Site icon The Bangladesh Chronicle

খাদিজার মুক্তি মিলেছে, লড়াই শেষ হয়নি

ওপরের ছবিটি খাদিজাতুল কুবরার। তিনি কোনো গুরুতর অপরাধ করেছেন, এ রকম প্রমাণ নেই। তারপরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে করা মামলায় ১৫ মাস জেল খাটতে হয়েছে। কাশিমপুর কারাগার থেকে বেরিয়ে খাদিজা বাড়ি যেতে পারেননি। তাঁকে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে যেতে হয়েছে পরীক্ষা দিতে। পাশাপাশি দু্টি ছবির একটিতে দেখা যায়, খাদিজা কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে বের হয়েছেন। সালোয়ার কামিজের সঙ্গে মাথায় কালো স্কার্ফ। অপর ছবিতে সেই পোশাকেই জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যোলয়ে পরীক্ষার হলে বসে পরীক্ষা দিচ্ছেন।

প্রথম আলোর অনলাইন খবরে বলা হয়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় কারাগার থেকে মুক্তি পাওয়ার পর পরীক্ষার হলে বসেছেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী খাদিজাতুল কুবরা। সোমবার সকাল ৯টার দিকে গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় মহিলা কারাগার থেকে মুক্তি পান খাদিজা। পরে তিনি ঢাকার উদ্দেশে রওনা হন। বেলা ১১টা ৭ মিনিটে তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান ফটক দিয়ে ভেতরে প্রবেশ করেন। তিনি সরাসরি পরীক্ষার হলে গিয়ে আসন নেন।

খাদিজা জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষের শিক্ষার্থী। তবে তিনি পুনর্ভর্তি নিয়ে ২০২০-২১ সেশনে পরীক্ষা দেন।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুই মামলায় খাদিজার জামিনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের করা লিভ টু আপিল ১৬ নভেম্বর খারিজ করেন আপিল বিভাগ। আপিল বিভাগের এই আদেশের ফলে দুই মামলায় খাদিজাকে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন বহাল থাকে। এর ধারাবাহিকতায় তিনি ১৫ মাস পর কারাগার থেকে সোমবার মুক্তি পেলেন।

অনলাইনে সরকারবিরোধী বক্তব্য প্রচারসহ দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করার অভিযোগে ২০২০ সালের অক্টোবরে খাদিজা ও অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেনের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে পৃথক দুটি মামলা হয়। একটি মামলা হয় রাজধানীর কলাবাগান থানায়, অন্যটি নিউমার্কেট থানায়। দুটি মামলার বাদীই পুলিশ।

গত বছরের মে মাসে দুই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ। অভিযোগপত্র আমলে নিয়ে ঢাকার সাইবার ট্রাইব্যুনাল দুই আসামির বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেন। গত বছরের ২৭ আগস্ট মিরপুরের বাসা থেকে খাদিজাকে গ্রেপ্তার করেছিল নিউমার্কেট থানা-পুলিশ।

খাদিজাতুল কুবরা মুক্তি পেলেও তাঁর লড়াই শেষ হয়নি। কেননা ডেমোক্লেসের তরবারির মতো তাঁর মাথার ওপর ঝুলছে বাতিল হওয়া ডিজিটাল আইনের দুটি মামলা । এখন তাঁকে মামলা লড়তে হবে। কিন্তু  খাদিজা পড়াশোনা করবেন না মামলা লড়বেন?
ইতিমধ্যে তাঁর জীবন থেকে ১৫টি মাস হারিয়ে গেছে। যখন তাঁর শ্রেণিকক্ষে পাঠ নেওয়া কিংবা পরীক্ষা দেওয়ার কথা, তখন কাটাতে হয়েছে কারাগারের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে।

উল্লেখ্য, বিচারিক আদালতে দুবার খাদিজার জামিন আবেদন নাকচ হয়। পরে তিনি হাইকোর্টে জামিনের আবেদন করেন। গত ১৬ ফেব্রুয়ারি তাঁর জামিন মঞ্জুর করেন হাইকোর্ট। রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের দেওয়া জামিন স্থগিত করেন চেম্বার আদালত।

অন্যদিকে চেম্বার আদালতের দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার চেয়ে খাদিজা আবেদন করেন, যা রাষ্ট্রপক্ষের করা আবেদনের সঙ্গে গত ১০ জুলাই আপিল বিভাগে শুনানির জন্য ওঠে। সেদিন আপিল বিভাগ আবেদন শুনানি চার মাসের জন্য মুলতবি (স্ট্যান্ডওভার) করেন। খাদিজার পক্ষে শুনানিতে ছিলেন আইনজীবী বি এম ইলিয়াস ও জ্যোতির্ময় বড়ুয়া।

খাদিজা কোনো দুর্ধর্ষ অপরাধী নন। ছাত্রজীবনে তিনি রাষ্ট্রদ্রোহ কোনো তৎপরতার সঙ্গে জড়িত ছিলেন—এ রকম প্রমাণও সরকারের কাছে নেই। তারপরও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে তাঁকে ১৫ মাস ধরে কারাগারে আটক রাখা হয়েছিল।

খাদিজা পড়াশোনার পাশাপাশি ইউটিউব চ্যানেলে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করতেন। তাঁর একটি অনুষ্ঠানের অতিথি ছিলেন অবসরপ্রাপ্ত মেজর দেলোয়ার হোসেন। সেটাই খাদিজার জন্য কাল হলো।

খাদিজা যে অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেছেন, সেই অনুষ্ঠানে যদি অবসরপ্রাপ্ত দেলোয়ার হোসেন সরকারবিরোধী বক্তব্য দেন, এর দায় খাদিজার ওপর চাপানো হবে কেন? টেলিভিশনের টক শোতেও তো দেখা যায়, একজন অতিথি অপরের চোখ তুলে নেওয়ার হুমকি দেন, নানা রকম বিদ্বেষ ছড়ান। সে কারণে সঞ্চালক কিংবা অতিথির বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে বলে জানা নেই।

খাদিজার বিরুদ্ধে যখন মামলা হয়, জন্মসনদ অনুযায়ী তাঁর বয়স ১৮ বছরের নিচে। সে ক্ষেত্রে তাঁর বিরুদ্ধে কোনো অভিযোগ থাকলে সেটি শিশু আইনেই প্রতিকার হওয়ার কথা।

সরকার ইতিমধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি বাতিল করে সাইবার নিরাপত্তা আইন জারি করেছে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যেসব ধারায় খাদিজাতুল কুবরার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল, সেগুলো ছিল জামিন-অযোগ্য। আরও অনেকের বিরুদ্ধে জামিন-অযোগ্য ধারায় মামলা বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছিল। কিন্তু সাইবার নিরাপত্তা আইনে প্রায় সব ধারাই জামিনযোগ্য।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল হওয়ার পর সেই আইনে করা মামলাগুলো চলতে পারে না। আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুক্তি দেখিয়েছেন, অপরাধ সংঘটনের সময় যে আইন বহাল ছিল, সেই আইনেই বিচার হবে। কিন্তু এই আইনে যে সাত হাজার মামলা হয়েছে, তার বেশির ভাগই হয়রানিমূলক। অনেক ক্ষেত্রে কথিত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। এ পর্যন্ত সাত হাজার মামলার মধ্যে মাত্র দুই শতাংশ নিষ্পত্তি হয়েছে।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিল করে সরকারই প্রমাণ করেছে, এটি নির্যাতনমূলক ছিল। সাইবার মাধ্যমে সংঘটিত অপরাধের বিচার নয়, মূলত  ভিন্নমতের নাগরিকদের কণ্ঠ রোধ করতেই এই আইন করা হয়েছিল।

আইনের দৃষ্টিতে কেউ অপরাধ করলে তিনি শাস্তি পাবেন। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি এতটাই ভয়ংকর যে কারও বিরুদ্ধে মামলা হলেই তাঁকে চৌদ্দ শিকের অধীন নেওয়া হতো। খাদিজাতুল কুবরার বিরুদ্ধে সরকারবিরোধী প্রচারণার অভিযোগ দেওয়া হয়েছে। সরকার ও রাষ্ট্র এক নয়। সরকারের সমালোচনা যেকোনো নাগরিক করতে পারেন।

গত মার্চ মাসে একজন দিনমজুরের কথা তুলে ধরায় প্রথম আলোর সাভার প্রতিনিধি শামসুজ্জামানকে গ্রেপ্তার করে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে যাওয়ার ২০ ঘণ্টা পর মামলা দেওয়া হয় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। একই আইনে মামলা দেওয়া হয় প্রথম আলো সম্পাদক মতিউর রহমানের বিরুদ্ধেও। তাঁরা দুজনই বর্তমানে জামিনে এবং কিছুদিন পরপর তাঁদের আদালতে হাজির হতে হয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে এ রকম শত শত মামলা করা হয়েছে।

বাতিল হওয়া আইনে কোনো মামলা চলতে পারে না। খাদিজা জামিন পেলেও তাঁর সংগ্রাম শেষ হয়নি। তাঁকে মামলা লড়তে হবে। প্রতি তারিখে আদালতে হাজিরা দিতে হবে। একজন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীর প্রতি এটা নিষ্ঠুরতাই বটে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে খাদিজাসহ আরও যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, তা প্রত্যাহার করা হোক।

সূত্র : প্রথম আলো

Exit mobile version