Site icon The Bangladesh Chronicle

খুলনা নির্বাচন নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ

খুলনা নির্বাচন নিয়ে কিছু পর্যবেক্ষণ

এম সাখাওয়াত হোসেন
২৫ মে ২০১৮

 

খুলনা সিটি করপোরেশন নির্বাচনে ভোট দিতে লাইনে দাঁড়িয়ে আছেন নারী ভোটাররা। প্রথম আলাে ফাইল ছবিঅনেক শঙ্কা আর জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে ১৫ মে খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচন হয়েছে। নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় ভোটের আগে তফসিল ঘোষণা থেকে ভোট অনুষ্ঠানের আগ পর্যন্ত সব কর্মকাণ্ডকে প্রথম ধাপ হিসেবে বিবেচনা করা হয়। সেই বিবেচনায় ১৫ মে তারিখের ভোট গ্রহণ ছিল নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার দ্বিতীয় এবং সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ধাপ। আর নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার তৃতীয় ধাপ হচ্ছে নির্বাচনী বিরোধ নিষ্পত্তি, যা এ পর্যায়ে আদালতের মাধ্যমে নিষ্পত্তি হওয়ার কথা। সাধারণত নির্বাচনের ফলাফল গেজেট বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রকাশিত না হওয়া পর্যন্ত সরকারিভাবে ফলাফল গ্রহণযোগ্য হয় না। তেমনি সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি আদালতের শরণাপন্ন হতে পারেন না। কাজেই সম্পূর্ণ নির্বাচনী প্রক্রিয়া শেষ হতে এখনো কিছু সময় রয়েছে। অবশ্য নির্বাচনী ব্যবস্থাপনায় প্রয়োগের ধাপে আরও অনেক বিষয় রয়েছে, যেগুলো প্রধানত জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে সম্পন্ন করা হয়।

ভোট শেষে নানা ধরনের বিশ্লেষণ হয়েছে গণমাধ্যমে এবং খুলনাসহ অন্যান্য স্থানের বিশ্লেষকদের মতামত এখনো চলমান। সিংহভাগ পত্রপত্রিকার প্রতিবেদনে যা প্রতিফলিত হয়েছে, তাতে নির্বাচনটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়নি বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। যদিও স্থানীয় নির্বাচনে বিদেশি পর্যবেক্ষকদের আনাগোনা হয় না, তবে বিদেশি দূতাবাসগুলো কখনো কখনো নিবিড়ভাবে অবলোকন করে এবং সময়ে সময়ে বৈধভাবে প্রতিনিধিও প্রেরণ করে। এমন একটি দূতাবাস যুক্তরাষ্ট্র; যাদের পর্যবেক্ষণে খুলনার নির্বাচনে নিয়মের চেয়ে অনিয়মে ভরা থাকার কারণে রাষ্ট্রদূত অনিয়মের তদন্ত হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন (প্রথম আলো, ১৬ মে ২০১৮)। ওই দেশে বর্তমান প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে নির্বাচনকে প্রভাবিত করার অভিযোগে ব্যাপক
তদন্ত হচ্ছে। উন্নত বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোতে কিছু কিছু অনিয়ম হলেও তাৎক্ষণিকভাবে কিছু তদন্ত ও প্রতিকার করা হয়।

ওপরের আলোচনার আলোকে নির্বাচনী ব্যবস্থাপনার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এবং একক দায়িত্বপ্রাপ্ত সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান নির্বাচন কমিশনই নির্বাচন পরিচালনা এবং আইন প্রয়োগের একমাত্র সংস্থা। যদিও অন্য শরিকদের সহযোগিতাতেই ভালো নির্বাচন হয়, তবে সে সহযোগিতা নির্বাচন কমিশনকে অনেক সময় আদায় করে নিতে হয়। প্রশাসনিক সহযোগিতার বাধ্যবাধকতা সংবিধানে উল্লেখিত রয়েছে। কাজেই নির্বাচন অগ্রহণযোগ্য অথবা ত্রুটিপূর্ণ হলে বা অনিয়ন্ত্রিত হলে তারও দায়দায়িত্ব পালন এবং ক্ষমতা স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় প্রয়োগ করে অনিয়মের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে।

একটি নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য হয়েছে কি না, তা নির্ভর করবে নির্বাচনের প্রথম পর্ব, অর্থাৎ নির্বাচনী কর্মকাণ্ড শুরুর পর ভোটের দিন একজন ভোটারের ভোট প্রদান পর্যন্ত। এ পর্বের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক হচ্ছে নির্বাচনী প্রচারণা। সব প্রার্থীর জন্য সমান এবং বিনা বাধায় প্রচার-প্রচারণা চালানোর সুযোগ ও পরিবেশ তৈরির ওপরই নির্ভর করে ভোটাররা সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে ভোট দিতে পারবে কি না। দ্বিতীয় গুরুত্বপূর্ণ উপাদানটি হলো, ভোটাররা তাঁদের পছন্দমতো প্রার্থীকে ভোট প্রদান করতে পেরেছেন কি না। ভোটকেন্দ্রে জাল ভোট এবং অনিয়ম হয়েছিল কি না। ভোটকেন্দ্রের পরিবেশ কেমন ছিল এবং ভোট-পরবর্তী গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো, ভোট গণনা স্বচ্ছ এবং সঠিক হয়েছিল কি না।

সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা কেমন ছিল? অভিযোগের নিষ্পত্তি এবং নির্বাচনে নিয়োজিত নির্বাচন কমিশনের জনবলের কার্যকারিতা নিয়মতান্ত্রিক ছিল কি না। সর্বোপরি নির্বাচন সম্বন্ধে স্থানীয় ভোটার-সাধারণ, জনসাধারণ এবং উপস্থিত পর্যবেক্ষক ও গণমাধ্যমের বিশ্লেষণের মাধ্যমে একটি নির্বাচনের মান নির্ণয় করা হয়।

ওপরের আলোচনাটি খুলনা সিটি করপোরেশনের নির্বাচনের মান নির্ণয় করার জন্য খুবই জরুরি। এর আঙ্গিকে নির্বাচনটিকে বিশ্লেষণ করলে এই নির্বাচনকে অনিয়মে ভরা ও ত্রুটিযুক্ত নির্বাচন হিসেবেই চিহ্নিত করতে হবে এবং এই নির্বাচনকে কোনোভাবেই সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য বলা কঠিন। একাধিক বিশ্লেষকের মতে, নির্বাচন কমিশন নির্বাচন প্রক্রিয়ার তিনটি স্তরকেই আশানুরূপভাবে পরিচালনা করতে পারেনি।

দৃশ্যত নির্বাচন-পূর্ব সময়ে কমিশন প্রশাসনকে তেমন নিয়ন্ত্রণে রাখতে পেরেছিল বলে মনে হয়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে ব্যাপক অভিযোগ থাকলেও নির্বাচন কমিশন তেমন পদক্ষেপ নেয়নি বা নিতে পারেনি। প্রতিপক্ষ বিরোধী দলকে ধরপাকড়ের বিষয়টি আদালত পর্যন্ত গড়ায় এবং একটি নির্দেশনা এসেছিল নির্বাচনের মাত্র দুদিন আগে। যেহেতু বিষয়টি আইনত নির্বাচন কমিশনের এখতিয়ারে ছিল, তাই সহজে অনুমেয় যে বাদী কমিশনে প্রতিকার না পেয়ে আদালতের শরণাপন্ন হয়েছেন। আদালত হয়রানি না করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। আদালতের নির্দেশনার পরিপ্রেক্ষিতে প্রতীয়মান যে হয়রানি হয়েছিল, যার বিরুদ্ধে কমিশন পদক্ষেপ নিতে পারেনি। বিষয়টি আদালতে গড়ানোর কারণে জনমনে প্রশ্ন উঠেছে যে কেন কমিশনকে এত ক্ষমতায়নের পরও বাদীকে আদালতের দোরগোড়ায় যেতে হলো।

এমনকি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল যে পুলিশ যেকোনো কারণেই হোক, নির্বাচন কমিশন কর্তৃক নিয়োজিত অনেক প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের, যাঁদের একমাত্র কমিশনের কাছে দায়ী থাকার কথা, তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। কী বিষয়ে ও কী কারণে পুলিশ এমন পদক্ষেপ নিয়েছে, তা জানা যায়নি। এ বিষয়ে নির্বাচন কমিশন থেকে কোনো ধরনের প্রতিক্রিয়া ও ব্যাখ্যা পাওয়া যায়নি। এ ধরনের পুলিশি কর্মকাণ্ড নির্বাচনী আইন ও বিধিপরিপন্থী।

খুলনায় ভোট গ্রহণের দিনে তিনটি কেন্দ্র বন্ধ হয়েছে কিন্তু যেসব কেন্দ্রে জাল ভোট পড়েছে বলে গণমাধ্যমে প্রচারিত ও প্রকাশিত হয়েছে, সেসব কেন্দ্রের ভোট গৃহীত হওয়ায় নির্বাচনের ফলাফলে অবশ্যই প্রভাব পড়েছে। একটি জাল ভোট পড়া মানেই ভোট গণনার মধ্যে নিতে হবে, যদি না ওই বুথ বা কেন্দ্র স্থগিত করা হয়। বহু কাঠখড় পুড়িয়ে ছবিসহ ভোটার তালিকা করা হয়েছিল, যাতে জাল ভোটার শনাক্ত করা যায়, কিন্তু বেড়ায় খেত খেলে তাকে ঠেকাবে কে? উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, বেশ কয়েকটি পত্রিকা এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে যে একটি শিশু পিতার সঙ্গে এসে ভোট দিয়েছে। এমনকি কোন ‘আঙ্কেল’কে ভোট দিয়েছে, তা সেই শিশু বলেছে এবং আঙুলের অমোচনীয় কালি দেখিয়েছে। কীভাবে ওই শিশু ভোট দিয়েছে? ভোট গ্রহণকারী কর্মকর্তা ও তাঁর সহযোগী এ ধরনের অনৈতিক কাণ্ড কীভাবে ঘটতে দিলেন? ওই কেন্দ্রে এ ধরনের কর্মকাণ্ড হতে পারলে তা কি একটিতেই সীমাবদ্ধ ছিল? ওই কেন্দ্রের ভোট গণনা কি আইনসম্মত হয়েছে? প্রশ্ন থাকে যে ওই কেন্দ্রের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে কোনো আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে কি না। নির্বাচন কমিশন এই বহুল প্রচারিত জাল ভোট প্রদানের ঘটনায় ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে আইনানুগ কোনো ব্যবস্থা নিয়েছে কি না, জানা যায়নি।

পত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, কয়েকটি কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। একটিতে ৯৯.৯ শতাংশ। তার মানে মাত্র একজন ভোটার ভোট দেননি। এ এক অসম্ভব পরিসংখ্যান এবং কেন্দ্রটি খালিশপুরে। ওই কেন্দ্রে অনেকক্ষণ গোলযোগ চলছিল এবং কেন্দ্রটি সাময়িক বন্ধ ছিল। ওই কেন্দ্রের প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা নিশ্চিতভাবেই তাঁদের দায়িত্বে অবহেলা করেছেন। কারণ, ওই কেন্দ্রসহ আরও কয়েকটি কেন্দ্রে অস্বাভাবিক ভোট পড়েছে। সেখানে যে জাল ভোট পড়েছে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।

বিভিন্ন টিভি চ্যানেলে প্রচারিত হয়েছে যে আলিয়া মাদ্রাসা কেন্দ্রে বেশ কয়েকজন মহিলা ও পুরুষ ভোটার ভোট দিতে পারেননি। কারণ, অন্য কেউ তাঁদের ভোট দিয়ে গেছেন। প্রিসাইডিং কর্মকর্তা তার প্রতিকার জানতেন না। অবস্থাদৃষ্টে মনে হলো যে প্রিসাইডিং কর্মকর্তাদের তাঁদের ক্ষমতা এবং আইনের প্রয়োগের বিষয়ে তেমন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়নি। এসব বিষয়ে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করবে কি না, জানা যায়নি। এ ধরনের নমুনা থেকে বলা যায় যে খুলনা নির্বাচনে যথেষ্ট অনিয়ম হয়েছে। ইলেকশন ওয়ার্কিং গ্রুপের (ইডব্লিউজি) মতে, ৩২ শতাংশ কেন্দ্রে ভোট গ্রহণে সমস্যা হয়েছে। তার মানে ৮০টির ওপরে কেন্দ্রে ভোট গ্রহণ সঠিক হয়নি। কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচনে শতভাগ কেন্দ্রে নির্বাচনী দুর্নীতি হয় না। নির্ধারিত বেশ কিছু কেন্দ্রকেই টার্গেট করা হয়। তা ছাড়া নানাবিধ উপায় প্রয়োগ করা হয়, যেমনটা আলোচিত নির্বাচনে ঘটেছে বলে গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞদের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে।

প্রায় প্রতি নির্বাচনেই বিরোধীপক্ষের পোলিং এজেন্টকে বের করে দেওয়ার অথবা এজেন্টকে কেন্দ্রে ঢুকতে না দেওয়ার অভিযোগ ওঠে। খুলনা নির্বাচনও এ ছকের বাইরে থাকেনি। পত্রপত্রিকার সূত্রে জানা গেছে, ৪০ থেকে ৫০টি কেন্দ্রে বিএনপির পোলিং এজেন্ট পাওয়া যায়নি; যদিও তাদের দাবি আরও বেশি। অনেক বিশেষজ্ঞের মতে এবং স্থানীয় পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত খবর অনুযায়ী এই সংখ্যা অনেক বেশি। অনেক পোলিং এজেন্ট মারধর করার কারণে হাসপাতালে রয়েছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে। এ ধরনের বিষয়ে বিধিসম্মত উপায়ে অভিযোগ হয়ে থাকলে নির্বাচন কমিশনকে অবশ্যই ধর্তব্যের মধ্যে নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে প্রিসাইডিং কর্মকর্তারা যত্নবান ছিলেন কি না, তা–ও খতিয়ে দেখার প্রয়োজন রয়েছে।

ওপরের আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে এবং যে ধরনের অভিযোগ প্রকাশিত হয়েছে, সেসব ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে নির্বাচন কমিশন তদন্ত করতে পারে, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের কর্মকাণ্ড নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ না করে। অন্যথায় নির্বাচন কমিশনের ওপরে আস্থার অভাব হবে। সুষ্ঠু, স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন শুধু নির্বাচন কমিশনের একার কাজ নয় কিন্তু দায়দায়িত্ব নির্বাচন কমিশনকেই নিতে হবে। কারণ, সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন নির্বাচন কমিশনকেই দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে, অন্য কোনো শরিককে নয়।

এম সাখাওয়াত হোসেন সাবেক নির্বাচন কমিশনার, কলাম লেখক ও পিএইচডি গবেষক

hhintlbd@yahoo.com

Exit mobile version