Site icon The Bangladesh Chronicle

ক্রসফায়ারে চাপ আসায় হত্যা করা হতো নদীতে

 

আমিনুল ইসলাম
মুদ্রিত সংস্করণ
  • গুলি করা হতো মাথায়
  • হত্যা করা হতো বিষ ও ইনজেকশন প্রয়োগেও

আন্তর্জাতিক চাপ আসায় ক্রসফায়ার কমিয়ে হত্যাকাণ্ডের নতুন পদ্ধতি চালু করে আওয়ামী লীগ সরকারের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যার মধ্যে সব থেকে বেশি হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয় মাঝ নদীতে। গুম হওয়া ব্যক্তিকে নৌকায় করে নিয়ে মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে একটি বা দু’টি গুলি করে লাশ ফেলা হতো নদীতে। তার আগে শরীরে শক্ত করে বাঁধা হতো সিমেন্টের বস্তা। এরপর পেট ফেড়ে ধাক্কা দিয়ে ফেলা হতে নদীতে, যাতে করে লাশ ভেসে না ওঠে। অথবা বিষ প্রয়োগ বা ইনজেকশন পুশ করে হত্যার পর লাশ ফেলা হতো রেল লাইনে। এরপর চলন্ত ট্রেনের নিচে পড়ে লাশটি কাটা পড়ত ট্রেনে। অন্যরা বুঝত লোকটি হয়তো কোনো ডিপ্রেশনের কারণে রেললাইনে ঝাঁপ দিয়ে আত্মহত্যা করেছেন।

আওয়ামী লীগ সরকারের সময় গুমের শিকার ব্যক্তিদের নির্যাতনের লোমহর্ষক বর্ণনার তথ্যচিত্র প্রকাশ করেছে গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারি। সেসব বর্ণনায় এমন তথ্য পাওয়া গেছে। গত বছরের পাঁচ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগের পতনের পর ওই সব বাহিনীর অভিযুক্ত অনেক কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালালেও এখনো অনেকে বহাল আছেন। এ দিকে এসব গুম ও হত্যার সবকিছু সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশেই হয়েছে বলে মনে করছে গুম কমিশন।

হত্যার সময় যখন সেল থেকে কাউকে নেয়া হতো তখন সেই মানুষকে ডাকা হতো মোরগ, প্যাকট বা সাবজেক্ট নামে। এরপর যে সদস্য বাহিনীতে নতুন যোগদান করেছেন তাদের বলা হতো গাড়ি থেকে একটি করে মোরগ নামাও, গুলি করো। আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে শত শত মানুষ গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের সাথে বাংলাদেশের প্রত্যেকটা বাহিনী জড়িত। তবে তাদের মধ্যে মূল ভূমিকায় ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ছয়টি ইউনিট। সেগুলো হলো-র‌্যাব, পুলিশ, ডিবি, সিটিটিসি, ডিজিএফআই ও এনএসআই। এসব বাহিনীর সদস্যদের তত্ত্বাবধানে গুমের শিকার ব্যক্তিদের দিনের পর দিন আটকে রেখে অমানবিক নির্যাতন করা হয়। তাদের অনেককেই হত্যা করা হয়েছে।

তথ্য চিত্রে বলা হয়েছে প্রথম দিকে ক্রসফায়ার ও গুমের পর হত্যা করে লাশ রাস্তাঘাটে ফেলা হতো। কিন্তু মানুষ বুঝে ফেলত এটা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কোনো সদস্যের কাজ। তখন তারা সিদ্ধান্ত নিলো ‘আরে আমরা বডি প্রডিউস করি কেন, বডি নাই করে দিলেই তো হয়’। এসব অপকর্মের পুরস্কার হিসেবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতিসহ বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন।

প্রমাণ্যচিত্রের অংশে বলা হয়, সাবেক মেজর জেনারেল জিয়াউল আহসান সুন্দরবন অভিযান চালিয়ে জলদস্যুদের কাছ থেকে বড় ট্রলার জব্দ করেছিলেন। বেশির ভাগ হত্যাকাণ্ড ওই ট্রলারেই করা হয়েছে। গুম করে জিজ্ঞাসাবাদের পর যখন কাউকে হত্যা করা হবে বলে সিদ্ধান্ত নেয়া হতো তখন তাকে তুলে নেয়া হতো ওই নৌকায়। এরপর বুড়িগঙ্গা বা আশপাশের কোনো নদীর মাঝখানে নেয়া হতো। সেখানে জীবন্ত অবস্থায় তার শরীরে বাঁধা হতো সিমেন্টের বস্তা। এরপর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে গুলি করা হয়েছে। এসব অপারেশনের সাথে থাকা কয়েকজন কর্মকর্তা গুমসংক্রান্ত কমিশনকে বলেছেন, স্যারের (জিয়াউল আহসান) প্রধান টার্গেট থাকত মাথা। খুব কাছ থেকে অথবা মাথার সাথে পিস্তল লাগিয়ে গুলি করা হতো। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে একটি গুলিই করা হতো। তবে গুলি যদি মাঝামাঝি বিদ্ধ না হয়ে পাশে লাগত, তখন দ্বিতীয় গুলি করা হতো। এরপর তার পেট ফেড়ে লাশ নৌকা থেকে নদীতে ফেলা হতো।

তবে তথ্যচিত্রে গুম কমিশনের সদস্য নুর খান বলেছেন, এটাই গুমের পূর্ণাঙ্গ তথ্য নয়। এখনো অনেকে রয়েছেন, যারা সাহস পাচ্ছেন না জনসম্মুখে অভিযোগ করতে। তথ্যচিত্রে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘যদি এই কমিশন না থাকত তবে সবই হয়তো গল্পের মতো মনে হতো। কেউ বলত হ্যাঁ, কেউ বলত না। কিন্তু এখন তাদের হাতে (গুমসংক্রান্ত কমিশন) সুনির্দিষ্ট প্রমাণ আছে। এখন আমরা ন্যায়বিচারের দিকে এগোবো।’

তথ্যচিত্র সূত্রে দেখা গেছে, গুম কমিশনের সাথে সাক্ষাৎকারে এক ভুক্তভোগী বলেছেন, তিনি একটি বাহিনীর সদস্যকে বলেছিলেন, ‘আপনি নিজেও তো দেখতেছেন তারা (আইনশৃঙ্খলা বাহিনী) অস্ত্র দিয়ে নাটক সাজাইতাছে। এতে ওনাদের লাভ কী। তখন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ওই সদস্য বলেন, আপনারা চলে যাবেন, এরপরই স্যারের প্রমোশন হবে, এটাই লাভ। ভুক্তভোগী তখন বলেন, একটা প্রমোশনের জন্য আমার জীবনডারে ধ্বংস করে দিলো।

গুমসংক্রান্ত কমিশন অব ইনকোয়ারির অন্যতম সদস্য ড. নাবিলা ইদ্রিস বলেছেন, ‘৫ আগস্টের পর সরকার পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু এর মানে এই নয় যে, বাহিনীগুলোতে কর্মরত দোষীরা পরিবর্তন হয়েছে। ৫ আগস্টের পর অত্যন্ত দ্রুততার সাথে আলামত ধ্বংস করা হয়। মণকে মণ কাগজ পোড়ানো হয়েছে সব জায়গায়। ডিজিএফআই বলেন, র‌্যাব বলেন, এনএসআই বলেন, সব জায়গায় আলামত পোড়ানো হয়। বিভিন্ন জায়গায় পুরো ভবনের স্ট্রাকচার বদলে ফেলা হয়।’

জানা গেছে, গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডে সংশ্লিষ্টতার কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ৪২ কর্মকর্তার পাসপোর্ট বাতিল করা হয়। জানুয়ারি মাসে তাদের বেশ কয়েকজনের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। পরোয়ানা বের হওয়ার সময় অনেকে দেশে ছিলেন। কিন্তু পাসপোর্ট না থাকা সত্ত্বেও গ্রেফতারি পরোয়ানা বের হওয়ার পরপরই অনেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত কমিশনে জমা পড়া ১৮০০ অভিযোগের মধ্যে ২৫০টির অকাট্য প্রমাণ মিলেছে। তাদের মধ্যে বিভিন্ন পেশাজীবী ও শ্রেণিপেশার মানুষ রয়েছে। গুমের শিকার অনেকের রাজনৈতিক পরিচয়ও মিলেছে। তাদের জঙ্গি ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া হয়েছে।

গুমের শিকার ব্যক্তির স্বজনরা সম্পত্তি নিয়ে বিপাকে পড়ছেন। অনেকে আর্থিক কষ্টে আছেন। এ বিষয়ে গুম কমিশনের সদস্য বিচারপতি মো: ফরিদ আহমেদ শিবলী বলেন, এমন একটি আইন করা দরকার যে আইনে কিছু অভাররাইটিং ক্লজ থাকবে যেন দেশে প্রচলিত আইনের বাইরে গিয়েও তাদের আইনগত সুযোগ দেয়া যায়। গুম হওয়া ব্যক্তির ডেথ সার্টিফিকেট ছাড়াই তাদের গুম হওয়ার একটা প্রত্যয়ন বা ডিস এপিয়ারেন্স সার্টিফিকেট প্রডিউস করে যাতে পরিবার-পরিজন সম্পত্তি উত্তরাধিকাররা ভোগ করতে পারে, সেজন্য এই কমিশন থেকে আইন সংশোধনের সুপারিশ করা হয়েছে। এতে অন্ততপক্ষে আর্থিক দুর্দশা কিছুটা হলেও লাঘব হবে।

Exit mobile version