Site icon The Bangladesh Chronicle

খুন কিংবা খুনের উসকানি দিয়েও কি ছাড় পেয়ে যাবেন সাংবাদিক পরিচয়ে?

খুন কিংবা খুনের উসকানি দিয়েও কি ছাড় পেয়ে যাবেন সাংবাদিক পরিচয়ে?

কাকন রেজা

সাংবাদিক দম্পতি শাকিল ও ফারজানা রূপার বিরুদ্ধে হত্যা মামলা হয়েছে। এ নিয়ে দেখলাম নানান কথা হচ্ছে। হোক। সাংবাদিকেরা অনেকদিন ধরেই অবিচারের মুখোমুখি। সাগর-রুনি হত্যা মামলার বিচার হয়নি। হয়নি ফাগুন রেজা হত্যা মামলারও। এরাও সাংবাদিক ছিলেন। কিন্তু তখন শাকিল ও রূপার গ্রেপ্তারে যে প্রতিক্রিয়া দেখতে পাচ্ছি কারো কারো, তখন কিন্তু হত্যাতেও তেমন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। প্রতিক্রিয়া হয়েছে কিন্তু তা ধীরে ধীরে। অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে সেজন্যে। গুম-খুনের শিকার সাংবাদিক ফাগুন রেজার পিতা হিসেবে আমি নিজে তা ভালোভাবেই জানি।

এখন প্রশ্ন হলো সাংবাদিকদের নামে কেন হত্যা মামলা হচ্ছে। গণমাধ্যম বাংলা আউটলুকের ২৪ আগস্ট প্রকাশিত এক প্রতিবেদনের শিরোনাম হয়, ‘শিক্ষার্থীদের ওপর শামীম ওসমান ও তার বাহিনীর গুলি চালানোর ভিডিও ভাইরাল।’ উত্তরের অনেকটাই এই খবরের মাঝখানে রয়েছে। যা লিখা হয়েছে খবরে তা সরাসরিই তুলে দিই, ‘এছাড়া ডিবিসি টেলিভিশন ও যুগান্তর পত্রিকার নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রতিনিধি রাজু আহমেদের হাতে দুটি আগ্নেয়াস্ত্র ছিল। আর দেশ রূপান্তর পত্রিকার জেলা প্রতিনিধি কমল খানকেও অস্ত্রের মহড়ায় দেখা যায়।’

অর্থাৎ ডিবিসি টেলিভিশনের সাংবাদিক নিজে গুলি ছুড়েছেন অস্ত্র হাতে এবং তিনি দৈনিক যুগান্তরেও প্রতিনিধি। যুগান্তর এবং যমুনা টেলিভিশন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খবর প্রচার করে প্রশংসা কুড়িয়েছে। কিন্তু সব জায়গায় এই দুটি গণমাধ্যমের চিত্র এক ছিল না। বাংলা আউটলুক অন্তত তাই বলছে। দেশ রূপান্তরের কভারেজও খারাপ ছিল না, তবে জায়গা ভেদে তাদের প্রতিনিধিদের কেউ খারাপ ছিলেন। সে কারণেই নারায়ণগঞ্জে অস্ত্রের মহড়ায় দেশ রূপান্তর এর প্রতিনিধিকেও দেখা গেছে।

এর আগে গণমাধ্যম ঢাকার উত্তর সিটি কর্পোরেশনের মেয়র আতিকের খবর করতে গিয়ে তার পালানোর বর্ণনা দিতে গিয়ে লিখেছিল, পেছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যান মেয়র আতিক। এসময় তার ব্যাগ টানতে দেখা গেছে ডিবিসি টেলিভিশনের এক সাংবাদিককে। সুতরাং সাংবাদিক হলেই যে দুধে ধোয়া হবে এবং তার ভেতর দোষ-ত্রুটি থাকবে না, তা চিন্তা করা অবান্তর।

বাংলাদেশে সাংবাদিকতা পেশা নিয়ে নানান কথা হয়। বলা হয়, সাংবাদিকরা সত্য লিখেনি কিংবা লিখতে ভয় পেয়েছে। ভয় পাওয়াটা দোষের নয়। জান বাঁচানো ফরজ। কিন্তু যারা ইচ্ছে করে ক্ষমতাচ্যুত শাসকদলের ছত্রছায়ায় সত্য না লিখে বরং উল্টো কাজ করেছে, তাদের সেই কাজ দোষের। সত্য গোপন করাটা এবং মিথ্যাকে সত্য বলে চালিয়ে দেয়াটা পরিষ্কার অপরাধ। আর এ অপরাধটাই অবলীলায় করে গেছেন শাকিল-রূপারা। যারা মানুষ হত্যায় উসকানি দেয় অস্ত্রবাজদের চেয়ে তারা কম দোষী নয়। তাদের অপরাধ সমান। মূলত রূপা এবং প্রভাস আমিন এ দুজন সাংবাদিকের উসকানিতেই ‘রাজাকার’ শব্দটি উচ্চারণ করেন পতিত প্রধানমন্ত্রী স্বৈরাচারী শেখ হাসিনা। তারপরেই শিক্ষার্থীরা বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার দায়িত্ব পেয়েছিলেন এবং এখন যিনি বস্ত্র ও পাট মন্ত্রণালয় দেখছেন, তিনি জানিয়েছিলেন হাজারের মতন শিক্ষার্থীর মৃত্যু ঘটেছে।

চীনের তিয়েনমেন স্কয়ারের ঘটনার পর বিশ্বে এত বেশি শিক্ষার্থীর মৃত্যু আর হয়নি। শাসকদলের নির্দেশিত বুলেটে এতবেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী হত্যার ইতিহাসে এখন দুটো নাম চীন ও বাংলাদেশ। বিশ্বের ইতিহাস যুগে যুগে এ সাক্ষ্যবহন করবে। কী দুর্ভাগ্য আমাদের একটা কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সাথে হাসিনা রেজিম বাংলাদেশের নাম জুড়ে দিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের করা পতিত স্বৈরাচারের সমর্থক সাংবাদিকদের একটা তালিকা গণ ও সামাজিকমাধ্যমে ছড়িয়ে রয়েছে। তারমধ্যে দুজন গ্রেপ্তার হয়েছেন একজন ভারতে পরিবারসহ পালাতে গিয়ে পালাতে পারেননি। অন্যরাও রয়েছেন আড়ালে-আবডালে। হাসিনা রেজিমে বহু সাংবাদিকের প্রাণ গেলেও তারা মুখ খুলেননি। বিচার চাননি এবং তা চাপ প্রয়োগের ক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও। সাগর-রুনির হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে কারো কারো তো কপাল খুলে গিয়েছিল। হয়েছেন টেলিভিশন চ্যানেলের মালিকও। নেতৃত্বের নামে তারা বাণিজ্য করেছেন এবং তাদের মূলধন ছিল নিহত গণমাধ্যমকর্মী হত্যার বিচারের দাবি। তারা পণ্য হিসেবে বেচেছেন সে দাবিকে।

সাংবাদিকতার প্রথম পাঠ হলো প্রশ্ন করা। প্রশ্নটা করতে হয় এস্টাব্লিশমেন্ট অর্থাৎ ক্ষমতাকে। যার ক্ষমতা আছে সেই অপরাধ করতে সক্ষম। যে হোক দুর্নীতি কিংবা খুন। কিংবা যে কোনো ধরণের অপরাধ। অথচ সদ্য বিগত রেজিমের দেড় দশক জুড়ে দেখেছি সাংবাদিকতার নামে তোষামুদি। দেখেছি ফারজানা রূপার স্বঘোষিত বোকা প্রশ্নের আড়ালে চাটুকারিতা এবং মানুষ হত্যার উসকানির উপাদান। নিজের ছেলের হত্যাকাণ্ডের পর, আরেক সাংবাদিক নাদিম হত্যার ব্যাপারে কথা বলতে গিয়েছিলাম এক সাংবাদিক নেতার সাথে।

নাদিম খুন হয়েছিলেন হাসিনার পাইক-বরকন্দাজদের হাতে। সেই সাংবাদিক নেতা বিচারের আলাপ তো পরে, আগে বললেন, ‘দেখেন, সাংবাদিকের হয়তো দোষ ছিল, না হলে মেরে ফেলবে কেন’। আর বললেন, একেবারে ভাবলেশহীন ভাবে অবলীলায়। বিস্মিত হলাম সাথে নিজের কপাল আর সৃষ্টিকর্তাকে দোষ দিলাম, কেন আমার ছেলে গণমাধ্যমে কাজ করতে গেলো ভেবে।

এই যে সাংবাদিক হত্যা হয়েছে গত দেড় দশকে তার পেছনে শাকিল-রূপার মতন চাটুকার সাংবাদিকদের হাত রয়েছে। প্রতিটা রেজিমই চেষ্টা করে গণমাধ্যমকে পক্ষে রাখতে। সাম-দাম-দণ্ড-বধ চাণক্যের এই চার প্রক্রিয়াই তারা প্রয়োগ করে সাংবাদিকদের নিয়ন্ত্রণে। সাম হলো বোঝানো। না হলে দাম, মানে কেনার চেষ্টা। তাও না হলে দণ্ড ভয় বা শাস্তি দেয়া। সর্ববেশ বধ, মানে হত্যা।

বিগত রেজিম এই চার প্রক্রিয়ার প্রতিটাই প্রয়োগ করেছে সাংবাদিকদের ওপর। যারা মতান্ধ ছিল, তাদের বোঝানোতেই কাজ হয়েছে। যারা চালাক ছিল, তারা দাম পেয়েছে। যেমন শাকিল-রূপার সম্পদ রয়েছে হাজার কোটি টাকার ওপরে। ফ্ল্যাট-গাড়ি-বাড়ি সবই রয়েছে। রয়েছে বিদেশে সম্পদ। আরো কেউ কেউ ধরা পড়লে বেরিয়ে আসবে তাদের কী রয়েছে। সুতরাং চালাকেরা দামে বিক্রি হয়েছে। আর কাউকে কাউকে দণ্ডের ভয় দেখিয়ে চুপ রাখা হয়েছে। যারা চুপ থাকতে চায়নি তাদের বধ অর্থাৎ হত্যা করা হয়েছে। সাগর-রুনি, ফাগুন রেজা সেই ‘বধ’ এর শিকার।

যারা সাংবাদিক মানেই ছাড় পাওয়ার যোগ্য এমনটা ভাবেন, তারা পুনর্বার ভেবে দেখতে পারেন। এ লেখাটি তাদের ভেবে দেখার জন্যই।

Bangla Outlook

Exit mobile version