গুজব না গজব : নাকি আত্ম অহঙ্কারের প্রতিফলন?
- তৈমূর আলম খন্দকার ০৯ আগস্ট ২০১৯, ২০:৩৮
‘গুজব’ এবং ‘গজব’ দু’টি শব্দের মধ্যে আক্ষরিক অর্থে শুধুমাত্র (y) দিয়েই বিভক্ত করা হয়, কিন্তু শাব্দিক অর্থে অনেক তারতম্য। তবে দু’টি শব্দই জনস্বার্থের পরিপন্থী। গুজব মানুষ সৃষ্টি করে, গজব আসে প্রকৃতি থেকে। বিভিন্নভাবে গুজবের আবির্ভাব ঘটে। যার পেছনে শুধু গোষ্ঠীগত স্বার্থ আর স্বার্থ কাজ করে। অনেক সময় জটিল পরিস্থিতি মোকাবেলা করার জন্য রাষ্ট্রযন্ত্র থেকেও গুজব রটানো হয়, প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধসহ যুগে যুগে বিভিন্ন পারিপার্শ্বিক ঘটনা/রটনা এর সাক্ষ্য দেয়। গুজব থেকে সাবধান বা গুজব ছড়াবেন না বা গুজব ছড়ালে কঠিন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে, এমন বাক্য রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে আগেও বলা হতো এবং এখনো তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। তবে গুজব একটি মারণাস্ত্রের চেয়ে মারাত্মক ঝুঁকিপূর্ণ অস্ত্র, যা দিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের উপকারে হয়তো এসেছে, কিন্তু বিপর্যস্থ হয়েছে গণমানুষ। গুজব ছড়ানো বা ছড়ানোর কাজে সহযোগিতা করাও জনস্বার্থবিরোধী।
‘গজব’ শব্দটিও বহুপ্রচারিত ও প্রচলিত। মসজিদে বা কোনো দোয়ার মাহফিলে প্রতিনিয়ত গজব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করা হয়। ধর্ম গ্রন্থে সৃষ্টিকর্তা নিজেও স্বীকার করে বলেন, তার (সৃষ্টিকর্তা) দেয়া গজবে অনেক জাতি ধ্বংস হয়েছে।
‘গজব’ প্রকৃতিগত। ধর্মগ্রন্থের মর্মবাণী মোতাবেক মানুষ যখন সীমালঙ্ঘন করে তখনই প্রকৃতি প্রতিশোধ নেয় এবং এ প্রতিশোধ নেয়ার জন্য প্রকৃতির ইচ্ছাই যথেষ্ট। মানুষকে সতর্ক করার জন্য ‘সীমালঙ্ঘন’ সম্পর্কে ধর্মগ্রন্থে বিস্তারিত তথ্য দেয়া আছে, তারপরও সীমালঙ্ঘন হচ্ছে অব্যাহতভাবে। রাজ্য শাসনে শাসকদলের জবাবদিহি অনেক। জবাবদিহির পরিবর্তে যদি জনগণকে জিম্মি করে শাসকের সব ইচ্ছার বাস্তবায়ন হয়, সেখানেই জবাবদিহি বাধাগ্রস্ত হয়। শাসকদল আত্মপ্রশংসায় মগ্ন থাকার কারণে সীমালঙ্ঘনের বিষয়টি তাদের থার্মোমিটারে ধরা পড়ে না, আর যখন ধরা পড়ে তখন সময় গড়িয়ে যায়। ‘সীমালঙ্ঘন’ সামাজিক ও ধর্মীয় স্বীকৃত মতে, অগ্রহণযোগ্য এবং এ কারণেই পৃথিবীর ইতিহাসে অনেক বিপর্জয় ঘটেছে। সীমালঙ্ঘন বলতে কী বুঝায়? তত্ত্ব আলোচনায় না গেলেও মোটা দাগে বলতে হয়, শপথ ভঙ্গ করা বা ওয়াদা বরখেলাপ একটি স্পষ্ট সীমালঙ্ঘন। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে মিথ্যাচারও শপথভঙ্গের পর্যায়ভুক্ত। মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করার প্রচার গুজবেরই একটি নামান্তর, তারপরও বিষয়টি চলছে বিনাদ্বিধায় বা বিনা বাধায়।
জনগণ যখন ছাপোষা একটি প্রাণী হিসেবে ব্যবহৃত হয়, তখন মিথ্যার প্রতিবাদ করার জন্য মেরুদণ্ড আর সোজা রাখতে পারে না। মেরুদণ্ড সোজা রাখার জন্য যে সাহসী নেতৃত্ব প্রয়োজন, তার অভাবটাও এখানে একটি অন্যতম কারণ। সৎ সাহস এবং শক্ত বিবেকসম্পন্ন একটি মানুষ নিজে অন্যায় করবে না এবং কোনো অন্যায় কাজ কারো ওপর চাপিয়ে দেবে না, অন্য দিকে যেকোনো অন্যায় শত্রু-মিত্র যার ওপরই হোক না কেন জুলুম-নির্যাতনের প্রতিবাদে পাথর ও পাহাড়ের মতো দৃঢ়ভাবে প্রতিবাদ-প্রতিরোধ করে যাবে, এমন ব্যক্তিকেই গণমানুষ নেতা হিসেবে খোঁজ করে। কিন্তু নেতার মঞ্চের বক্তব্য ও ব্যক্তি চরিত্রের সাথে যখন গরমিল দেখা দেয়, তখনই গণমানুষ আর আস্থা রাখাতে পারে না। তখন থেকেই শুরু হয় নেতৃত্বের বিপর্যয়।
একটি রাষ্ট্রের জনমানুষ যদি গুম, খুন, ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ, সিঁধেল চুরি থেকে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে চুরির ভিকটিম হয় তখন ভারসাম্য রক্ষার্থে প্রকৃতিকে এগিয়ে আসা ছাড়া অন্য কোনো রাস্তা খোলা থাকে না বলেই ‘প্রকৃতি’কে এগিয়ে আসতে হয়। পিতার হাতে পুত্র খুন, পুত্রের হাতে পিতা খুন, মায়ের হাতে শিশুসন্তান খুন, সন্তানের হাতে মা খুন, প্রেমিকার হাতে প্রেমিক খুন, প্রেমিক কর্তৃক প্রেমিকা খুন, শিক্ষকের হাতে সিরিজ আকারে ছাত্রী ধর্ষণ, বিশেষ করে ধর্মীয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্তৃক ছাত্রী ধর্ষণ, শিশু ধর্ষণ করে হত্যাÑ এরপরও যদি ‘প্রকৃতি’ নীরব-নিস্তব্ধ হয়ে যায়, তবে তা নিরীহ-নিপীড়িত মানুষের আস্থা রাখার কোনো জায়গা থাকে না। তাই ভূপেন হাজারিকাকেও আক্ষেপ করে গাইতে হয়েছে (এত অত্যাচার-নিপীড়ন সহ্য করে) ‘ও গঙ্গা তুমি বইছো কেন?’ তবে ‘প্রকৃতি’র ক্ষেত্রবিশেষে কাউকে ক্ষমা করতে জানে না, যদিও তার দয়াতেই পৃথিবী ও সভ্যতার সৃষ্টি।
মশা একটি ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র প্রাণী। একটি লেংড়া অর্থাৎ বিকলাঙ্গ মশা দিয়ে তৎকালীন সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ স্বৈরাচারকে ধ্বংস করার ইতিহাস জানার পরও ডেঙ্গু নামক মশাকে ছোট করে দেখার কোনো কারণ নেই। ডেঙ্গু সমাধানে সিটি করপোরেশন তথা সরকার ব্যর্থ, কিন্তু এ ব্যর্থতার দায় প্রতিপক্ষের নিকট চাপানোই এর সমাধান নয়, বরং জনগণের নিকট হাস্যস্পদে পরিণত হতে হয়। প্রতিদিন হাসপাতাল থেকে বলা হচ্ছে রোগী ভর্তি হওয়ার জায়গা নেই, বলা হচ্ছে তিনটি জেলা বাদে দেশের সব জেলাতেই ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। এ অবস্থায়, ডেঙ্গু মশা যেন আমাদের ধ্বংসের কারণ হয়ে না দাঁড়ায় এ জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা করতে হবে। পাশাপাশি সবধরনের পাপাচার থেকে মুক্ত থাকার ওয়াদা করে পরম করুণাময় সৃষ্টিকর্তার কাছে তাওবা করার এখনই সময়। বিশেষ করে যারা শপথ করে সাংবিধানিক দায়িত্বে আসন গ্রহণ করে জনগণের অধিকার সংরক্ষণ না করে বরং মিথ্যাচার দিয়ে মিথ্যাকে সত্যে পরিণত করেছেন, তাদেরও তাওবা করা অত্যন্ত জরুরি। ভবিষ্যতে শপথপূর্বক জনগণের অধিকার সংরক্ষণে সাংবিধানিক পদে যারা অধিষ্ঠিত হবেন, এ তাওবা যেন তাদের যাত্রাপথের পাথেয় হয়ে থাকে।
বহুল প্রচারিত জাতীয় পত্রিকা বলেছে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা নিয়ে লুকোচুরি হচ্ছে। চক্ষু বন্ধ করে রাখলে তো আর প্রলয় বন্ধ হবে না। সমাধান খুঁজতে হবে। রাষ্ট্র বা সরকারের নিকট মেয়র একটি ক্ষুদ্রাতি ক্ষুদ্র বিষয়। কিন্তু মেয়রদের হামবড়া ভাব দেখে মনে হচ্ছিল, তাদের হাঁকডাকেই ডেঙ্গু মশা ঢাকা থেকে পালাবে। কিন্তু কার্যত এটাই প্রমাণিত হলো, মশার ওষুধ আমদানি করা হয়েছে তার মানসম্মত নয় বা এর কোনো কার্যকারিতা নেই। এখন সব কিছুতেই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করা হচ্ছে। পৃথিবীর অন্যান্য রাষ্ট্র বিশেষ করে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্রে কোনো সঙ্কট মোকাবেলার জন্য সর্বদলীয় সভা ডাকা হয় এবং সবার পরামর্শ পরিস্থিতি মোকাবেলায় জাতিগত শক্তি সঞ্চয় করে। কিন্তু এ ধরনের কোনো পরামর্শ সভা করতে সরকার নারাজ, যেমনটি করা হয়নি রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান কল্পে। ফলে রোহিঙ্গা সমস্যা জাতিগতভাবে আরো প্রকট আকারে দেখা দিচ্ছে। রোহিঙ্গারা নিজেরাও সীমাহীন কষ্টে দিন কাটাচ্ছে। তারা নিজের দেশে যেতে পারছে না, অন্য দিকে বাংলাদেশ থেকেও অন্য কোনো রাষ্ট্রে যাওয়ার সব পথও তাদের জন্য বন্ধ রয়েছে। ফলে সমুদ্রে ডুবে যাওয়াটাই যেন তাদের সামনে একটি খোলা পথ। ফলে কাজের সন্ধানে রোহিঙ্গাদের কাঠের নৌকায় সমুদ্র অতিক্রম করতে যেয়ে জেনেশুনে সলিল সমাধির জন্য বিশ্বসভ্যতার বুক কাঁপে না। এটাও একটি গজবের নামান্তর।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী (অ্যাপিলেট ডিভিশন)
taimuralamkhandaker@gmail.com