Site icon The Bangladesh Chronicle

গর্বের ধন ‌‘টাঙ্গাইল শাড়ি’ বেহাত হলো কার দোষে

‘নদী চর খাল বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন।’
‘চমচম, টমটম ও শাড়ি, এই তিনে টাঙ্গাইলের বাড়ি।’

টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ি। এক নামেই পরিচয়। এ শাড়ি এতটাই জনপ্রিয় ও পুরোনো যে তার নামে প্রবাদও প্রচলিত রয়েছে। বাংলাদেশের নারীদের অত্যন্ত পছন্দের কাপড়। দেশের ৬৪ জেলার মধ্যে একটি জেলা টাঙ্গাইল এবং এ জেলার দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়নে এই টাঙ্গাইল শাড়ি বোনা হয়। অথচ ‘টাঙ্গাইল শাড়ির উৎপত্তি বাংলাদেশে নয় বরং ভারতের পশ্চিমবঙ্গে’ বলে ভারতের সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় তাদের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে ১ ফেব্রুয়ারি এক পোস্টে দাবি করেছে। ওই পোস্টে দাবি করা হয়েছে, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি পশ্চিমবঙ্গ থেকে উদ্ভূত একটি ঐতিহ্যগত হাতে বোনা মাস্টারপিস। এর সূক্ষ্ম গঠন, স্পন্দনশীল রং এবং জটিল জামদানি মোটিফের জন্য বিখ্যাত– এটি এ অঞ্চলের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক।’

কোনো একটি দেশের পরিবেশ, আবহাওয়া ও সংস্কৃতি যদি কোনো একটি পণ্য উৎপাদনে ভূমিকা রাখে, তাহলে সেটিকে ওই দেশের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। বাংলাদেশের তাঁতি, বাংলাদেশের নদীময় জলবায়ু, হাওয়া ও রোদ ছাড়া কি টাঙ্গাইল শাড়ি কল্পনা করা যায়!

ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে টাঙ্গাইলে তাঁতশিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটে। যে তাঁতিরা এটি করেন, তারা ছিলেন মূলত বাংলাদেশের গৌরবের মসলিন তাঁতশিল্পীদের বংশধর। তারা মূলত টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার, সন্তোষ ও ঘারিন্দা এলাকার জমিদারদের আমন্ত্রণে টাঙ্গাইলে যান। সেখানেই তারা আবাস গড়েন। তাদের আদিনিবাস ছিল ঢাকা জেলার ধামরাই ও চৌহাট্টায়।

ঐতিহ্যবাহী তাঁতশিল্পের ইতিহাসও অনেক দীর্ঘ এবং বিচিত্র। বৈচিত্র্য তাঁতের ধরনে, উৎপাদন পদ্ধতির পার্থক্যে, বুননে, নকশায়; এমনকি আবহাওয়া, আর্দ্রতা ও গাছের ছায়া থাকা-না থাকার ফারাকেও। টাঙ্গাইল শাড়ি একটি বিশেষ স্থান, ভূগোল, ইতিহাস এবং কবিতার সঙ্গে জড়িত। টাঙ্গাইল জেলা ঔপনিবেশিক আমলে ঢাকার সঙ্গে যুক্ত ছিল। সেই সময় ঔপনিবেশিক শহর কলকাতায় এ শাড়ির পরিচয় ছিল ‘ঢাকাই শাড়ি’ হিসেবে। ধলেশ্বরী নদীর তীরে বিস্তীর্ণ এলাকায় তাঁতপল্লি গড়ে উঠেছিল। এসব পল্লিতে অন্তত ২৩ ধরনের টাঙ্গাইল শাড়ি তৈরি হতো, এখনও হয়ে থাকে।

বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরার জন্য যে শাড়িগুলো পৃথিবীর সব বাঙালির কাছে পরিচিত, তার মধ্যে রয়েছে জামদানি এবং টাঙ্গাইলের ভাইটাল তাঁতের শাড়ি, বিশেষ করে নকশি বুটি শাড়ি। বাঙালি নারী যেভাবে জামদানি ও টাঙ্গাইল শাড়িতে নিজেকে প্রকাশ করতে পারেন, তা আর কোনো শাড়িতেই হয় না। তবে পাবনার শাড়ির তুলনায় এ শাড়ি মধ্যবিত্ত এবং উচ্চবিত্ত পরিবারের নারীদের মধ্যেই বেশি ব্যবহার হয়, কারণ এ শাড়ি তৈরিতে যে শিল্পকর্ম ও দক্ষতার প্রয়োজন এবং দামি মিহি সুতার ব্যবহার, তাতে এর দাম সাধারণ শাড়ির তুলনায় অনেক বেশি হয়।

জামদানির মতো নকশি বুটি শাড়িও টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল ইউনিয়ন ছাড়া অন্য কোথাও দেখা যায় না। এ এলাকার বসাকরা তাঁতের শাড়ি উৎপাদন ও বিক্রির কাজ করে আসছেন দীর্ঘদিন ধরে। তারা উচ্চ মানের তাঁত শাড়ি উৎপাদন করে ঢাকাসহ সারাদেশের বাজারে টাঙ্গাইল শাড়ির ব্র্যান্ডে সুতি ও সিল্কের শাড়ি তৈরি করছেন। পাথরাইল বাজারটিও শত বছরের পুরোনো। এখানে অনেক মুসলমান জমিদার ছিলেন, তাদের জন্য মিহি সুতার কাপড় তৈরি হতো এখানেই। তাঁত গ্রামের মধ্য দিয়ে হেঁটে গেলে শোনা যায় ভাইটাল তাঁতের মাকুর শব্দ। আবার দেখা যায় রাস্তার ওপরই লম্বা টানা পড়েছে নানা রঙিন সুতা দিয়ে। মুসলমান যেসব তাঁতি ছিলেন, তাদের বলা হতো জোলা। এই জোলা তাঁতিদের সংখ্যাধিক্য ছিল টাঙ্গাইল, কালিহাতী ও গোপালপুরে।

টাঙ্গাইল সীমান্তবর্তী কোনো জেলাও নয় যে পশ্চিমবঙ্গ এর অংশ হিসেবে দাবি করতে পারে। টাঙ্গাইলের একদিকে যমুনা নদী, ওপারে সিরাজগঞ্জ, উত্তরে ময়মনসিংহ, আরেকদিকে গাজীপুর, ঢাকা ও মানিকগঞ্জ। পশ্চিমবঙ্গে যারা টাঙ্গাইলের শাড়ি বোনেন, তারা টাঙ্গাইল থেকে পশ্চিমবঙ্গে যাওয়া বসাক সম্প্রদায়। এক সময় বিভিন্ন কারণে কিছু বসাক ফুলিয়া, সমুদ্রগড়, ধাত্রীগ্রাম, নবদ্বীপ এসব অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেন। ভারত সরকার এ দক্ষ কারিগরদের সহযোগিতা করার জন্য সমিতির মাধ্যমে টাঙ্গাইল শাড়ি নামে উৎপাদন এবং বাজারজাত করে তন্তুজ ও তন্তুশ্রীর মাধ্যমে। এটুকুই শুধু তাদের ইতিহাস, তাও খুব বেশিদিনের নয়।

টাংগাইল থেকে যাওয়া বসাকরা ভারতবর্ষে বিভিন্ন অঞ্চলে টাঙ্গাইলের মতো শাড়ি তৈরি করে টাঙ্গাইল শাড়ি নামে বিক্রি করছেন। তবে এখন ভারতবর্ষে যারা বসাক রয়েছেন তারা আর শাড়ি বোনেন না। বাংলাদেশের টাঙ্গাইল শাড়ি প্রতি সপ্তাহে পশ্চিমবঙ্গে যায় ট্রাকে করে।

দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ভারত যেখানে তাদের তাঁতিদের উঠিয়ে আনছে, সেখানে টাঙ্গাইলের তাঁতশিল্পীরা আমাদের সরকারের কাছ থেকে কোনো সহযোগিতা পান না। অনেক কষ্টে তাদের বোনা এই শাড়ি বিক্রি করতে হয়। ঢাকায় প্রবর্তনা ১৯৮৯ সালে টাঙ্গাইল শাড়ির জন্যই প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল এবং এখনও এই তাঁতশিল্পীদের সঙ্গে সম্পর্ক রেখে চলেছে। এ ছাড়া টাঙ্গাইল শাড়ি কুটির টাঙ্গাইল শাড়িকে ঢাকায় জনপ্রিয় করেছে।

বাংলাদেশ সরকারের এ বিষয়ে অবিলম্বে প্রতিবাদ জানানো উচিত। আমাদের দেশের একটি ঐতিহ্যবাহী সম্পদ এভাবে অন্য কোনো রাষ্ট্র দাবি করবে– এটি হতে দেওয়া যায় না।

ফরিদা আখতার: সভানেত্রী, নারীগ্রন্থ প্রবর্তনা; সম্মিলিত নারী সমাজের সদস্য; নয়াকৃষি আন্দোলনের সংগঠক।

samakal

Exit mobile version