Site icon The Bangladesh Chronicle

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নিয়ে যা জানা যাচ্ছে

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার আবেদন নিয়ে যা জানা যাচ্ছে – ছবি : সংগৃহীত

বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে ‘বিদেশে নেয়া হচ্ছে’- এমন একটি প্রচারণা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লেও তার দল ও পরিবারের সূত্রগুলো বলছে, তাকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার অনুমতি দেয়ার কোনো ইঙ্গিত তারা সরকারের দিক থেকে এখনো পাননি।

খালেদা জিয়ার জীবন রক্ষার্থে ‘অ্যাডভান্সড মেডিক্যাল সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ অত্যাবশ্যক’ উল্লেখ করে বিদেশে নেয়ার জন্য সরকারের অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন তার ভাই।

এর মধ্যেই শুক্রবার (২৯ সেপ্টেম্বর) আবারো হাসপাতালের কেবিন থেকে সিসিইউতে নেয়া হয় তাকে।

আইনমন্ত্রী আনিসুল হক অবশ্য বৃহস্পতিবার সংবাদমাধ্যমকে বলেছেন, খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশের নেয়ার জন্য অনুমতি চেয়ে তার পরিবারের পক্ষ থেকে যে আবেদন করা হয়েছে, সেটি যাচাই-বাছাই করে স্বল্প সময়ের মধ্যেই সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়া হবে।

পরিবারের পক্ষ থেকে খালেদা জিয়ার ভাই শামীম ইস্কান্দার সোমবার তাকে স্থায়ীভাবে মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসা দেয়ার অনুমতি চেয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ওই আবেদন করেছেন।

ওই আবেদনটির আইনগত দিক যাচাই-বাছাইয়ের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে মন্ত্রী নিশ্চিত করেছেন।

যদিও এর আগে বিষয়টি নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য এসেছে সরকার ও বিএনপি দলীয় আইনজীবীদের পক্ষ থেকে। এক সপ্তাহে আগে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, ‘আইনের বর্তমান অবস্থানে থেকে সরকারের আর কিছুই করার নেই।’

বিএনপির আইন-বিষয়ক সম্পাদক কায়সার কামাল বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসনকে যে আইন অনুযায়ী শর্তযুক্ত মুক্তি ছয় মাস করে দিচ্ছে সরকার, ওই আইন বলেই তাকে নিঃশর্ত মুক্তি দিয়ে বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি দেয়ার সুযোগ আছে।’

খালেদা জিয়াকে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দিতে কয়েক বছর ধরেই সরকারের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছে তার পরিবার।

খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা কেমন
শামিম ইস্কান্দার সরকারের কাছে যে চিঠি দিয়েছেন সেখানে বলা হয়েছে খালেদা জিয়া লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগে আক্রান্ত হয়েছেন, যার আধুনিক চিকিৎসা বাংলাদেশে সম্ভব নয়।

চিঠিতে বলা হয়েছে, ‘তিনি উঠে দাঁড়াতে পারেন না, এমনকি কারো সাহায্য ছাড়া ওয়াশ-রুম কিংবা শয়নকক্ষের বাইরেও যেতে পারেন না।’

এদিকে বিএনপি নেতারা বারবারই বলছেন, ঢাকার একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর অবস্থা ‘সঙ্কটাপন্ন’।

গত ২৪ সেপ্টেম্বর নয়া পল্টনে বিএনপি অফিসের সামনে এক সমাবেশে খালেদা জিয়ার অসুস্থতার প্রসঙ্গ বলতে গিয়ে নেতাকর্মীদের সামনেই ‘কেঁদেছেন’ দলটির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। খালেদা জিয়ার মুক্তি ও উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানোর দাবিতেই ওই সমাবেশের আয়োজন করেছিল বিএনপি।

মির্জা ফখরুল তখন বলেছিলেন, ‘হাসপাতালের চিকিৎসকেরা বলেছেন, আপনাদের কিছু করার থাকলে করেন। খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা ভালো নয়। অবিলম্বে বিদেশে নিয়ে উন্নত চিকিৎসা দিতে না পারলে বাঁচানো দুষ্কর হবে।’

এসব কারণেই জনমনে কৌতূহল তৈরি হয়েছে যে খালেদা জিয়ার অবস্থা আসলে কেমন কিংবা তার স্বাস্থ্যের কী ধরনের অবনতি হয়েছে।

গত ১৩ জুন হঠাৎ করে অসুস্থ হয়ে পড়লে তাকে হাসপাতালে নেয়ার পর তিনি পাঁচ দিন চিকিৎসা নিয়ে বাসায় ফিরেছিলেন। এরপর কয়েকবার অসুস্থতা বোধ করলে বাসাতেই তার চিকিৎসা দিয়েছেন তার চিকিৎসার জন্য গঠিত মেডিক্যাল বোর্ড।

অসুস্থতা বেড়ে গেলে গত ৯ আগস্ট রাতে খালেদা জিয়াকে যখন হাসপাতালে নেয়া হয়, তখন বলা হয়েছিল যে তিনি ‘শারীরিক জটিলতায় ভুগছেন।’ এরপর থেকে তিনি হাসপাতালেই আছেন এবং দু’দফা তাকে সিসিইউতেও নিতে হয়েছে।

এর মধ্যে গত ১৮ সেপ্টেম্বর দেশী-বিদেশী চিকিৎসকদের সমন্বয়ে গঠিত মেডিক্যাল বোর্ডের বৈঠকের পর লিভার সিরোসিসে আক্রান্ত খালেদা জিয়ার পরিপাকতন্ত্রে রক্তক্ষরণ ও কিডনি জটিলতার বিষয়টি জানান বিএনপি নেতারা।

বিএনপির সূত্রগুলো বলছে, ঢাকার তার মেডিক্যাল বোর্ডের সাথে বিদেশী কয়েকজন বিশেষজ্ঞ ছাড়াও সম্পৃক্ত হয়েছেন দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসন তারেক রহমানের স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমান।

বিদেশে নেয়ার যে যুক্তি দেখাচ্ছে বিএনপি
দলের স্বাস্থ্য-বিষয়ক সম্পাদক ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, দু’বছর আগেই মেডিক্যাল বোর্ড বিদেশে মাল্টি ডিসিপ্লিনারি সেন্টারে নিয়ে খালেদা জিয়ার চিকিৎসার সুপারিশ করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘এখানে আসলে এখন তিনি শুধু সাপোর্টিভ ট্রিটমেন্ট পাচ্ছেন। যেমন জ্বর আসলে জ্বরের চিকিৎসা। গত জুনে হার্টের রিং পড়ানো হয়েছে। কিন্তু এভাবে তো হবে না। তার মূল সমস্যার তো আর কোনো চিকিৎসা বাংলাদেশে নেই। এ কারণেই তাকে বিদেশে নেয়া দরকার।’

ডা. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মেডিক্যাল বোর্ডের নিবিড় পর্যবেক্ষণে তিনি আছেন। কিন্তু বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী দীর্ঘ দিন ধরে চিকিৎসা না হওয়াতে মূল সমস্যাগুলো আরো জটিল আকার ধারণ করেছে।’

কিন্তু জটিল আকার বলতে কী বোঝানো হচ্ছে এটি ‘রোগীর স্বাস্থ্য গোপনীয়তা’র কথা উল্লেখ করে আনুষ্ঠানিকভাবে দল বা মেডিক্যাল বোর্ডের কেউই বলতে রাজি হননি।

যদিও দলীয় সূত্রগুলো জানিয়েছে, খালেদা জিয়ার মূল সমস্যা এখন লিভার সিরোসিস এবং এ থেকে তার কিডনি ও ফুসফুস আক্রান্ত হয়েছে। ফলে কিছু দিন পর পর তার পেটে পানি জমছে এবং সেগুলো অপসারণ করতে হচ্ছে।

এর আগে থেকেই তিনি আথ্রাইটিস, হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসে আক্রান্ত। তবে এখন পরিপাকতন্ত্রের রক্তক্ষরণ ও কিডনি জটিলতা নিয়ে বেশি উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়েছে দল ও পরিবারের মধ্যে।

বিদেশে নেয়ার অনুমতি চেয়ে সরকারের কাছে তার ভাই সোমবার যে আবেদন করেছেন তাতে ‘লিভার সিরোসিস ও হৃদরোগ এবং ক্রনিক কিডনি ডিজিজ’-এর কথা উল্লেখ করা হয়েছে।

বিদেশে নেয়ার অনুমতি
সোমবার শামীম ইস্কান্দার নতুন করে আবেদনের পরেই আইনমন্ত্রী ‘যাচাই-বাছাই করে স্বল্প সময়ে সিদ্ধান্ত নেয়ার’ কথা বলার পর গুঞ্জন ছড়িয়ে পড়ে যে সরকার খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে নেয়ার অনুমতি দিতে যাচ্ছে।

যদিও সরকারি দল ও আইন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্র দাবি করছে, এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হলে সেটি হতে পারে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দেশে ফিরে আসার পর। সফরসূচি অনুযায়ী আগামী ৪ অক্টোবর তার ঢাকায় ফিরে আসার কথা রয়েছে।

তবে খালেদা জিয়ার শারীরিক পরিস্থিতি কেমন থাকে সেটির ওপরও সিদ্ধান্ত নির্ভর করছে।

বিএনপির একটি অংশের নেতারা বলছে, তাদের ধারণা যে সরকার খালেদা জিয়াকে বিদেশে নেয়ার জন্য অনুমতি দিতে আরো সময় নিতে পারে। তবে এই সময়ের মধ্যে তার শারীরিক অবস্থার আরো অবনতি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।

তবে এর ভিন্নমতও আছে। এক্ষেত্রে এক সপ্তাহের মধ্যে বিষয়টি নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের দু’ধরনের বক্তব্যকে তারা সামনে নিয়ে আসছেন।

প্রথমে তিনি বলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার বিষয়ে সরকারের কিছু করার নেই। এরপর বৃহস্পতিবার তিনি বলেন, বিদেশে নেয়ার অনুমতি চেয়ে পরিবারের আবেদন ‘স্বল্প সময়ে’ যাচাই-বাছাই করে সিদ্ধান্ত নেয়া হবে।

কায়সার কামাল বলেন, ‘সাবেক প্রধানমন্ত্রীর শারীরিক অবস্থা সরকারের অজানা নয়। হাসপাতালে গোয়েন্দা সংস্থার লোকজন আছে। সরকার সব কিছু জানে। আমরা আশা করি, পরিবারের মানবিক আবেদনে সরকার দ্রুত সাড়া দেবে। আমরা শুধু বলতে পারি, আইনগতভাবে এতে কোনো বাধা নেই।’

এখনকার পরিস্থিতি জটিল বলেই হয়তো আইনমন্ত্রী ‘স্বল্প সময়ে’র কথাটি বলেছেন বলে অনেকে মনে করছে। এ কারণে এবার সরকারের কাছ থেকে ‘ইতিবাচক সিদ্ধান্ত’ আসবে বলে আশা করছেন দলটির অনেকে।

নতুন আবেদন নিয়ে জল্পনা
বিএনপি নেতারা বলছে, ওয়ান ইলেভেনের সময় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নিজেও কারাগার থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার জন্য বিদেশে গিয়েছিলেন। তাছাড়া আওয়ামী লীগ নেতা হাজী সেলিম ও পরলোকগত মোহাম্মদ নাসিমও কারাদণ্ড মাথায় নিয়েই বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি পেয়েছিলেন।

খালেদা জিয়ার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি প্রসঙ্গে এই উদাহরণগুলোও তারা সামনে নিয়ে আসছেন।

গত ৫ সেপ্টেম্বর শামীম ইস্কান্দার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে খালেদা জিয়ার দণ্ডাদেশ স্থায়ীভাবে স্থগিতের জন্য যে আবেদন করেছেন সেখানে উল্লেখ করেন, ‘বেগম জিয়ার জীবন রক্ষার্থে ও শারীরিক সক্ষমতা ফিরিয়ে আনার জন্য জরুরিভাবে উন্নতমানের ফিজিওথেরাপিসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের তত্ত্বাবধানে দেশের বাইরে অ্যাডভান্সড মেডিক্যল সেন্টারে চিকিৎসা গ্রহণ অত্যাবশ্যক।’

এ প্রেক্ষাপটে সব শর্ত শিথিল করে তাকে স্থায়ীভাবে মুক্তি ও বিদেশে যাওয়ার অনুমতি দেয়ার আবেদন করেছিলেন শামীম ইস্কান্দার।

ওই সূত্রটি দাবি করেছে, এরপর সরকারের দিক থেকেই শুধুমাত্র মেডিক্যাল ইস্যু তুলে ধরে বিদেশে চিকিৎসার সুযোগ দেয়ার আবেদন করার জন্য পরামর্শ দেয়া হয়েছে বলেই শামীম ইস্কান্দার নতুন করে আবার সোমবার বিদেশে চিকিৎসার অনুমতি চেয়ে আবেদন করেছেন।

যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে এসব বিষয়ে কেউ কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।

খালেদা জিয়া কোভিড-১৯ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় ২০২১ সালের ২৭ এপ্রিল হাসপাতালে ভর্তি হন ও ৫৪ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ওই বছরের ১৯ জুন বাসায় ফেরেন। পরে ওই বছর ১৩ সেপ্টেম্বর আবার হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৮০ দিন চিকিৎসাধীন থাকার পর ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি বাসায় ফেরেন।

কিন্তু এরপর আরো অন্তত সাতবার তাকে হাসপাতালে যেতে হয়েছে।
সূত্র : বিবিসি

Exit mobile version