গত ১৫ই জানুয়ারি কালিগঞ্জের রতনপুর ইউপি’র কাশিশ্বরপুর গ্রামের শওকাত আলী গাজীর বাড়িতে ডাকাতির অভিযোগে একটি মামলা হয়। ওই মামলায় উপজেলা কৃষক দলের চার নেতাকে আসামি করা হয়। অথচ আগে থেকেই তারা পালিয়ে বেড়াচ্ছিলেন। ঘটনা সম্পর্কে তারা কেউই জড়িত ছিলেন না।
মামলার এজাহারে বলা হয়েছে, গত ১৫ই জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে বাড়ির কলাপসিবল গেট বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ি। রাত ১টার দিকে অজ্ঞাত ৪ জন গেটের তালা ভেঙে ঘরে প্রবেশ করে। আমাকে মারধর করে এবং পরিবারের সবাইকে এক রুমে আটকে রাখে। বিভিন্ন রুমে ঢুকে ট্রাঙ্কের তালা ভেঙে নগদ ৫০ লাখ ৪০ হাজার টাকা ও ২৩ ভরি স্বর্ণালংকার লুটে নেয়। সবার পরনে বিভিন্ন রঙের জ্যাকেট ছিল এবং সবার বয়স ২৫-৩০এর মধ্যে। যাওয়ার সময় ডাকাতরা রুমের বাইরে থেকে তালাবদ্ধ করে যায়। ডাকাতরা চলে যাওয়ার পর চিৎকার দিলে প্রতিবেশীরা তালা খুলে দেয়। মামলার এজাহারে ৪ জনকে আসামি করা হয়েছে। তারা হলেন- আরিফুর রহমান ছোটন (৩৪), মো. কামরুল ইসলাম ওরফে কামরুজ্জামান (৩৩), মো. সবুজ হোসেন (২৫), মো. শরিফুল ইসলাম (২৫)। তাদের সবার বাড়ি কালিগঞ্জে।
প্রতিবেশী রমিজ মানবজমিনকে বলেন, পাশাপাশি বাড়ি হলেও ওইদিন রাতে আমরা টের পাইনি। তবে পরদিন সকালে জানতে পারি- ওই বাড়িতে ডাকাতি হয়েছে। ঘটনাস্থলে যাওয়ার পর বাড়ির মালিক শওকাত গাজী বলেন, রাতে ডাকাতির ঘটনা ঘটলেও তিনি কাউকে চিনতে পারেননি। তবে ডাকাতদের শারীরিক গঠন দেখে বুঝতে পারেন- তারা অন্য এলাকার। কিন্তু বিএনপি করার কারণে মামলার আসামির তালিকায় প্রতিবেশী ৪ জনের নাম ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে।
এদিকে মামলার বাদী শওকাত গাজীর একটি অডিও রেকর্ড মানবজমিনের কাছে এসেছে। অডিও রেকর্ডে শোনা যায়, মামলার দুই আসামির মা শওকাত গাজীর কাছে গিয়ে ডাকাতি মামলায় ছেলেদের আসামি করার কারণ জানতে চান। এ সময় শওকাত গাজী তাদের বলেন, আমি এ ব্যাপারে কিছুই জানি না। আমার কাছে আওয়ামী লীগের লোকজন এসে একটি সাদা কাগজে সই করে নিয়ে গেছে। ওরা কাদের আসামি করেছে।
বিষয়টি জানতে শওকাত গাজীকে ফোন দিলে রিসিভ করেন তার ছেলে মনির। তিনি মানবজমিনকে বলেন, ঘটনার দিন আমি ঢাকায় ছিলাম। খবর পেয়ে বাড়িতে যাই। বাদী আমার বাবা হলেও মূলত মামলার সবকিছু করেছি আমি। আমার বাবা বয়স্ক মানুষ, তিনি কিছুই জানেন না। ঘটনার সময় ডাকাতদের চিনতে না পারলেও বিএনপি নেতা ৪ জনকে আসামি করার কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, তারা আগে এলাকায় ডাকাতি করেছে। সেজন্য তাদের আসামি করা হয়েছে।
মামলার সাক্ষী আফজাল মানবজমিনকে বলেন, ঘটনার সময় আমরা কিছুই টের পাইনি। সকালে গিয়ে বাড়ির তালা ভাঙাও দেখতে পাইনি। সাক্ষী হওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, ঘটনার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় তারা আমাকে সাক্ষী করেছে।
মামলায় দুই নম্বর আসামি করা হয়েছে কালিগঞ্জ কৃষক দলের সিনিয়র যুগ্ম আহ্বায়ক মো. কামরুজ্জামানকে। তিনি অভিযোগ করেন, ১৭ই জানুয়ারি জানতে পারি- আমার নামে ডাকাতির মামলা হয়েছে। অথচ ঘটনার সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। যাদের আসামি করা হয়েছে সবাই বিএনপিা রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা হয়রানি করার জন্য আমাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে আসামি করেছে। তাই গ্রেপ্তার এড়াতে ঢাকায় চলে এসেছি। উচ্চ আদালত থেকে জামিন নেয়ার চেষ্টা করছি। বিএনপি’র সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী গত ২৫শে জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলনে এ ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তিনি বলেন, কালিগঞ্জ কৃষক দলের ৪ জনের বিরুদ্ধে ডাকাতির মিথ্যা মামলা করা হয়েছে। অবিলম্বে মিথ্যা মামলা প্রত্যাহারের দাবি জানান তিনি।
মামলাটির তদন্ত কর্মকর্তা প্রদীপ কুমার সানা মানবজমিনকে বলেন, এ ঘটনায় দুজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে তারা ডাকাতির সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করেননি। এছাড়া কোনো মালামালও উদ্ধার হয়নি। আমাদের তদন্ত চলছে।
বাড়িছাড়া বিএনপি নেতারা: এদিকে নির্বাচনের পর কালীগঞ্জের বিএনপি নেতাকর্মীদের নানাভাবে হয়রানি করছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরা। উপজেলা কৃষক দলের যুগ্ম আহ্বায়ক আবুল হোসেন জাতীয় নির্বাচনে ভোট না দেয়ায় মারধর করা হয়েছে। উপজেলা কৃষক দলের আহ্বায়ক সদস্য মো. সিদ্দিকুর রহমানকে না পেয়ে তার ১৫ বছরের ছেলে ও স্ত্রীকে বেধড়ক পিটিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। পরে তার ছেলে আরিফকে থানা পুলিশে সোপর্দ করা হয়। বিষ্ণুপুর ইউনিয়নের বাঁশতলা বাজারে বিএনপি কর্মী মোকসেদ মীর ও জিল্লুর রহমানের দোকান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। কালিগঞ্জ উপজেলা জাসাসের সাবেক আহ্বায়ক মো. মুরশিদ আলী গাজী, কুশুলিয়া ইউনিয়ন স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক কাজী শরিফুল ইসলাম ও ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক কবিরুল ইসলামের বাড়িতে গিয়ে হুমকি দিয়েছে। কৃষ্ণনগর ইউনিয়ন যুবদলের যুগ্ম আহ্বায়ক তুহিনের জমি দখল করে নিয়েছে স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা। এ ছাড়াও পুলিশ ও স্থানীয় আওয়ামী লীগের ভয়ে বিএনপি, যুবদল, স্বেচ্ছাসেবক দল, ছাত্রদলসহ অন্যান্য অঙ্গ সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। অপরদিকে তাদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় তাদের পরিবারের লোকজন মানবেতর জীবন-যাপন করছেন।
সাতক্ষীরা-৪ আসনের সাবেক এমপি ও বিএনপির নির্বাহী কমিটির সদস্য কাজী আলাউদ্দীন বলেন, ২৯শে অক্টোবর থেকে ৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত আমার এলাকায় ব্যাপক আন্দোলন হওয়ায় প্রায় প্রতিদিনই নেতাকর্মীদের বাড়িতে অভিযান চালাচ্ছে পুলিশ। দায়ের হচ্ছে একের পর এক মিথ্যা গায়েবি মামলা। গত ৫ই জানুয়ারি আমিসহ বিএনপির ১১ জন নেতাকে আসামি করে মামলা দায়ের করেছে পুলিশ। আওয়ামী লীগ ও পুলিশের হয়রানির কারণে এলাকা ছেড়ে ঢাকায় পালিয়ে বেড়াচ্ছি।
সূত্র : মানবজমিন