গণতন্ত্রেরও নেই নিরাপত্তা
‘বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। তবে দেশে নিরাপদ খাদ্যের ঘাটতি রয়েই গেছে।’ সরকারের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) প্রধান নির্বাহী তথা মহাপরিচালক এ কথা বলেছেন হৃদরোগবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে। ১৩ ফেব্রুয়ারি রাজধানীতে আয়োজিত এই সমাবেশে শিল্পমন্ত্রী বলেছেন, জনস্বাস্থ্যের প্রতি হুমকি যেসব খাদ্য, সে পণ্যগুলোর ব্যাপারে শিল্প মন্ত্রণালয় সজাগ। তবে অনুষ্ঠানে এই মন্ত্রণালয়েরই অধীনস্থ, বিএসটিআই’র ডিজি উপরে উল্লিখিত কথা বলেছেন। মোট কথা, সরকারের দাবি মোতাবেক- এ দেশ খাদ্যে স্বনির্ভর, তবে এই খাদ্যপণ্য অনেকাংশে আজো অনিরাপদ। শুধু মানুষের খাদ্য নয়, গণতন্ত্রের যা ‘খাদ্য’, সেদিক দিয়েও বাংলাদেশ নিরাপদ হতে পারেনি।
আমাদের দেশ ‘গণতান্ত্রিক’ হিসেবে বিশ্বে পরিচিত। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা দেশটিকে ‘গণতন্ত্রী’ রাষ্ট্ররূপে জোর দিয়ে দাবি করে আসছেন। গণতন্ত্রের ‘খাদ্য’ অর্থাৎ, গণতন্ত্র ভালোভাবে বেঁচেবর্তে থাকা এবং বিকশিত ও ফলপ্রসূ হওয়ার জন্য দরকার- সুষ্ঠু নির্বাচন, যথাযথ জনপ্রতিনিধিত্ব, সুশাসন, সরকারের স্বচ্ছতা, প্রশাসনের জবাবদিহিতা, আইনের প্রাধান্য, আর্থিক বৈষম্য রোধ, সামাজিক সুবিচার প্রভৃতি। এখানে সর্বপ্রথমেই যে নির্বাচনের কথা রয়েছে, তার হাল অবস্থা (যা মূলত বেহাল দশা) কেমন, তা দেশের মানুষ হাড়ে হাড্ডিতে টের পাচ্ছে এবং আরো বেশি করে টের পাবে।
‘সেলুকাস! কী বিচিত্র এ দেশ’। কথাটা মহাবীর আলেকজান্ডারের। তিনি এই উপমহাদেশ প্রসঙ্গে তা বলেছিলেন বলে কথিত। এটা আরো বেশি প্রযোজ্য আমাদের বাংলাদেশের ব্যাপারে। ‘শত রঙ্গে ভরা এই ভঙ্গ বঙ্গদেশ’। এখানে উন্নয়ন আছে, সুশাসন নেই। প্রবৃদ্ধি আছে, সেই সাথে রয়েছে ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব। নির্বাচন আছে; ভোটার নেই। আর সংসদ থাকলেও বাস্তবে বিরোধী দল নেই। “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে না’ক তুমি” বলে কবি ও গীতিকার দ্বিজেন্দ্রলাল রায় গৌরববোধ করলেও কথাটার রস আজকের প্রেক্ষাপটে তেতো হয়ে উঠেছে।
গণতন্ত্রের শাসনব্যবস্থায় গণমুখী সরকারের সাথে শক্তিশালী বিরোধী দলও অপরিহার্য। না হয় আইনসভা পরিণত হয় এক চাকার ভগ্নযানে। তাতে চড়ে যেমন মোটেও আরাম নেই, তেমনি পদে পদে দুর্ঘটনার শঙ্কা। বাংলাদেশের পার্লামেন্টের অনেকটা এ ধরনের রুগ্ণ দশা। ‘বিরোধী দল’ থেকেও না থাকার মতো- ‘নামে আছে, কামে নাই’।
ব্রিটেনে আলঙ্কারিক হলেও রাজতন্ত্র রয়ে গেছে। তাই সব কিছু রাজা/রানীর নামে শুরু করাই নিয়ম। এ কারণে সে দেশে His/Her Majesty’s Government-এর মতো His/Her Majesty’s Opposition রয়েছে। বাংলাদেশে রাজতন্ত্র না থাকলেও বিরোধী দল কার্যত Majesty’s Opposition সোজা কথায় ‘অনুগত’/বশংবদ বিরোধী দল। এ দেশে খাসা বিরোধী দল ছিল দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে-জিয়ার আমলে। প্রথম পার্লামেন্টে অর্থাৎ মুজিবের শাসনামলে কোনো মতে একটা গ্রুপ গঠিত হলেও সত্যিকার বিরোধী দল গঠনের মতো সংখ্যাশক্তি অর্জিত হয়নি। তৎকালীন বিরোধী দলের দাবি, আসলে সরকার তা হতে দেয়নি নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনে। তবুও অবিভক্ত জাসদের আবদুল্লাহ সরকার এবং পার্বত্যাঞ্চলের মানবেন্দ্র নারায়ণ লারমাসহ বিরোধী দলের কারো কারো সাহসী ভূমিকা মানুষকে উদ্বুদ্ধ করত তখন। দ্বিতীয় জাতীয় সংসদে বিরোধী দলে যারা ছিলেন, তাদের অনেকেই আওয়ামী লীগের লোক। প্রায় ৪০টি আসন ছিল তাদের। তারা প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে ভূমিকা পালন করেছেন এবং জিয়ার আমলে সে সুযোগ পেয়ে সদ্ব্যবহারও করেছিলেন।
তখন আওয়ামী লীগ সংসদীয় দলের নেতা ছিলেন অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান খান। তিনি আইনজীবী ও পার্লামেন্টারিয়ান হিসেবে ছিলেন খ্যাতিমান। আসাদুজ্জামান ১৯৬৫ সালে নির্বাচিত, তদানীন্তন প্রাদেশিক পরিষদে (৬ দফা বিরোধীদের নিয়ে গঠিত) বিরোধী দলের একাংশের নেতা হয়েছিলেন ১৯৬৬ সালে। তবে পরে তিনি ৬ দফাপন্থী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। যা হোক, বাংলাদেশের দ্বিতীয় সংসদে আওয়ামী এমপিদের মধ্যে সুধাংশু শেখর হালদারের মতো কয়েকজন প্রায় সময়ে সরকারের ও ক্ষমতাসীন দলের তীব্র সমালোচনার মাধ্যমে সংসদ অধিবেশন সরগরম করে রাখতেন। জিয়ার মৃত্যুর পর ভাইস প্রেসিডেন্ট বিচারপতি আবদুস সাত্তারের যাতে প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথ সুগম হয়, সেজন্য সংবিধানে ষষ্ঠ সংশোধনী আনা হয়েছিল। সে সময় বিরোধী দলের অন্তর্ভুক্ত, ইসলামিক ডেমোক্র্যাটিক লীগ (আইডিএল) প্রধান মাওলানা মুহাম্মদ আবদুর রহীম সরকারের এ উদ্যোগের তীব্র সমালোচনামূলক যে বক্তব্য দিয়েছিলেন, তা অনেকের হয়তো আজো মনে আছে।
তৃতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছিল জেনারেল এরশাদের আমলে ১৯৮৬ সালের মে মাসে। তখন থেকে সংসদে বিরোধীদলীয় ভূমিকা আর প্রত্যাশামাফিক ছিল না। হয় তাদের ভূমিকা রাখতে দেয়া হয়নি; নতুবা তারা মাসের পর মাস বা দীর্ঘদিন সংসদ অধিবেশন বর্জন করে গেছেন। ১৯৮৬ সালের নির্বাচন বর্জন করেছিল বিএনপি। অপর দিকে, অভিযোগ উঠেছিল, সরকারের সাথে ‘সমঝোতা’র মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ হঠাৎ এ নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে ’৮৭ সালের শেষ দিকে এ দলটির এবং জামায়াতে ইসলামীর এমপিরা সংসদ থেকে পদত্যাগ করেন। তখন বাধ্য হয়ে সরকার পরবর্তী যে সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করে, তা অনুষ্ঠিত হয় ’৮৮ সালের প্রথম দিকে। বিএনপি ও আওয়ামী লীগের মতো প্রধান দুই দলের বর্জনের ফলে জাসদের একাংশের নেতৃত্বে এ সংসদের যে ‘বিরোধী’ দল গঠন করা হয়, তাকে ব্যঙ্গ করে অভিহিত করা হয়েছিল ‘গৃহপালিত’ হিসেবে।
অনেক ক্ষেত্রে একই দৃশ্য দেখা যাচ্ছে ২০১৪ আর ’১৮ সালে গঠিত দু’টি সংসদের বিরোধী দলের বেলায়ও। বর্তমানে দেশে যারা জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের ভূমিকায় অবতীর্ণ, তারা ক্ষমতাসীনদের মহাজোটের অংশ মাত্র। সুতরাং তাদের পক্ষে বিরোধী দলের ভূমিকা রাখা সম্ভব নয়। প্রকৃত বিরোধী দল হিসেবে জনগণ মনে করে বিএনপি এবং তার সহযোগী দলগুলোকে। কিন্তু তাদের অবস্থান সংসদে নয়, এর বাইরে। সংসদে তাদের অবস্থান নামমাত্র, যা দিয়ে বিরোধী দলের ভূমিকা রাখা যায় না। দেশবাসী তাদের ‘আসল বিরোধী দল’ মনে করলে কী হবে, প্রশাসন ও ক্ষমতাসীন দলের চরম বাধা ও বৈরিতার মুখে রাজপথেও দাঁড়ানো কঠিন হওয়ায় বাস্তবে নিজেদের অফিস বা চার দেয়ালের মাঝেই তাদের তৎপরতা সীমিত। এমন এক অবস্থায় সরকার স্বস্তি বোধ করলেও গণতন্ত্রপ্রেমী মানুষ মাত্রই নিদারুণ অস্বস্তি ভোগ করছেন। এ পরিস্থিতিতে গণতন্ত্র ক্ষমতাসীনদের মুখের কথায় ক্রমেই সীমাবদ্ধ, তথা ‘কাজির গরু’ হয়ে পড়ছে।
মূলত বিশ্বের অতি জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন দেশে নির্বাচিত কর্তৃত্ববাদের এহেন আগ্রাসী রাজনৈতিক প্রবণতা পরিলক্ষিত হচ্ছে। এই লোকরঞ্জনবাদী কর্তৃত্ববাদ কোথাও বর্ণ, কোথাও ভাষা ও সংস্কৃতি, কোথাও বা ধর্মের ভিত্তিতে জাতিকে বিভক্ত করছে। এর প্রবক্তারা একই সাথে উগ্র ও সাম্প্রদায়িক। এদের কট্টরপন্থী বক্তব্য এবং বিদ্বেষমূলক আচরণ দেখে বুঝা যায়, সাম্প্রদায়িকতা আর শুধু ধর্মভিত্তিক নেই। সেই সাথে, ভাষা ও বর্ণ তথা সংস্কৃতি ও নৃতাত্ত্বিক পরিচয়নির্ভর সাম্প্রদায়িকতাও বর্তমান বিশ্বে রমরমা রাজনীতি করছে জাতীয়তাবাদের নাম ভাঙিয়ে। ভাষাভিত্তিক বা নৃতাত্ত্বিক জাতীয়তাবাদকে ‘সাংস্কৃতিক জাতীয়তাবাদ’ বলা হয়, যা অনেকের দৃষ্টিতে অগণতান্ত্রিক এবং বিভেদাত্মক। অপর দিকে, রাষ্ট্রীয় ভূখণ্ডভিত্তিক যে জাতীয়তাবাদকে ‘রাজনৈতিক জাতীয়তাবাদ’ বলা হয় তাকে অনেকে আধুনিক যুগের উপযোগী বলে মনে করেন।
বাংলাদেশে গত কয়েক বছরে রাজনীতি এক প্রকার ‘বাজনীতি’তে পর্যবসিত হয়েছে অনেক ক্ষেত্রেই। একইভাবে অনেকেই ক্ষোভের সাথে বলে থাকেন, ইউনিয়ন থেকে পার্লামেন্ট পর্যন্ত নির্বাচনের নামে যা চলছে, তাতে গণতন্ত্র নির্বাসনে চলে যাচ্ছে। এর নিয়ন্ত্রণ ও তত্ত্বাবধানের দায় এড়িয়ে ‘নির্বাচন কমিশন’ বরাবর একতরফাভাবে ক্ষমতাসীন মহলের অনুকূলে ‘মাঠ তৈরি করা’র কাজে ব্যস্ত থাকে। ফলে গণতন্ত্রমনা মানুষ এই সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের ভূমিকায় Commission-এর চেয়ে Omission অনেক বেশি বলে মনে করছেন। এত দিন আমরা শুনে এসেছি, ‘আমার ভোট আমি দেবো- যাকে খুশি তাকে দেবো।’ এখন বিশেষ দল ও প্রতীকের লোকজন ‘নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র’ কায়েমের লক্ষ্যে পরিকল্পিতভাবে যে অবস্থান নিয়েছেন বিভিন্ন নির্বাচনে, তাতে স্লোগানটি বদলে দিয়ে বলতে হয় ‘তোমার ভোটও আমি দেবো- যাকে খুশি তাকে দেবো।’ এ জন্যই বিশেষত গত এক দশকের নির্বাচনগুলোতে বাংলাদেশে সাধারণ ও নিরীহ ভোটারদের শুনতে হয়েছে, ‘চাচা, কষ্ট করে আপনাকে ভোটকেন্দ্রে যেতে হবে না। আপনার পক্ষ থেকে আমরাই ভোট দিয়ে দেবো।’ এই চাচার বাস্তবজ্ঞান থাকলে তিনি আর নির্বাচনের দিন ঘর থেকে বের হওয়ার সাহস করবেন না। অপর দিকে, তিনি যদি ‘বোকা’ কিসিমের মানুষ হন, কিংবা হন ঘাড়ত্যাড়া, তাহলে ভোট দিতে যাবেন। কিন্তু ডাণ্ডাবাজ ‘ভাতিজা’দের হাতে অপদস্থ হয়ে বিনাভোটেই প্রত্যাবর্তনে বাধ্য হবেন।
এবার ঢাকা সিটি নির্বাচনে ইভিএম দেয়া হয়েছিল। তাতে ভোটের বুথে বুথে ভূতসদৃশ ভীতিপ্রদ ছায়ামানবের আবির্ভাব ব্যাপক হতে অসুবিধা হয়নি, বরং ভদ্র ভোটাররা সেদিন ইভিএম নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতার শিকার হয়েছেন। তাদের কাছে EVM মানে, Electronic Vicious Machine (ইলেকট্রনিক ভয়ঙ্কর মেশিন)। এত আধুনিক প্রযুক্তি প্রয়োগ করা সত্ত্বেও রাজধানীর দুই সিটির দুই মেয়র মাত্র ৮-১০ শতাংশ জনসমর্থন পেয়েছেন। এর নাম যদি ‘নির্বাচন’ হয়, তাহলে আগামী দিনে ২-৪ শতাংশ ভোটারও ভোটকেন্দ্রে যেতে চাইবেন না। ক্ষমতাসীনরা তাদের প্রতিপক্ষের জন্য যে খাদ খুঁড়েছিলেন, তাতে নিজেরাই পড়ে গেছেন। কারণ, তাদের নির্বাচনী প্রচারণায় শত শত নর-নারীর হাজিরা থাকলেও তারা ভোট দেয়ার কষ্ট করতে রাজি হননি এবার। অন্য দিকে, লাখ লাখ টাকা খরচ করে যেসব ধনাঢ্য ব্যক্তি নির্বাচনে প্রার্থী হলেন, তারা নিজ নিজ পোস্টারের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বিগ্ন থাকলেও জনগণের নিরাপত্তার ব্যাপারে উদ্বেগের প্রমাণ রাখেননি।