দেশে বিদেশি ঋণ নিয়ে এখন বেশ আলোচনা হচ্ছে। এই ঋণ পরিশোধের চাপ ধীরে ধীরে বাড়ছে। গত ২০২২-২৩ অর্থবছরে মোট ২৬৭ কোটি ডলারের ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। আগামী সাত বছরে ঋণ পরিশোধের পরিমাণ বেড়ে দ্বিগুণ হবে বলে মনে করছে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি)।
ইতিমধ্যে দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে রাশিয়া, চীন ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া ঋণ পরিশোধ শুরু হয়ে গেছে। এমনকি মেট্রোরেলের মতো বড় প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়েছে। মূলত এসব কারণেই গত কয়েক বছরে ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ, ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে বা বিভিন্ন দেশের কাছ থেকে বেশ কিছু বড় প্রকল্পে ঋণ নেওয়া হয়েছে। এখন চলুন, আমরা এসব ঋণের পরিমাণ, সুদ, গ্রেস পিরিয়ড ইত্যাদি জেনে নিই। এই ঋণগুলোর কিস্তি পরিশোধ কবে থেকে শুরু হয়েছে বা হবে, তা–ও দেখে নেওয়া যাক।
বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) সম্প্রতি এ রকম বেশ কয়েকটি প্রকল্পের ঋণ বিষয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে। সংস্থাটি বলছে, বিদেশি ঋণ পরিশোধ করতে এখন সরকারকে ঋণ করতে হচ্ছে।
কোন প্রকল্পে কবে কিস্তি শুরু
• রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র ২০২৬ সাল।
• পদ্মা রেলসংযোগ প্রকল্প ২০২৪ সাল।
• ঢাকা-আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে ২০২৬ সাল।
• কর্ণফুলী নদীর তলদেশে টানেল নির্মাণ ২০২৪ সাল।
• দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ স্থাপন ২০২৭ সাল।
• পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্রের কিস্তি শোধ শুরু।
• ইতিমধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্পের কিস্তি শোধ শুরু।
এ নিয়ে জানতে চাইলে সাবেক পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী শামসুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশি ঋণ যাচাই-বাছাই করে নেওয়া উচিত। বিশ্বব্যাপী সুদের হার বেশি। লাইবর, সোফর এখন ৫-৬ শতাংশ। যেসব প্রকল্প দ্রুত উৎপাদনশীলতা বাড়াবে, কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে, সেগুলোর জন্যই বিদেশি ঋণ নেওয়া উচিত। তিনি আরও বলেন, ‘বিদেশি ঋণ পরিশোধের চাপ বেড়েছে। তবে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা আছে। আমরা এখনো নিরাপদ জায়গায় আছি।’
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র
রাশিয়ার ঋণে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পটি বাস্তবায়িত হচ্ছে। এই প্রকল্পে ১ হাজার ১৩৮ কোটি ডলার দিচ্ছে রাশিয়া। এ ব্যাপারে ২০১৬ সালের ২৬ জুলাই দেশটির সঙ্গে ঋণচুক্তি হয়। ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ২০ বছরে প্রকল্পটির ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এই ঋণের সুদের হার লন্ডন ইন্টার ব্যাংক সুদহারের (লাইবর) সঙ্গে আরও ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ যোগ হবে।
রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্পের জন্য নেওয়া ঋণের আসল পরিশোধ শুরু হবে ২০২৬ সালে। তখন বছরে ৫০ কোটি ডলারের মতো ঋণ পরিশোধ করতে হবে। এ পর্যন্ত এই প্রকল্পে প্রায় ৫০০ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে।
এদিকে বাংলাদেশকে ‘রূপপুর আনুষঙ্গিক অবকাঠামো নির্মাণ’ শীর্ষক আরেকটি প্রকল্প এবং মূল প্রকল্পের সুদ বাবদ বছরে মোট ২২ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। নিষেধাজ্ঞার কারণে এই অর্থ রাশিয়ার এক্সিম ব্যাংককে দেওয়া যাচ্ছে না। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি আলাদা হিসাবে অর্থ জমা রাখা হচ্ছে।
পদ্মা সেতু রেলসংযোগ
এই প্রকল্পে ২৬৭ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীন। এই ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর। ২০১৮ সালের ২৭ এপ্রিল এই চুক্তি হয়। এখন পর্যন্ত ১৫৭ কোটি ডলার ঋণ ছাড় হয়েছে। চলতি অর্থবছর থেকে এই ঋণের কিস্তি পরিশোধ শুরু হবে।
ইতিমধ্যে এই প্রকল্পের আওতায় ঢাকা থেকে ভাঙ্গা পর্যন্ত রেলপথ চালু হয়েছে। এখন পদ্মা সেতুর ওপারে নড়াইল, গোপালগঞ্জ, যশোরসহ বিভিন্ন জেলায় রেলপথ নির্মাণের কাজ চলছে।
ঢাকা আশুলিয়া এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে
২০২১ সালের ২৬ অক্টোবর চীনের সঙ্গে এই প্রকল্প নিয়ে ঋণচুক্তি সই হয়। প্রকল্পটিতে ১১২ কোটি ডলার দিচ্ছে চীন। এই ঋণের সুদহার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ। পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ঋণ পরিশোধের সময় ১৫ বছর। ঋণের কিস্তি শুরু হবে ২০২৬ সালে। ইতিমধ্যে এই ঋণের অর্থছাড় শুরু হয়েছে। এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের কাজ দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে।
পায়রা কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র
এই প্রকল্পে ১৪০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে চীনের এক্সিম ব্যাংক। এই ঋণের সুদহার লাইবরের সঙ্গে ২ দশমিক ৯৮ শতাংশ। ৪ বছর গ্রেসসহ ১৫ বছরে ঋণ পরিশোধ করতে হবে। বর্তমানে এই ঋণের বিপরীতে প্রতিবছর ২৫ কোটি ডলার পরিশোধ করতে হচ্ছে। ২০২৬-২৭ অর্থবছর নাগাদ তা ৭০ কোটি ডলারে উন্নীত হবে।
ভারতীয় ঋণগুচ্ছ
সব মিলিয়ে তিনটি লাইনস অব ক্রেডিটের (এলওসি) আওতায় ভারত ৭৩৬ কোটি ডলার সহায়তার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এর মধ্যে গত ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত সব মিলিয়ে ১৬৫ কোটি ডলার ছাড় হয়েছে। এসব ঋণের সুদের হার সার্ভিস চার্জসহ সোয়া ২ শতাংশ। ভারতীয় ঋণ পরিশোধের সময় পাঁচ বছরের গ্রেস পিরিয়ডসহ ১৫ বছর।
তিনটি এলওসিতে সড়ক ও রেল যোগাযোগ, জ্বালানি ও রাস্তাঘাট নির্মাণসহ এ পর্যন্ত ৪০টি প্রকল্প নেওয়া হয়েছে। এর মধ্যে ১৫টি প্রকল্প শেষ হয়েছে। চলমান আছে আটটি প্রকল্প। বাকি প্রকল্পগুলো পরামর্শ ও ঠিকাদার নিয়োগ এবং প্রস্তাবনা প্রস্তুত করার পর্যায়ে রয়েছে।
যেসব প্রকল্প ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে
এ ছাড়া বিদেশি ঋণে নেওয়া চট্টগ্রামের কর্ণফুলী টানেল, ঢাকার মেট্রোরেল ও কক্সবাজার রেলসংযোগ প্রকল্প ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। এর মধ্যে মেট্রোরেল প্রকল্পে নেওয়া জাপানের ঋণ পরিশোধ শুরু হয়েছে। ইতিমধ্যে দুই কিস্তিতে প্রায় ৬৫ কোটি ডলার ঋণ পরিশোধ করতে হয়েছে। চলতি ২০২৩-২৪ অর্থবছরে কর্ণফুলী টানেলের জন্য চীনের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে। দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত রেলপথ নির্মাণ প্রকল্পের ঋণ পরিশোধ শুরু হবে ২০২৭ সালে। এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) ঋণে এই প্রকল্প নেওয়া হয়।
দ্বিপক্ষীয় ঋণের অসুবিধা
চীন, রাশিয়া ও ভারতের কাছ থেকে নেওয়া দ্বিপক্ষীয় ঋণের অসুবিধা হলো: এগুলোর পুরোটাই সরবরাহকারী ঋণ। এ কারণে কাজ দিতে হয় সংশ্লিষ্ট দেশের মনোনীত ঠিকাদারকে। এতে কাজের মান ও দর নিয়ে অনেক সময়ই প্রশ্ন ওঠে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের ঋণের কিস্তি পরিশোধের সময়সীমাও বেশ কম। গ্রেস পিরিয়ড বাদ দিলে ১০-১৫ বছরে এ ধরনের ঋণ পরিশোধ করতে হয়। এতে প্রতিটি কিস্তিতে অর্থের পরিমাণ বেশি থাকে, যা সার্বিক ঋণ পরিশোধে চাপ সৃষ্টি করে।
অন্যদিকে বিশ্বব্যাংক, এডিবিসহ বিভিন্ন দাতা সংস্থা এবং জাপানের মতো দেশের কাছ থেকে ঋণ নিলে তা ৩০-৩৫ বছরে শোধ করার সুযোগ পাওয়া যায়। এতে ঋণের কিস্তির পরিমাণ কম হয়, সার্বিকভাবে চাপও কম পড়ে।
ইআরডি কর্মকর্তাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, বাংলাদেশের প্রতিবছর ১ হাজার কোটি ডলারের মতো বিদেশি ঋণের প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে প্রায় ৬০০ কোটি ডলার নমনীয় বা সহজ শর্তের ঋণ মেলে। বাকি ঋণ কঠিন শর্তে নিতে হয়। ২০১৫ সালে নিম্ন আয়ের দেশের তালিকা থেকে বের হওয়ার পর থেকেই ধীরে ধীরে কঠিন শর্তের ঋণ নিতে হচ্ছে বাংলাদেশকে।
prothom alo