Site icon The Bangladesh Chronicle

গাজায় ঝলমলে রমজান মাস এখন শুধুই স্মৃতি

গাজায় ঝলমলে রমজান মাস এখন শুধুই স্মৃতিঈমান আলহাজ আলী

পাঁচ মাসেরও বেশি সময় ধরে ইসরায়েলি সেনাদের অত্যাচার, গণহত্যা, রোগ, ক্ষুধা-পিপাসায় কাটছে আমাদের দিন। রমজান মাসেও বিন্দুমাত্র কমেনি তাদের নৃশংসতা।

এ মাসে রোজা ভাঙার জন্য ন্যূনতম খাবার জুটবে না অনেকের পাতে, জুটবে না নামাজ পড়ার একচিলতে জায়গা। এ সময়ে তাদের সম্বল হবে শুধুই অতীতের রমজান মাসগুলোর উজ্জ্বল স্মৃতি।

ইসরায়েলি ড্রোনের গুঞ্জন আর বোমা বিস্ফোরণের ভয়াল গোলযোগের মাঝেও চোখ বন্ধ করলে আমি ফিরে যাই সে সোনালি দিনগুলোতে।

পবিত্র রমজান মাসের জন্য আগে থেকেই তোড়জোড় শুরু হতে। কয়েক সপ্তাহ আগে থেকেই গাজার বাসিন্দারা কেনাকাটা করে ফেলতেন। গাজার পুরাতন শহর এবং তার আল-জাইওয়া বাজার খুব জনপ্রিয় ছিল। রমজান মাসের সবরকমের খাবার পাওয়া যেত সেখানে – টক আচার, সবচেয়ে ভালো খেজুরে, সুস্বাদু জলপাই, দারুণ সুবাসিত মশলা, শুকনো ফল, আর হরেক রকমের শরবত।

শুধু খাবার নয়, নতুন পোশাকও কেনা হতো রমজানে মাস শুরুর আগেই। নামাজের পোশাক ছাড়াও শৌখিন পোশাক কিনতো ছেলেমেয়েরা। বাচ্চারা বাবা-মায়ের কাছে আবদার করতো রঙিন কাগজের লণ্ঠনের।

সাজানো-গোছানো রাস্তাগুলো উপচে পড়ত ভিড়ে, রমজান মাসের গান বাজতো। পবিত্র এই মাসের অপেক্ষায় খুশির আমেজ ছড়িয়ে পড়তো হাওয়ায় হাওয়ায়।

এরপর আসতো সেই বহু প্রতীক্ষিত প্রথম রোজার দিন। তারাবিহ নামাজের গুঞ্জন শোনা যেত সবখানে। বাচ্চারা অনেক রাত পর্যন্ত বাইরে থাকতো, রাস্তায় খেলা করতো, গান করতো, আর আতশবাজি জ্বালিয়ে আনন্দ করতো।

সেহেরির খাবার একসাথে খেতে হবে, আর ফজরের নামাজটাও পড়তে হবে একসাথেই, এমন চল ছিল পরিবারগুলোয়। এরপর কেউ ঘুমিয়ে পড়তেন, কেউ স্কুলে যেতো, কেউ যেতেন কাজে। বিকেলের মাঝে সবাই বাড়ি ফিরে এসে পবিত্র কোরআন শরীফ পড়তেন। বাচ্চারা বাড়িতে বা মসজিদে সুরা পড়ার হাতেখড়ি নিতো। বাড়ির প্রবীণরা শিশুদের শোনাতো নবী-রাসূলদের চমৎকার সব ইতিহাস।

সূর্যাস্তের ঠিক আগে বাড়িতে বাড়িতে চলত ইফতার রান্নার ধুম। কেউ তৈরি করবে ভাত আর সবজির রান্না – মাকলুবা। কেউ রান্না করবে মুরগী দিয়ে মুসাখান, কেউ করবে মুলুখিয়া স্যুপ। এর মাঝেই হয়ত এক প্রতিবেশী এসে দিয়ে যাবে এক ট্রে ভর্তি খাবার। তাকেও খালি হাতে ফিরতে দেওয়া যাবে না- বাড়িতে যা আছে তাই দিয়ে তার ট্রে ভর্তি করে দেওয়া হবে।

টেবিলে দেওয়া হবে ইফতার, আযানের সাথে সাথেই রোজা ভাঙ্গা হবে। এরপর বাড়ির সবাই মসজিদে গিয়ে পড়বেন তারাবিহ, কুরআনের সুললিত আবৃত্তি ছড়িয়ে পড়বে গাজার আনাচে কানাচে। নামাজের শেষে শিশুদের মাঝে মিলি করা হবে বিশেষ এক মিষ্টি কাতায়েফ, যা কিনা শুধু রমজান মাসেই তৈরি হয়।

গাজার মানুষের জন্য বছরের সবচেয়ে দামি সময়টা হলো রমজান মাস, আর এ মাসেই গাজা হয়ে ওঠে পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দর জায়গা।

কিন্তু এবছর?

রঙিন আলোকসজ্জা, উৎসবের গান কেড়ে নিয়েছে ইসরায়েল, আকাশ ভারী হয়ে উঠেছে গোলাগুলি আর বিস্ফোরণে। শিশুদের উল্লাসের বদলে শোকসন্তপ্ত পরিবারের কান্না ভাসছে চারিদিকে। আবাসিক এলাকাগুলো এখন কবরস্থান। মানুষ মসজিদে গিয়ে নামাজ পড়বে কী করে? মসজিদের জায়গায় দাঁড়িয়ে আছে একেকটি ধ্বংসস্তূপ। ইফতার পার হয়ে গেলেও অনেকের পেটে খাবার পড়ে না। একের পর এক নিহত আত্মীয়কে বিদায় জানাই আমরা।

এই সীমাহীন দুঃখের চেয়েও বড় হলো এক উপলব্ধি, যে গাজার মানুষদের ভুলে গেছে বিশ্ববাসী আর এ সুযোগেই পবিত্র রমজান মাসেও গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছে ইসরায়েল।

ঈমান আলহাজ আলী: গাজার আল-মাগাজি উদ্বাস্তু শিবিরে অবস্থিত সাংবাদিক, লেখক এবং অনুবাদক; আল জাজিরা থেকে ভাষান্তর কে এন দেয়া

samakal

Exit mobile version