈরি করে তা ফ্যসিবাদ ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে পোক্ত করে। বিভাজন নয়, ফ্যাসিস্ট ও ফ্যা্সিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে গণঐক্য তৈরির ভাষায় কথা বলতে হবে। নীতি এবং কৌশলের মধ্যে সমন্বয় থাকতে হবে। মতাদর্শিক সংকীর্ণতা বাদ দিয়ে ফ্যাসিবাদ, হিন্দুত্ববাদ, ভারতীয় আগ্রাসন ও বাংলাদেশের ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র ব্যবস্থার বিরুদ্ধে ব্যাপক গণঐক্য গড়ে তোলার রণধ্বণি তুলতে হবে। এটাই এখন প্রধান কাজ। যারা সক্ষম হবে তাদের মতাদর্শিক আধিপত্যই সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে।
সমাজে অন্যান্য রাজনৈতিক ধারার সঙ্গে তথাকথিত ‘প্রগতিশীল’ ধারার মতাদর্শিক বিরোধ থাকতেই পারে, আছেও বটে। কিন্তু মোদীকে ঠেকানো কিম্বা ফ্যাসিবাদ মোকাবিলায় অন্যদের সঙ্গে এক সঙ্গে কিম্বা সমান্তরালে ইস্যুভিত্তিক আন্দোলনের সম্ভাবনা জারি রাখা এখন খুবই জরুরী কাজ। নিজেদের স্বঘোষিত ‘প্রগতিশীল’ দাবি করলে সমাজে মতাদর্শিক বিভাজনকেই বড় করে তোলা হয় এবং বর্তমানের সুনির্ধিষ্ট রাজনৈতিক কর্তব্যকে অস্বীকার করা হয়।
তাহলে কি করা উচিত ছিল? খুব ভাল হোত যদি ব্যানার হোত ‘ফ্যাসিবাদ ও ভারতীয় আগ্রাসন বিরোধী ছাত্র সংগঠন সমূহ’।
মতাদর্শিক এবং রাজনৈতিক কৌশলগত দিক ছাড়াও যে কারনে কথা তুলছি তা হোল মাঠে যারা লড়ছে তাদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা জরুরী। ব্যাপক ও বিস্তৃত গণঐক্য গড়ে তোলা না গেলে মাঠের লড়াকু তরুণদের জীবন আমরা ঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিচ্ছি। নিজেদের খামাখা প্রাচীন বাইনারির ভাষায় ‘প্রগতিশীল’ দাবি করার অর্থ বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের সমর্থন থেকে আগাম বঞ্চিত করা। কারন এই দেশের জনগণ তথাকথিত প্রগতিবাদী এবং বামপন্থীদের বিশ্বাস করে না। দিল্লির স্থানীয় বরকন্দাজ মনে করে। কেন করে তার দীর্ঘ ইতিহাস আছে। নিজেদের ‘প্রগতিশীল’ দাবি করে আমরা নিজেদের অজান্তে জনগণের আশংকাই প্রতিষ্ঠিত করি।
মোদী গুজরাটের গণহত্যাকারী শুধু নয়, উপমহাদেশে হিন্দুত্ববাদের নেতা এবং আন্তর্জাতিক কর্পোরেট পুঁজির স্বার্থ রক্ষাকারী প্রধান রাজনৈতিক শক্তি। একে মোকাবিলা করা কঠিন। এ লড়াই দীর্ঘ লড়াই। এর তেজ ও উত্তাপ বাংলাদেশের জাতীয় কিম্বা রাষ্ট্রীর সীমার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে না। গরম দুধ উপচে পড়ার মতো হাঁড়ি ঠেলে সারা উপমহাদেশে ছড়িয়ে পড়বে। বাংলাদেশ ভূ-রাজনৈতিক ভাবে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। হাল্কা চালে কোন কিছু অর্জন অসম্ভব।
মনে রাখতে হবে হিন্দুত্ববাদের সঙ্গে হিন্দু ধর্মের কোন সম্পর্ক নাই, এটা আধুনিক জাতিবাদের একটা ঐতিহাসিক ধরণ যেখানে হিন্দু ‘পরিচয়’ বানানো হয়েছে তত্থাকথিত ‘বহিরাগত’দের বিপরীতে — বিশেষ ভাবে ইসলাম ও মুসলমানদের উপমহাদেশ থেকে নির্মূল করবার রাজনীতি হিশাবে। আধুনিক জাতিবাদী হিন্দুত্ববাদ ইলেক্ট্রনিক ও ডিজিটাল টেকনলজির যুগে সহজে আদিবাসী, গরিব ও দরিদ্র হিন্দুদের আবেগকে কাজে লাগাতে পারছে। এটাও মনে রাখতে হবে বাংলাদেশে কয়েক কোটি লোক মরে গেলেও পাশ্চাত্য শুধু নানান মানবাধিকার লংঘনের কেচ্ছা গাইবে। কিন্তু কিছুই করবে না।
অমিত শাহ বলেছে বাংলাদেশের জনগণ ‘উইপোকা’। ইসলামি আতংকে নিত্য ডায়রিয়ায় ভোগা পাশ্চাত্যের চোখে বাংলাদেশের জনগণও ‘উইপোকা’র অধিক কিছু না। নিজেদের ভবিষ্যৎ দেখতে চাইলে মধ্যপ্রাচ্যের দিকে তাকান।
বাংলাদেশে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির একটি শক্তিশালী ধারা আছে যারা মনে করে ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের বিলীন হওয়া স্রেফ সময়ের ব্যাপার মাত্র। হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির সারমর্ম হচ্ছে উপমহাদেশ থেকে ইসলাম নির্মূল করা। মুসলমানদের আবার ঘরে ফিরতে হবে, অর্থাৎ ইসলাম ত্যাগ করতে হবে। উপমহাদেশ থেকে মুসলমান নির্মূল কিম্বা বিতাড়িত হবার প্রক্রিয়ায় তারাও বিতাড়িত হবে।
হিন্দুত্ববাদ, ভারতীয় আগ্রাসন ও ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র শক্তির বিরুদ্ধে লড়তে হলে এই লড়াইয়ে বাংলাদেশে যাদের এতোকাল ‘প্রতিক্রিয়াশীল’ বলা হয়েছে তাদের বাদ দিয়ে কিছু করা যাবে না।
তাই ‘প্রগতিশীল/প্রতিক্রিয়াশীল’ বাইনারি বা ফ্যাতনা বাদ দিন। হুঁশে আসুন।
চলুন এক সঙ্গে লড়ি।
Exit mobile version